বাংলাদেশের মহাবিপন্ন কচ্ছপ, কাইট্টা ও কাছিম এবং বন বিভাগের উদ্ধার কার্যক্রম

বাংলাদেশের মহাবিপন্ন কচ্ছপ প্রজাতিগুলোর প্রায় সবগুলোই বিপন্ন এবং বিলুপ্তির পথে রয়েছে। বাংলাদেশে কচ্ছপ, কাইট্টা ও কাছিম আছে প্রায় ২৯ প্রজাতির। দেশের জলাভূমির আশপাশের আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে কচ্ছপের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, কাইট্টা ও কাছিম থাকলেও বেশির ভাগ প্রজাতি এখন মহাবিপন্ন ও বিপন্ন প্রাণীর লাল তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে সব প্রজাতির কচ্ছপ, কাইট্টা ও কাছিম বিপণন ও ব্যবসায় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি বাংলাদেশের বিদ্যমান বন্যপ্রাণী আইনেও সব প্রজাতির কচ্ছপ, কাইট্টা ও কাছিম ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ একশ্রেণীর অর্থলোভী মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতিবান্ধব কচ্ছপ, কাইট্টা ও কাছিম নিধন করে চলেছে। মানুষের মধ্যে গণ-সচেতনতার অভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখনো কাছিম শিকার অব্যাহত রয়েছে।

কচ্ছপ, কাইট্টা ও কাছিম পানিতে পচা বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর দেহাবশেষ খেয়ে পানিদূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করে থাকে। এর ফলে দেশের জীববৈচিত্র্য সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দেশের জলাভূমির আশপাশের আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে এদের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে পড়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কচ্ছপ ও কাছিম নিধন বন্ধের জন্য সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কচ্ছপ ও কাছিম রক্ষায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় সামগ্রিক অর্থেই গোটা পরিবেশ-প্রতিবেশ হুমকির মুখে পড়বে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সাধারণ মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য মিডিয়াকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

ইদানিং বিভিন্ন স্থান থেকে বনবিভাগের কর্মকর্তাগণ ও প্রশাসন কচ্ছপ উদ্ধার করে পুনরায় নদীতে অবমুক্ত করছেন যা শুভ লক্ষণ। ২৬ এপ্রিল, ২০১২ ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার করে আনা ১৫৫টি কচ্ছপ যশোরে আটক করেন বন বিভাগ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। ২৭ এপ্রিল ঢাকার বন সংরক্ষকের দপ্তর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কচ্ছপগুলো যশোরের বেনাপোল সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে পাচার করা হয়। পরে বেনাপোল থেকে কচ্ছপের চালানটি কাভার্ড ভ্যানে করে যশোর শহরের জুমজুম এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। খবর পেয়ে বিজিবি ও বন বিভাগ ওই কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে কচ্ছপবোঝাই কার্টন তিনটি আটক করে। তবে অভিযানের আগেই পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। কচ্ছপগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকার আগারগাঁওয়ে বন ভবনে নিয়ে আসা হয়।[১]

আরো পড়ুন:  কচ্ছপ বিক্রির দায়ে রাজধানীতে ৩ জনের ৯ মাসের কারাদণ্ড

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, আটক কচ্ছপগুলোর মধ্যে ৮৭টি শিলা ও ৬৮টি কালিকাইট্টা প্রজাতির। এই দুটি বাংলাদেশে বিপদাপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে। এসব প্রজাতির আবাসস্থল গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পাহাড়ি এলাকায়।

এছাড়া ১৬ এপ্রিল, ২০১২ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৪০৬টি বিরল প্রজাতির কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়। পরে সেগুলো গাড়িযোগে কক্সবাজারের সাফারি পার্কে অবমুক্ত করা হয় ১৮ এপ্রিল তারিখে।[২] সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ সিএইচটিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানায় জানায়, ‘বিমান বন্দর থেকে উদ্ধার হওয়া কচ্ছপের মধ্যে ২৮৮টি কচ্ছপ পার্কে অবমুক্ত করার জন্য বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে সড়ক পথে গাড়িযোগে পার্কে পাঠান। অবমুক্ত করার সময় জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেছে ছোট, বড় ও মাঝারি সাইজের ২৮৪টি কচ্ছপ। মারা গেছে ৪টি।’

এছাড়া গত এপ্রিল ১৩, ২০১২ তারিখ রাতে বিপন্ন প্রাণী রক্ষার অংশ হিসেবে বরিশালের আগৈলঝাড়ায় প্রায় দুইশ বছরের পুরনো কচ্ছপ মেলা বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর ডট কম তাদের খবরে জানায় “স্থানীয় বাসিন্দা সুধন্য জয়ধর (৮০) জানান, বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে আগৈলঝাড়া উপজেলার পয়সারহাট নদীর পাড়ের ত্রিমুখী বাজারে এই কচ্ছপ মেলা হয়ে আসছে বহুদিন ধরে। এবারও শনিবার সকালে মেলা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিক্রেতারা।[৩]

কিন্তু পরিবেশ ও বিপন্ন প্রাণী রক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে শুক্রবার থেকেই কচ্ছপ কেনাবেচা বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করে আগৈলঝাড়া ও কোটালীপাড়া বন বিভাগ। তারপরও প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপের পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। সন্ধ্যার পর স্থানীয় প্রশাসন মেলা ভেঙে দিয়ে বিপুল পরিমান কচ্ছপ উদ্ধার করে নদীতে ছেড়ে দেয়।

খুলনা বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. জামাল হোসেন, কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান, গৌরনদী বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন তালুকদার, আগৈলঝাড়া বন বিভাগের কর্মকর্তা কেবিএম ফেরদৌস, কোটালীপাড়া বন বিভাগের কর্মকর্তা বিবেকানন্দ মল্লিক ও রামশীল ইউপি চেয়ারম্যান খোকন বালা এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

জামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তৃতীয় তফসিলের চতুর্থ ধারায় কচ্ছপ ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করে বিভিন্ন দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ওই আইন অনুযায়ীই বন্ধ করা হয়েছে ত্রিমুখী বাজারের কচ্ছপ মেলা। তবে মেলা বন্ধ করতে গিয়ে তাদের কচ্ছপ বিক্রেতা ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দাদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে বলে জানান তিনি।

আরো পড়ুন:  বিশ্বে ক্রমাগত বায়ুচালিত টারবাইন দ্বারা বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে

ত্রিমুখী বাজারের সুধন্য জয়ধর বলেন, হিন্দু অধ্যুষিত এই এলাকার রেওয়াজ অনুযায়ী নববর্ষের প্রথম দিনে মেয়ের জামাই, নাতি-নাতনীসহ আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়। তাদের জন্য রান্না হয় কচ্ছপের মাংস। 
এই রেওয়াজ থেকেই বহু আগে ত্রিমুখী বাজারে শুরু হয়েছিল কচ্ছপ মেলা। আশেপাশের কোদালধোয়া, আন্ধারমানিক, বাটরা, বাহাদুরপুর, বাকাল, জলিরপাড়, পয়সারহাট, বড়মগরাসহ কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল, ভেন্নাবাড়ি, কদমবাড়ী, বান্ধাবাড়ি ও মাদারীপুর জেলার কালকিনি থেকেও অনেকে কচ্ছপ কিনতে আসতেন এ মেলায়।”

এছাড়াও গত বছর ২৬ অক্টোবর ২০১১ তারিখে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকা থেকে পুলিশ বিপুল কাছিম উদ্ধার করেছিল। উদ্ধার করা এসব কাছিমের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলো সুন্ধি জাতের কাছিম। সেসময় আগারগাঁও বন বিভাগ গোপন সূত্রের ভিত্তিতে কোতোয়ালি থানা পুলিশের সহযোগিতায় পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬১টি বিভিন্ন প্রজাতির কাছিম উদ্ধার করেছিল। আগারগাঁও বন ভবনের বন সংরক্ষক ড. তপনকুমার দে ও ঢাকা বন্যপ্রাণী বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল। উদ্ধার করা এসব কাছিম গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের উন্মুক্ত জলাশয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।[৪]

এই দুটি উদ্ধার ছাড়াও গত ২০ জুন ২০১১ তারিখে পটুয়াখালী থেকে ২৯টি, ২৩ মে ২০১০ তারিখে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ৪৬০টি, ০৮ ডিসেম্বর ২০১১ খুলনা থেকে উদ্ধার করা হয় ১০৩টি, ২৬ মার্চ ২০১২ বেনাপোল থেকে ২০০টি, কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়েছিল। আমরা প্রশাসনের এসব পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই এবং দাবি জানাই সমস্ত কচ্ছপের আবাসস্থল রক্ষা করার।

এছাড়া  ৯ জানুয়ারি, ২০১৪-এর আরেক খবরে জানা যায়, ৮ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, রাজশাহী-এর উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মহানগরীর নিউমার্কেট এলাকা থেকে বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ছয়টি দেশি কড়িকাইট্টা (Assam Roofed Turtle, বৈজ্ঞানিক নাম : Pangshura tecta) ও ছয়টি বিদেশী প্রজাতির কচ্ছপসহ (সনাক্তকরণ সম্ভব হয়নি) মোট ১২টি কচ্ছপ উদ্ধার করে।

১৩ জানুয়ারি, ২০১৪ সিরাজগঞ্জের তাড়াশে ৭০টি কচ্ছপসহ তিন ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। আটকের পর বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে তাদেরকে ১ বছর করে কারাদন্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমান আদালত। পরে বন বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল আলমকে সংগে নিয়ে কচ্ছপগুলো চলনবিলে অবমুক্ত করা হয় বলে এক খবরে বাংলানিউজ জানিয়েছে।

আরো পড়ুন:  মাছ ধরার কারেন্ট জাল হত্যা করছে মাছ, পাখি, প্রকৃতির অন্যান্য জীবন্ত উপাদান

১৫ ডিসেম্বর, ২০১৪ ঢাকার বিমানবন্দর থেকে ৫১০টি কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়েছে। বন বিভাগের দাবি, উদ্ধার হওয়া কচ্ছপের বাজারমূল্য সোয়া ১০ লাখ টাকা। গত ৫ মে ২০১৫ তারিখে যশোরের বেনাপোল সীমান্তের কাছ থেকে ৩৬১টি বিরল প্রজাতির কচ্ছপ উদ্ধার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ_বিজিবির সদস্যরা। উদ্ধারকৃত কচ্ছপের বাজারমূল্য ১৯ লাখ টাকা বলে জানায় বিজিবি এবং এ খবর প্রকাশ করে বাংলানিউজ ডট কম

এখনো চলে প্রতিবছর কচ্ছপের মেলা। এরকম একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে ইত্তেফাকে গত ৭ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে রাজাপুরের ত্রিমুখীতে কচ্ছপের মেলায় শিরোনামে।[৫] 

তথ্যসূত্র:

১ নিজস্ব প্রতিবেদক, “ফলের কার্টনে ১৫৫টি কচ্ছপ” দৈনিক প্রথম আলো, ২৮ এপ্রিল ২০১২, সারাদেশ, http://archive.prothom-alo.com/detail/date/2012-04-28/news/253659.

২. শাহীন রহমান, দৈনিক জনকণ্ঠ, “হুমকির মুখে কাছিম, আইন অমান্য করেই চলছে নিধন“, ১০ নভেম্বর ২০১২, http://oldsite.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=27&dd=2012-11-10&ni=115091

৩ নিজস্ব প্রতিবেদক, আগৈলঝাড়ায় দুইশ বছরের পুরনো কচ্ছপ মেলা বন্ধ” এপ্রিল ১৩, ২০১২, http://www.bdnews24.com/bangla/details.php?id=191248&cid=2

৪ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, ২৭ অক্টোবর, ২০১১, শাঁখারীবাজার থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ৬১টি কচ্ছপ উদ্ধার, http://archive.prothom-alo.com/detail/news/197042.

৫ সীমান্ত দীপু, দৈনিক ইত্তেফাক, ৭ এপ্রিল ২০১৭, “রাজাপুরের ত্রিমুখীতে কচ্ছপের মেলায়” http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/ittefaq-shamoeki/2017/04/07/187348.html

রচনাকালঃ এপ্রিল ১৪ ২০১২

Leave a Comment

error: Content is protected !!