নীল অপরাজিতা ভেষজ ও টবে চাষযোগ্য শোভাবর্ধক লতানো ফুল

ভূমিকা: নীল অপরাজিতা (বৈজ্ঞানিক নাম: Clitoria ternatea ইংরেজি: Butterfly Pea)  ফেবাসি পরিবারের ক্লিটোরিয়া গণের বীরুৎ।

বাগানের শোভাবর্ধনের জন্যের লাগানো হয়। এরা হচ্ছে একটি আলংকারিক লতা জাতীয় উদ্ভিদ যেগুলো প্রায় ২০ ফুট লম্বা হয়।

সারা বছরই ফুল ফোটে। প্রতিটি পাতায় দুই বা তিন জোড়া গোলাকার পাতা থাকে। অনেকটা বক ফুলের মতো দেখতে তবে ফুলে কোনো গন্ধ নেই।

এই গাছের মূল বা শেকড় তিতা। এদেশে সাদা, নীল ও কদাচিৎ বেগুনী রংয়ের ফুলের অপরাজিতা আমরা দেখতে পাই; এই নীল অপরাজিতার দুই স্তবকের পাপড়ির ফুলও দেখা যায়।

বৈজ্ঞানিক নাম: Clitoria ternatea L., Sp. Pl. 2: 753 (1735). ইংরেজি নাম: Asian pigeonwings, bluebellvine, blue pea, butterfly pea, cordofan pea and Darwin pea. স্থানীয় নাম: অপরাজিতা। জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্য: Plantae. বিভাগ: Angiosperms. অবিন্যাসিত: Eudicots. বর্গ: Fabales. পরিবার: Fabaceae. গণ: Clitoria. প্রজাতি: Clitoria ternatea.   

নীল অপরাজিতা-এর বর্ণনা:

অপরাজিতা বহুবর্ষজীবী লতানো বীরুৎ। এদের কান্ড বেলনাকার, মোটামুটি রোমশ। পত্র সচূড় পক্ষল। পত্রক ৫-৭টি, অর্ধচর্মবৎ, উপবৃত্তাকার-আয়তাকার, স্থূলা, রোমহীন বা স্বল্প খাটো চাপা রোমশ, সূক্ষ্মাগ্র, গোড়া স্থূলাগ্র বা সূক্ষ্মাগ্র, উপপত্র লম্বা, রেখাকার, সূক্ষ্মাগ্র, উপপত্রিক সূত্রাকার।

পুষ্প কাক্ষিক, একল, পুষ্পবৃন্ত লম্বা, মঞ্জরীপত্র ৪-৫ মিমি লম্বা, রেখাকার, মঞ্জরীপত্রিকা প্রায় ৭ মিমি লম্বা, প্রায় গোলাকার, স্থূলাথ। বৃতি ১.২-১.৬ সেমি লম্বা, দন্তক বল্লমাকার, নল থেকে খাটো।

দলমন্ডল লম্বা, ধ্বজক উজ্জ্বল নীল বা সাদা। পুংকেশর দ্বিগুচ্ছক, ৯+১, ধ্বজকীয় পুংকেশর মুক্ত। গর্ভাশয় রোমশ, গর্ভদন্ড সরল। ফল পড, চ্যাপ্টা, প্রায় খাড়া, চোখা চক্ষুযুক্ত, হালকা রোমশ।[১]

ক্রোমোসোম সংখ্যা:

২n = ১৪, ১৫, ১৬[২]

নীল অপরাজিতা-এর বংশ বিস্তার ও চাষাবাদ:

গন্ধহীন ফুল এই অপরাজিতার। কোনো কোনো জাতের ফুলের গঠন প্রজাপতির আকৃতির। বীজ থেকে অপরাজিতার চারা জন্মে। ফুল ও ফল ধারণ জুন থেকে মার্চ।

এটি দীর্ঘজীবী হলেও বর্ষজীবী হিসাবে জন্মানো যায়। প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। শোভাবর্ধক উদ্ভিদরূপে আবাদী।[৩]

পাশ্চাত্য উদ্ভিদ বিজ্ঞানীগণ বলেন—এই অপরাজিতা ফুলের বীজ আনা হয়েছে টারনেট (Ternete) থেকে, এই টারনেটি মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত। এটি টারনেটি থেকে আনা হয়েছিলো বলেই এই লতা গাছটির প্রজাতির নাম রাখা হয়েছে ternatea (টারনেটিয়া)।

আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২-এ লিখেছেন যে, সেই গাছ নীলপুষ্প অপরাজিতার বীজ আনা হয়েছিল কি না তা নিশ্চিত নয়, কারণ যজুর্বেদে দেখা যাচ্ছে, শ্বেত পুষ্প অপরাজিতার উল্লেখ এবং তার গুণাগুণের বর্ণনা;

তবে মালাক্কা সে যুগের জম্বুদ্বীপের বৃহত্তম ভারতের অন্তর্গত ছিল কিনা জানি না। যা হোক, এই অপরাজিতা গাছে বারোমাসই ফল হয়, তবে কম বেশী;

তবে এটা লক্ষ্য করা গেছে, নীল ফসলের গাছ যত তাড়াতাড়ি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে, শ্বেত পুষ্প লতাগুলি সেটা করে না। এর ফুলগুলি শিমের মত চেপ্টা, চওড়া সিকি ইঞ্চিরও কম আর লম্বা দেড় থেকে দুই ইঞ্চি বীজে গাছ হয়।[৪]

বিস্তৃতি:

গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলিতে বিস্তৃত। বাংলাদেশে সমগ্র জেলায় পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও ভেষজ গুণ:

অপরাজিতায় রয়েছে নানা ভেষজ গুণ। মূল তিক্ত, স্নিগ্ধকারক, বিরেচক, রেচক ঔষধ এবং মূত্রবর্ধকরূপে ব্যবহৃত হয়। বীজ রেচক ঔষধ বা বিরেচক।

আগুনে ঝলসানো বীজের পাউডার শোথ রোগ, পাকস্থলীর আন্ত রযন্ত্রের স্ফীতাবস্থা, দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা, গলার ক্ষত, টিউমার এবং চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত (Ghani, 2003)।

পাতার রস লবণের সাথে মিশ্রিত করে কান ব্যাথা নিমূলে প্রয়োগ করা হয়। মূল, কান্ড এবং পুষ্প সাপের কামড় এবং পোকার হুল ফোটানোতে ব্যবহৃত হয় (Kirtikar et al., 1935)

নীল অপরাজিতা-এর অন্যান্য তথ্য:

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ৭ম খণ্ডে (আগস্ট ২০১০)  অপরাজিতা প্রজাতিটির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের শীঘ্র কোনো সংকটের কারণ দেখা যায় না এবং বাংলাদেশে এটি আশঙ্কামুক্ত হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশে অপরাজিতা সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। প্রজাতিটি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই প্রজাতিটির বর্তমানে সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই।

তথ্যসূত্র:

১. এ টি এম নাদেরুজ্জামান (আগস্ট ২০১০)। অ্যানজিওস্পার্মস ডাইকটিলিডনস”  আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; হাসান, মো আবুল; বেগম, জেড এন তাহমিদা; খন্দকার মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ৮ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ২৫-২৬। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

২. Kumar, V. and Subramaniam,, B. 1986 Chromosome Atlas of Flowering Plants of the Indian Subcontinent. Vol.1. Dicotyledons Botanical Survey of India, Calcutta. 464 pp.  

৩. ড. মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ ফুলের চাষ প্রথম সংস্করণ ২০০৩ ঢাকা, দিব্যপ্রকাশ, পৃষ্ঠা ১২২। আইএসবিএন 984-483-108-3

৪ . আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা, ৯০-৯৫।

আরো পড়ুন:  দোপাটি ফুল বাগান বা গৃহের আলংকারিক বর্ষজীবী বীরুৎ

Leave a Comment

error: Content is protected !!