ধ্রুপদী বাংলার ইতিহাস হচ্ছে বঙ্গের প্রথম স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ গৌরবোজ্জ্বল যুগ

ধ্রুপদী বাংলা (ইংরেজি: Classical Bengal) হচ্ছে বঙ্গে ৬০৬ অব্দ থেকে সেন আমলের অর্থাৎ ১০৭০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত বাংলার ইতিহাসের প্রাচীন ধ্রুপদী স্বাধীন গৌরবোজ্জ্বল সময়। বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎস হিসেবে এই সময়ের রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালকে সনাক্ত করা হয়েছে। ১০৭০ সাল থেকে বাংলা দাক্ষিণাত্যের সেন সাম্রাজ্য দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং ১০৯৭ সালে বাংলা পরাধীন হয়ে যায় বিদেশী বিভাষী সেন রাজাদের দ্বারা। এবং এর ফলে বাংলায় মধ্যযুগীয় পরাধীন আমল শুরু হয়।

প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রাচীন জাতি পুরা আর্যসভ্যতার বহুপূর্বেই এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলাে। পুণ্ড্রদের নামানুসারেই এই দেশের নাম হয় পুণ্ড্রদেশ। কোনাে কোনাে শাস্ত্রীয় যুগে পুণ্ড্রদের অসুর বলে চিহ্নিত করা হয়। কালের পরিক্রমায় পুরা আর্য-সংস্কৃতি গ্রহণ করতে থাকে। মৌর্য শাসন কালে পুণ্ড্রদেশ ঐশ্বর্যপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। মৌর্য শাসনের পূর্বেই দূর্গ নগরী পুণ্ড্রনগর প্রতিষ্ঠিত হলেও মৌর্য যুগেই পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্রদেশের রাজধানী স্থাপিত হয়। প্রাচীন ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্য যে উত্তরীয় দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলাে তার যথেষ্ট প্রমাণ ঐতিহাসিকরা খুঁজে পান। করতােয়া নদীর বিশাল জলপ্রবাহ পুণ্ড্রনগরকে সুজলাসুফলা করে তুলেছিলাে।

ধ্রুপদী বাংলার আরম্ভ

৬ষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য অন্তঃর্বিবিদ্রোহ ও হুণজাতির বার বার আক্রমণে দুর্বল হয়ে পড়ে। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। সেই অস্থিতিশীল পরিবেশে বাংলাদেশে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। এর একটি হচ্ছে স্বাধীন ‘বঙ্গ রাষ্ট্র, অপরটি ‘গৌড় রাজ্য এবং এই ঘটনার মাধ্যমে ইতিহাসে ধ্রুপদী বাংলা গড়ে ওঠে।

স্বাধীন বঙ্গ রাষ্ট্র

গুপ্ত সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে সমগ্র দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ছিল। স্বাধীন বঙ্গ রাষ্ট্রের রাজারা তামার পাতে খােদাই করা রাজ নির্দেশ জারি করতেন। এগুলােকে তাম্রশাসন বলা হতাে। এ রকম ৭টি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। স্বাধীন বঙ্গরাজ্যে চন্দ্রগুপ্ত, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদেব নামের তিনজন রাজার নাম জানা যায়। তারা ৫২৫ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তু মােট ৭৫ বছর রাজত্ব করেন। সম্ভবত চন্দ্রগুপ্ত একাই ৩৩ বছর শাসন করেছেন বলে জানা যায়। বঙ্গের রাজাগণ ‘মহাধিরাজ’ উপাধি ধারণ করতেন। এতে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। স্বাধীন বঙ্গের যথেষ্ট যশ, খ্যাতি, প্রভাব ও সমৃদ্ধির কথা জানা যায়। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে দাক্ষিণাত্যের চাণক্য রাজবংশের রাজা কীর্তি বর্মণ দ্বারা বাংলা আক্রান্ত হয়।[১]

স্বাধীন গৌড় রাজ্য

আবার কেউ কেউ মনে করেন সপ্তম শতকের গােড়ার দিকে গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের নেতৃত্বে বাংলার পুন্ড্র বা পন্ড্রবর্ধন, গৌড় এবং বঙ্গকে একত্রিত করে একটি বিশাল গৌড় রাজ্য স্থাপিত হয়। 

চারদিক থেকে আক্রমণের ফলে গুপ্ত রাজারা ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে যায়। সেই সুযােগে ৬০৬ অব্দে গৌড় দেশে শশাঙ্ক নামের একজন পরাক্রমশালী রাজা আক্রমণ করে গুপ্ত রাজাদের পরাজিত করে একটা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মুর্শিদাবাদের কর্ণ-সুবর্ণে তিনি রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। আবার অনেকের ধারণা শশাঙ্কের দ্বিতীয় রাজধানী ছিলাে উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্রবর্ধন। শশাঙ্কই ছিলেন প্রথম বাঙ্গালি; যিনি বঙ্গদেশের বাইরে সাম্রাজ্য বিস্তারের সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্বে বাঙালির এতাে বড় রাজ্য ছিলে না। (১) সমতট (২) গৌড় (৩) পুণ্ড্র (৪) তাম্রলিপ্তি ও (৫) বঙ্গ নামেই রাজ্যগুলো পরিচিত ছিলো। একমাত্র সমতট ব্যতিত রাজা শশাঙ্কের রাজ্যের সবকটি অন্তর্ভুক্ত ছিলাে।

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর কিছুদিন তার পুত্র রাজপুত্র মানব স্বাধীন রাজ্য শাসন করেছেন। রাজা শশাঙ্কই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও ব্রাহ্মণ্য কৃষ্টি বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি ছিলেন মূলত শিবভক্ত। তাঁর সময়কালে শিল্প-সংস্কৃতি ও ধর্ম প্রসার ঘটেছিলাে। শশাঙ্কের পুত্র মানবের রাজত্বকালে বৃহৎ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। মানবের পরে গৌড় বা বঙ্গদেশে কে বা কারা শাসন করেছিলাে তা ইতিহাসবিদরা বের করতে পারেননি। মানবের পরে প্রায় ১০০ বছরের ইতিহাস অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই ১০০ বছরের ইতিহাসকে ঐতিহাসিকরা অন্ধকার যুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আরো পড়ুন:  শানির দিয়াড়ের যুদ্ধ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ ও আমার রাজনৈতিক জীবন

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমকে কেন্দ্র করে প্রাচীন গৌড় রাজ্যের অভ্যুদয় ঘটে। সপ্তম শতকের শুরুতে ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক যখন গৌড়ের রাজা হন তিনি আসমুদ্র বিস্তৃত গৌড় রাজ্যের বিস্তুর ঘটান। তিনি নিজেকে গৌড়েশ্বর পরিচয় দিলেন। তিনি তার রাজ্য সীমানা পশ্চিমে বারানসী, পূর্বে কামরপ রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। এর পর গৌড় একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। শশাঙ্ক একজন সুশাসক ছিলেন। তিনি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। তার আমলে তাম্রলিপ্ত বন্দর গুরুত্ব লাভ করে। তিনি ৬৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

পাল আমলে বাংলা

প্রায় ১০০ বছরের অন্ধকার যুগের অবসান ঘটান রাজা গােপাল। তিনি ধর্মে বৌদ্ধ ছিলেন। তিনি রাজ্য লাভের পর একটা শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন। পাল আমলের পতনের ভেতর দিয়ে বাংলায় ধ্রুপদী স্বাধীন যুগের শেষ হয় এবং শুরু হয় মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার যুগ।

উত্তবঙ্গের কোন অঞ্চলে গােপাল তাঁর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা এখনাে ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। গােপালের উত্তর পুরুষদের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, তাঁর রাজ্য দক্ষিণে সমুদ্রতীর পর্যন্ত প্রসারিত ছিলাে। তবে উত্তর দিকে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলাে তা কেউ বলতে পারেন না। সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর রামচরিত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ‘বরেন্দ্রভূমি পাল রাজাদের আদিপুরুষদের ভূখণ্ড, সে কারণে বােঝা যায় বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার কোনাে একটা অংশ রাজা গােপালের অধীনস্ত ছিলাে। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন রাজা গােপাল রাজধানী স্থাপন করেছিলেন দেবকোটে। যা বর্তমানে বানগড় (অন্যনাম কোটিবর্ষ) নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে পালরাজাদের একাধিক রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুণ্ড্রবর্ধন ও গৌড়ে।

রাজা গােপালের মৃত্যুর পর তাঁর সতেরাে জন বংশধর বাংলাদেশে চারশত বছর রাজত্ব করেন। সুদীর্ঘ পাল শাসন এই বাংলার ইতিহাসের এক গৌরবময় যুগ। যাকে স্বর্ণযুগ বললেও ভুল হবে না। রাজা গােপালের পুত্র মহারাজাধিরাজ ধর্মপাল একজন দিগ্বিজয়ী নৃপতি ছিলেন। উত্তর ভারতের বিস্তৃত ভূখণ্ডে তিনি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গৌড় অধিপতি হিসেবে সমগ্র উত্তরবঙ্গ আপন রাজ্যধীন করেছিলেন। পাল নরপতি ধর্মপাল প্রায় চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। প্রজাকুল তাকে পরমসৌগত-মহারাজাধিরাজ উপাধি দিয়েছিলেন। ধর্মপালের পর তাঁর পুত্র দেবপাল শাসন ক্ষমতায় বসেন। দেবপাল ইতিহাস প্রসিদ্ধ। তিনি কলিঙ্গ ও কামরুপ রাজ্য জয়লাভ করেছিলেন। পিতার আদর্শে শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন ৪০ বছর।

দেব পালের নামানুসারে তার রাজধানীর নাম হয় দেবকোট। দেবপালের সময়েও করতােয়া ও পুণ্ডভুক্তির সীমারেখা ছিল। দেবপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহেন্দ্রপাল রাজধানী স্থানান্তর করে টঙ্গিল নদীর তীরে। অর্থাৎ বর্তমানে টাঙ্গন নদের তীরে কুদ্দালখাতক নামক স্থানে। এই মহেন্দ্রপাল সাত বছর ক্ষমতা পরিচালনা করেন।

মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর তাঁর সহােদর ভাই শূরপাল পাল সাম্রাজ্যের নরপতি হন। যিনি বিগ্রহ পাল নামেও পরিচিত। শূরপাল ছিলেন শান্তিপ্রিয় ও সংসার বিরাগী। বেশ কিছুদিন রাজত্ব করার পর তাঁর পুত্র নারায়ণ পালের উপর রাজ্যভার তুলে দেন। নারায়ণ পাল ৫৪ বছর রাজত্ব করেন। ধর্মপাল ও দেবপাল বাহুবলে যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা বিগ্রহ পাল ও নারায়ণ পালের ৫৪ বছরের রাজত্ব রক্ষা করতে পারেনি। নারায়ণ পালের রাজত্বকালেই পাল সাম্রাজ্য খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়ে। এমনকি বিহার ও বাংলাদেশের কোনাে কোনাে অংশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধমে বাইরের শত্রুরা দখল করে নেয়। ৯০৮ বঙ্গাব্দে নারায়ণ পালের মৃত্যু হলে তার পুত্র রাজ্যপাল ৯৪০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন এবং রাজ্যপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় গােপাল রাজ্য শাসন করতে থাকেন। দ্বিতীয় গােপাল ৯৬০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। এই সময়ের ভেতরে রাষ্ট্রকূট রাজ অমােঘবর্ষ, রাষ্ট্রকূট রাজ দ্বিতীয়, প্রতীহার রাজকৃষ্ণ, ইন্দ্র এইসব বহিঃশত্রুর আক্রমণে পাল সাম্রাজ্য নিদারুণ ধ্বংসের মুখে পড়ে।

পাল রাজা দ্বিতীয় গােপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহপাল ২৮ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বকালে উত্তরবঙ্গের উত্তরাঞ্চল আক্রমণকারী কম্বােজান্বয়ের দ্বারা অধিকৃত হয়। ঐতিহাসিক রাজেন্দ্রপাল মিত্র ও রমাপ্রাসাদ চন্দ্রের মতে বানগড়ে ধবংসাবশেষে যে প্রস্তর স্তম্ভ পাওয়া যায় সেখানের বিবরণ ৮৮৮ শকাব্দ পাওয়া যায়। আক্রমণকারী কম্বােজরাজ কোটিবর্ষ নগরীতে রাজত্ব স্থাপন করে সেখানে গৌড়ের রাজারূপে নিজেকে ঘােষণা করেন। তবে কারাে কারাে ধারণা কম্বােজরাজ রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের কাছ থেকে বৃহত্তর দিনাজপুরের অধিকাংশ অঞ্চল কেড়ে নেন। ফলে কম্বােজরাজের কারণে পাল সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল শিথিল হয়ে পড়েছিলাে।

আরো পড়ুন:  প্রাচীন বাংলার ইতিহাস হচ্ছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই হাজার বছর সময়

দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র মহীপাল বিলুপ্ত পিতৃরাজ্য উদ্ধার করেন। তিনি কম্বােজরাজ ও কম্বােজশত্রুদের যুদ্ধে পরাজিত করে বিতাড়িত করেন এবং কোটিবর্ষ থেকে মহাস্থানগড় পর্যন্ত ও বৃহত্তর দিনাজপুরে আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাল নরপতি মহীপাল ৯৮৮ শকাব্দে সিংহাসনের বসেন এবং বায়ান্ন বছর রাজত্ব করে পাল বংশের সৌভাগ্যকে পুনরায় আলােক উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। তার রাজত্বকালে বিদেশীয় আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে রাজ্য রক্ষার জন্য বারবার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। রাজা মহীপাল পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের রাজ-রাজেন্দ্র চোল বঙ্গদেশ আক্রমণ করলে মহীপাল সেই আক্রমণ প্রতিহত করেন। রাজা মহীপাল উত্তরবঙ্গের তথা গােটা বাংলার মানুষের গৌরবের বিষয় ছিল। মহীপালের পরে তাঁর পুত্র নয়াপাল রাজ্য-ক্ষমতায় বসেন। তিনি ১৬ বছর রাজত্ব করেন। তবে কলচুরিবাজ গাঙ্গেয়দেবের পুত্র লক্ষী কর্ণের সঙ্গে তাঁর সুদীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ হয়েছিল । যদিও পরে উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয় কিন্তু সন্ধি বেশিদিন স্থায়িত্ব পায়নি। নয়াপালের সময়েই বাঙালি বৌদ্ধপণ্ডিত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে ধর্মপ্রচারের জন্য গিয়েছিলেন।

নয়াপালের পর তাঁর পুত্র তৃতীয় বিগ্রহ পাল রাজ্য ক্ষমতার শাসনভার তুলে নিলেন। তৃতীয় বিগ্রহ পালের রাজত্বকালে আবার রাজা কর্ণ বঙ্গদেশে আক্রমণ করলেন। এই যুদ্ধে কর্ণ জয়লাভ করলেও বৈবাহিক সূত্রে উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি সম্পাদিত হয়। সুদীর্ঘকাল যুদ্ধের ফলে পাল রাজশক্তি ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ে। তৃতীয় বিগ্রহ পালের মৃত্যু সময়ে পাল সাম্রাজ্য বহিঃশত্রুর আক্রমণে ও অন্ত-বিপ্লবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তৃতীয় বিগ্রহপালের তিন পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল, দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপাল। পিতার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় মহীপাল রাজ্য ক্ষমতার বসেন।

পাল বংশের শেষ আঘাত আসে দ্বিতীয় মহীপালের সময় দিব্বোক কর্তৃক। কারণ দ্বিতীয় মহীপাল ক্রমশ একজন অত্যাচারী শাসক হয়ে উঠেছিলেন। তার ফলে দেখা দিলাে প্রজা-বিদ্রোহ। বরেন্দ্রে প্রজা-বিদ্রোহ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কৈবর্ত্যরাজ দিব্বোক।

তাঁর নেতৃত্বে প্রজাদের বিদ্রোহ ছিলাে ইতিহাসে সুসংগঠিত ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ। বরেন্দ্র ভূমির এই বিদ্রোহ পৃথিবীর প্রথম প্রজা-বিদ্রোহ। যা অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। দিব্বোক ছিলেন রাজা দ্বিতীয় মহীপালের নৌসেনাপতি এবং উচ্চ রাজকোষের একজন সুপরামর্শদাতা। তা সত্ত্বেও রাজা দ্বিতীয় মহীপাল দিব্বোকের সুন্দরী বােন চন্দ্রিমতিকে হরণ করে তার নীতপুরের প্রমােদভবনে নিয়ে যান। ফলে দিব্বোক খুব কষ্ট পান এবং বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। এদিকে রাজপ্রসাদের ভেতর চলছিলাে রাজ-ষড়যন্ত্র। দুষ্ট লােকের কু-পরামর্শে তার ভাই দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপালকে বন্দি করলেন। দিব্বোকের বিদ্রোহী মনােভাবকে দমন করার জন্য যুদ্ধ ঘােষণা করলেন। আর শীঘ্রই বরেন্দ্রের সামন্তবর্গ দিব্বোকের নেতৃত্বে অত্যাচারী রাজা দ্বিতীয় মহীপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলাে। ফলে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হলাে। এই যুদ্ধে রাজা দ্বিতীয় মহীপাল পরাজিত ও নিহত হলেন।

ফলস্বরূপ দিব্বোক রাজ-ক্ষমতা দখল করে স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন। এতে সমগ্র উত্তরবঙ্গ অত্যাচারী রাজা থেকে মুক্তি পেল। দিব্বোক বরেন্দ্র ভূমির অধীশ্বর হয়ে তার রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন। তাঁর নেতৃত্বে যে প্রজারা সংগঠিত হয়েছিলাে তা ছিলাে মূলত আর্থিক ও সাধারণ মানুষের প্রতি ভালােবাসা। তার এই মহৎ কাজের জন্য প্রজাগণ দিব্বোককে মহাপুরুষে উন্নীত করে এবং প্রতিবছর দিব্বোক স্মৃতি উৎসব পালন শুরু করে। কিন্তু কৈবর্ত রাজারা বেশিদিন রাজভােগ করতে পারেননি। দিব্বোকের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রুদ্রোক বরেন্দ্রের রাজা হন। রুদ্রোকের পর তাঁর পুত্র ভীম সিংহাসন বসেন। দ্বিতীয় মহীপালের পুত্র রামপাল পার্শ্ববর্তী রাজাদের সহযােগিতায় দিব্বোকের বরেন্দ্র জয়কে প্রতিহত করেন এবং ভীমকে পরাজিত করে পিতার সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। রামপাল ও ভীমের যুদ্ধে-ভীম নিহত হন। তবে রামপাল ও ভীমের যুদ্ধের কাহিনী ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার গেড়া গ্রামকে কেন্দ্র করে কিছু লােককথা প্রচলিত আছে। এই লােককথাটি হচ্ছে— ‘পালরাজা রামপাল বরেন্দ্র ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কৈবর্তরাজা ভীমের বিরুদ্ধে এই গেড়া গ্রামের আশপাশে থেকে প্রথম যুদ্ধ-যাত্রা সূচনা করেন। রামপালের সঙ্গে ভীমের যুদ্ধ যখন প্রবল রূপ ধারণ করেছে, সেই সময় ভুলবশত ভীম হাতির পিঠে চড়ে ছুটতে ছুটতে রামপালের সেনা ছাউনিতে চলে যান। যার ফলে অতি সহজে রামপালের সেনারা ভীমকে আটক করতে পারে। রাজা ভীমকে বন্দি হতে দেখে তার সেনারা পালাতে শুরু করে। ওই সময় ভীমের বন্ধু হরিবর্মণ পলায়ণরত সৈন্যদের সংগঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং সবাইকে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। যখন কোনােক্রমেই হরিবর্মণকে দমন করতে পারছে না রামপালের সৈন্যবাহিনী, তখন রামপাল কৌশল অবলম্বন করেন এবং তাঁর পুত্রকে দিয়ে প্রচুর অর্থ হরিবর্মণকে দিয়ে হাত করেন। যার ফলে ভীম বাহিনীর পরাজয় হয়। এই যুদ্ধে রামপালের সেনারা ভীমের চোখের সামনেই তার পরিবারবর্গকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং শেষে অসংখ্য তীরের আঘাতে তাকেও হত্যা করে।

আরো পড়ুন:  বঙ্গ দেশের পশ্চিমদিকের ভূখণ্ডটি পশ্চিমবঙ্গ যা বর্তমানে দিল্লির অধীন একটি অঙ্গরাজ্য

রামপাল পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধারের পর নিজ নামেই রামাবতীতে রাজধানী স্থাপন করেন। রামপালের মৃত্যুর পর পুনরায় পাল সাম্রাজ্য পতন শুরু হয়। রামপালের পর তাঁর পুত্র কুমার পাল রাজ্য ক্ষমতার বসেন এবং সে সময় পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার পালশাসন অব্যাহত ছিলাে।

কিন্তু কুমার পালের মৃত্যুর পর পালবংশের পরিণতি আরাে করুন হয়ে পড়ে। কুমার পালের পর তাঁর পুত্র তৃতীয় গােপাল রাজ-ক্ষমতা হাতে নেন। তিনি স্বল্পসময় রাজত্ব করে তাঁর পিতৃব্য মদন পালকে সিংহাসনে বসান। মদন পালই ছিলেন পালবংশের শেষ নরপতি।

পাল রাজাদের চার’শ বছরের আধিপত্য বঙ্গদেশের ইতিহাসে নানান দিক থেকে গভীর ও ব্যাপক অর্থ বহন করে। ষষ্ঠ শতকের শেষ এবং সপ্তম শতকের গােড়া থেকে বাংলাদেশ উত্তর ভারতের উত্তরঙ্গ স্রোতে ঝাঁপ দিয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক জীবনে নিজের একটি বিশিষ্ট স্থান করে নেয়। অষ্টম ও নবম শতকের দীর্ঘকাল ধরে যে তিনটি রাষ্ট্রশক্তি সারা ভারতে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্যে লড়েছিল, তার মধ্যে একটির কেন্দ্র ছিল পাল আমলের বাংলাদেশ।[৩] অন্য দুটি ছিল গুর্জর-প্রতিহার ও রাষ্ট্রকুট শক্তি।

বাংলায় পাল শাসন বার বার হাতছাড়া হলেও পুনরুদ্ধার করতে বেশি সময় লাগেনি। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলার ও বাঙালি জাতির গোড়াপত্তন হয় পাল যুগেই। এই যুগই ছিলাে প্রথম বৃহত্তর সামাজিক সমীকরণ ও সমন্বয়ের যুগ। বাঙালির স্বদেশ ও সৌজন্যবােধের মূল যে সামগ্রিক ঐক্যবােধ পাল সাম্রাজ্যের সময়েই গড়ে ওঠে, এটাই বাঙালি জাতীয়ত্বের ভিত্তি এবং পাল সাম্রাজের সর্বশ্রেষ্ঠ দান। পাল আমলের পতনের ভেতর দিয়ে বাংলায় ধ্রুপদী স্বাধীন যুগের শেষ হয় শুরু হয় মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার যুগ।

তথ্যসূত্র:

১. পাটোয়ারী মমতাজউদ্দীন, আকতার শাহীনা, ও ইসলাম মো. জাকিরুল. বাংলাদেশ স্টাডিজ. “প্রাচীন বাংলার ইতিহাস”, ঢাকা , বাংলাদেশ: বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়. প্রকাশকাল ২০১৪, পৃষ্ঠা ১।
২. অজয় কুমার রায়, ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস, টাঙ্গন, দ্বিতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫-১৬।
৩. সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বাঙালীর ইতিহাস, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলকাতা, জুন ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১৯৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!