
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত যে গণযুদ্ধে অংশ নিয়ে স্বাধীন হয় তা বাংলাদেশের গণযুদ্ধ (ইংরেজি: Peoples War of Bangladesh) বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি হচ্ছে একটি শোষণমূলক নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের পূর্বে বাংলাদেশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীন ছিলো এবং তখন এটিকে বলা হত পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিরোধীতা বৃদ্ধি পাবার ফলে ১৯৭১ সালে গণঅভ্যুত্থান ও গণযুদ্ধ দেখা দেয়, পরিণামে পূর্ব পাকিস্তানের জায়গায় সৃষ্টি হয় নতুন রাষ্ট্র — বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ বিধায় সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতক থেকে ক্রমান্বয়ে ইউরোপের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ দখল এবং শাসনের অধীনে এসেছিল। ভারতবর্ষের প্রধান দখলদারি ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল ইংল্যান্ড। ১৭৫৭ সালে পলাশীতে ইংরেজদের হাতে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও নিহত হওয়ার ঘটনাকে ভারতবর্ষের প্রত্যক্ষভাবে ইংল্যান্ডের শাসনাধীনে যাওয়ার একটি তারিখ বলে উল্লেখ করা হয়।
সময় ও ক্রমবিকাশে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন অল্প থেকে অধিকে নানা ঘটনা ও আন্দোলনের মাধ্যমে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু এই আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ শক্তির ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন ধর্মে বিভক্ত সমাজের জটিলতা ক্রমান্বয়ে, বিদেশী শক্তির প্ররোচনা, সহায়তা এবং বিকাশমান ভারতীয় ধনিক সমাজ, যাদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াও কার্য্কর ছিল, তাদের দুর্বলতায় প্রবল হয়ে উঠে। ভারতের ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়সমূহের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায় মুসলমান সমাজের উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত নেতৃবর্গ মুসলমান সমাজের অধিকারের কথা এবং ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের পর থেকে মুসলমান রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করতে থাকেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ইংরেজ শক্তি ১৯৪৭ সনে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তাদের ভারত ত্যাগের ভিত্তি হয় মুসলিম ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি আলাদা শোষণমূলক নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রের পত্তন।
কিন্তু আধুনিককালে কোনো ধর্মের ভিত্তিতে, বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রধান দুটি অংশ হলো পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতায়, একটি সঙ্গতিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে রক্ষা করার প্রয়োজনীয় নীতি ও কাঠামোগত ক্ষমতা সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বপ্রধান পাকিস্তানের ছিল না। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সংকীর্ণ এবং পূর্ববঙ্গের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও নীতির কারণে পূর্ববঙ্গে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ ১৯৫২ সনের রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের পর থেকে তীব্রতর হতে থাকে। গোড়া থেকে স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যভাবে উচ্চারিত না হলেও ষাটের দশকে স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তসানের কথা বিভিন্নভাবে আসতে থাকে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের অনুভূতিকে দমনমূলক ব্যবস্থা দ্বারা নিবৃত্ত করতে চায়। পালাক্রমে সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং ১৯৫৬ সনের সংবিধানও বাতিল করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তারিত বিবরণ এখানে প্রদান সম্ভব নয়। ১৯৬৯ সনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সর্বত্র, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে, গণজাগরণ শুরু হয়। এই গণজাগরণই কালক্রমে ১৯৭১ সনে নানা ঘটনা এবং বিশেষ করে পাকিস্তান সরকারের সামরিক আক্রমণ এবং গণহত্যার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ গ্রহণ করে।
১৯৭১ সনের ২৫ শে মার্চ আপস-আলোচনা ভেঙ্গে দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ব্যাপক আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হন। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। মার্কিন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার না করায়, গণহত্যা অব্যাহত রাখায় এবং পরিশেষে ভারতের উপর আক্রমণ করায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ডিসেম্বর ৭১ এ আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়।
১৬ ডিসেম্বর তারিখে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর নিকট পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় এক লক্ষ পাকিস্তানী সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটে। ভুটান, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত অপরাপর অনেক রাষ্ট্র ডিসেম্বর ১৯৭১ এবং জানুয়ারি ১৯৭২ সময়ের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২১৫-২১৭।