স্বাদুপানির কুমির বা মিঠা পানির কুমির বাংলাদেশে সংরক্ষিত প্রজাতি

ভুমিকা: স্বাদুপানির কুমির বা মিঠা পানির কুমির ক্রোকডাইলুস গণের মাংসাশী শিকারি প্রজাতি। এদের লেজ পেশীবহুল। এটি বাংলাদেশে বিলুপ্ত।

বৈজ্ঞানিক নাম: Crocodylus palustris Lesson, 1834 প্রতিনাম: জানা নেই। ইংরেজি নাম: Freshwater Crocodile, Marsh Crocodile, Mugger স্থানীয় নাম: স্বাদুপানির কুমির জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্য: Animalia বিভাগ: Chordata অবিন্যাসিত: Reptilia বর্গ: Crocodilia পরিবার: Crocodylidae গণ: Crocodylus প্রজাতির নাম: Crocodylus palustris.

বর্ণনা: মিঠা পানির এই কুমিরের তুন্ড প্রশস্ত, মাথার সম্মুখভাগ অবতল, চোখের সামনে কোনো খাজ থাকে না; প্রাপ্তবয়স্ক কুমিরের দৈর্ঘ্য ৩-৫ মিটার। দেহ ধূসর থেকে বাদামী রঙের বা উপরিভাগ গাঢ় জলপাই রঙের, সাধারণত কোনো গাঢ় ব্যান্ড থাকে না, দেহের অঙ্কীয়ভাগ সাদা বা হলদে সাদা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক কুমির হালকা তামাটে বা বাদামী রঙের এবং গাঢ় আড়াআড়ি ব্যান্ড থাকে এবং দেহ ও লেজে কালো দাগ থাকে।

দেহের বর্ম মজবুত, এদের চারটি নুকাল প্লেট বর্গাকৃতিভাবে সাজানো থাকে তবে উভয়টি ছোট। মিঠাপানির কুমিরের এই বৈশিষ্টের মাধ্যমে লোনাপানির কুমির C. porosus থেকে পৃথক; occiput এর পিছনে দুই জোড়া অপেক্ষাকৃত ছোট নুকাল আড়াআড়ি সিরিজে সাজানো থাকে। দেহ কান্ডের ১৩-১৭ সারি আঁইশ আড়াআড়িভাবে এবং ৪-৬ সারি আঁইশ অনুদৈর্ঘ্য সারিতে সাজানো থাকে; পৃষ্ঠীয় অস্থিযুক্ত অংশ অপর একটি তির্যক সারির আঁইশের সাথে যুক্ত থাকে। এই ধরনের কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট স্কুট পার্শ্বদেশে অনিয়মিতভাবে সাজানো থাকে। আঙ্গুল শীর্ষ পর্যন্ত লিপ্তপদ থাকে না। ভিতরের দুইটি আঙ্গুলে অর্ধেক লিপ্তপদ থাকে । উপরের চোয়ালে ১৭-১৯টি ধারালো দাঁত থাকে এবং নি-চোয়ালের উভয় পার্শ্বে ১৪-১৫টি দাঁত থাকে মোট দাঁতের সংখ্যা ৬৬-৬৮টি (Daniel, 1983; Tikader, 1983; Sharma, 1994)

স্বভাব ও আবাসস্থল: C. palustris ধীরগতি সম্পন্ন কুমির এরা নদী, পুকুর, ড্যাম, সংরক্ষিত জলধারসহ স্বাদুপানিতে বাস করে। এরা জোয়ার ভাটার এলাকা থেকে দূরে থাকে, ৪-৫ মিটার গভীর পানিতে বাস করতে অধিকতর পছন্দ করে । এরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে। তবে পুরুষ কুমির প্রজননের সময় একাকী বাস করে। এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল শুকিয়ে গেলে এরা মাটির নিচে অবস্থান করে বা অন্যকোনো আবাসস্থলে চলে যায়। এরা সক্রিয়ভাবে সাঁতার কাটতে পারে, সাধারণত জলাশয়ে ধীরে/নদীর তীরে বড়। কুমির রোদ পোহায়।

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশের গিরগিটি, টিকটিকি, তক্ষক, অঞ্জন, আচিল ও গুইয়ের তালিকা

এরা অন্যান্য কুমিরের মতো প্রধান খাদ্য হিসেবে মাছ গ্রহণ করে তবে জলাশয়ে বসবাসকারী পাখি ও অন্যাণ্য মেরুদন্ডী প্রাণী গ্রহণ করে। সদ্য পরিস্ফুটিত কুমির খাদ্য হিসেবে জলজ কীটপতঙ্গ ও মাছের পোনা গ্রহণ করে। এরা সাধারণত শব্দ করে না তবে বিপদের সম্মুখীন হলে উচ্চ স্বরে হিসহিস শব্দ করে। এদের যৌন মিলন নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি তবে যৌনমিলনের জন্য বেশি পুরুষ কুমির বেশি সক্রিয় থাকে এবং একটি পুরুষ কুমির কয়েকটি স্ত্রী কুমিরের সাথে যৌন সঙ্গম করতে পারে। এদের সঙ্গম ক্রিয়া পানিতে সম্পন্ন হয়।

স্ত্রী কুমির ডিম পাড়ার পূর্বে রাতে গর্ত খনন করে। এরা গর্তের ভিতরে বাসা তৈরী করে, বাসা ৩৫-৫০ সেমি গভীর, ১০-৫০টি গভীর ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ও আকৃতি স্ত্রী কুমিরের দেহের আকৃতির উপর নির্ভর করে। ডিমের পরিমাপ ৪-৫ সেমি ৬-৮ সেমি, ওজন ৮০-১২০ গ্রাম। কুমির বাসায় প্রকোষ্টের মুখ প্রশস্ত এবং কলসী আকৃতির, । এরা জলাশয়ে খাড়া কিনারা থেকে কিছুটা দূরে গর্ত খনন করে । ফেব্রুয়ারী-এপ্রিল মাসে ডিম পাড়ে। কুমির বাসার তাপমাত্রা ৩০-৩৫ সেমি, পরিস্ফুটনকাল ৫০-৬৫ দিন। স্ত্রী কুমির দেহ থেকে পানি বের করে বা মূত্র ত্যাগ করে বাসার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। সদ্য পরিস্ফুটিত কুমিরের বাচ্চা বাসা থেকে পানিতে মুক্ত হওয়ার জন্য মাতৃ QIUSIPIS Lesson  কুমিরকে প্ররোচিত করার জন্য ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে। সদ্য পরিস্ফুটিত কুমিরের বাচ্চার দৈর্ঘ্য ২৫-৩০ সেমি এবং ওজন ৬-১০০ গ্রাম (Tikader, 1983; Sharma, 1998)।

বিস্তার: ইরান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল এবং শ্রীলংকা।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব: দর্শনার্থীদের মনোমুদ্ধ করার জন্য কুমির চিড়িয়াখানায় রাখা হয়। কুমিরের উদরের ত্বক চামড়া শিল্পে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ।

বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা: এদের বন্য ডিম এবং সদ্য পরিস্ফুটিত কুমিরে বাচ্চাকে বেজি, পুঁইসাপ এবং শিয়াল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।

মন্তব্য: Crocodylus শব্দের উৎপত্তি হলো গ্রীক শব্দ krokodeilos salaam “pebble worms” (kroko = নুড়ি; deilos = কৃমি বা মানুষ) কুমিরের দেহের অবয়ব। ল্যাটিন শব্দ palustris মানে “marshy” of “swampy” এজন্য এরা “Marsh Crocodile” নামে পরিচিত। হিন্দি ভাষায় ‘mager’ মানে দূর্নীতি সেজন্য “water monster” পরিচিত।[১]

আরো পড়ুন:  ঘড়িয়াল বাংলাদেশসহ পৃথিবীর মহাবিপন্ন সরীসৃপ

বাংলাদেশে মিঠা পানির কুমিরের বর্তমান অবস্থা:

স্বাদুপানির এই কুমির বাংলাদেশে বিলুপ্ত ঘোষিত। ১৯৬২তে শেষবার বাংলাদেশে এই কুমির দেখা গেছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে এই প্রজাতির কুমির বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। মাঝে মাঝে বাংলাদেশে এই কুমির ধরা পড়ে। বিবিসি নিউজ বাংলা জানায়, ২৩শে অক্টোবর ২০১৫ একটি কুমির মাগুরা জেলার মধুমতি নদীতে ধরা পড়ে।[২] ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে বিকেলের দিকে পদ্মা নদীর কোলে জেলেদের জালে একটি কুমির ধরা পড়ে।[৩] এছাড়াও রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় একটি কুমির ধরা পড়ে গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে।[৪]

এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে কিছুসংখ্যক সাফারী পার্ক এবং খান জাহান আলীর মাজারে বন্দী দশায় পালন করা হচ্ছে। এই প্রজাতির কুমির CITES-এর পরিশিষ্ট-১ এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র:   

১. সুপ্রিয় চাকমা (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: উভচর প্রাণী ও সরীসৃপ, খণ্ড: ২৫ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ১৯৫-১৯৬।
২. বিবিসি বাংলা, ১৭ নভেম্বর ২০১৫, “মধুমতিতে বিলুপ্ত মিঠা পানির কুমিরের সন্ধান”, https://www.bbc.com/bengali/news/2015/11/151117_bd_crocodile
৩. ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, “পাবনায় পদ্মা নদীতে আবারও মিললো মিঠা পানির কুমির”, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বাংলানিউজ ২৪ডট কম, ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ, https://www.banglanews24.com/climate-nature/news/bd/700845.details
৪. নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, দৈনিক প্রথম আলো, “পুকুরে ছিল এত্ত বড় কুমির”, https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1615640/

Leave a Comment

error: Content is protected !!