কুরচি গাছের ছাল, বীজের দশটি ঔষধি গুণাগুণ

কুরচি (বৈজ্ঞানিক নাম: Holarrhena pubescens) মূলত একটি গণের নাম। কুরচি বলতে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানে মূলত দুটি গণের প্রায় ৭-৮টি প্রজাতির বৃক্ষকে উল্লেখ করা হয়। এদেরকে নানা নামে ডাকা হয়, সেগুলো হচ্ছে কুরচি, কুর্চি, কুড়চি, কুটজ, ইন্দ্রযব, সিত কুটজ, অসিত কুটজ, মিঠা ইন্দ্ররজো, ইন্দ্ররজো সিরিণ, ইত্যাদি। এই প্রজাতিগুলোর সবগুলো বিভিন্ন ঔষধি কাজে লাগে। নিম্নে এদের ঔষধি ব্যবহার উল্লেখ করা হলো। কুরচি গাছের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন

কুরচি একটি সুগন্ধি ঔষধি ফুল

১. অতিসার বা আমাশয়: সব আমাশয় বা অতিসারে ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে না, যেখানে পেটে যন্ত্রণা এবং অসাড়ে দাস্ত, এইভাবে ২ থেকে ৩ দিন চলছে, তার সঙ্গে রক্তের ছিট দেখা যাচ্ছে, এটা বুঝতে হবে বায়ু এবং পিত্তজাত অতিসার। এখানে কুরচি গাছের শুকনো ছাল ৫ গ্রাম একটু কুটে নিয়ে দুই কাপ জলে সিদ্ধ করে আধ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ঐ জলটা দুইবারে খেতে হবে। এটাতে একদিনের মধ্যেই উপশম হবে।

২. রক্তামাশয়ে: এটা সেটা খেতে থাকেন, মনে করেন রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে; এদের বিশেষ লক্ষণ রাতে বড় দাস্ত হয় না, দিনের বেলায় এর প্রকোপ বেশী, কুন্থনও থাকে; বুঝতে হবে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, এদের পক্ষে কুরচি গাছের ছাল ১০ গ্রাম একটু কুটে নিয়ে তিন থেকে চার কাপ জলে সিদ্ধ করে এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে সকালে ও বিকালে দুবারে এটাকে খেতে হবে; দুই এক দিনের মধ্যেই রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে,তবে পুরনো হলে দুই একদিন বেশী লাগতে পারে।

৩. রক্তার্শে: প্রথমেই বলে রাখি, মলদ্বারের তিনটি আবর্তেই বলি হয়ে থাকে; বহির্বলি, মধ্যবলি ও উর্ধ্ববলি; বহির্বলিতে রক্ত পড়লেও যন্ত্রণা বেশী হয় না, তবে টাটানি বা টিনটিনানি থাকে; মধ্যবলি ও উর্ধ্ববলির অর্শে যেমন যন্ত্রণা তেমনি রক্তপড়া; এক্ষেত্রে কুড়চির ছাল উপরিউক্ত মাত্রায় ও পদ্ধতিতে প্রস্তুত করে খেতে হবে, এটাতে রক্তপড়া ও যন্ত্রণা দুই কমে যাবে কিন্তু বলি খসে যাবে না।

আরো পড়ুন:  সারবেরা হচ্ছে উদ্ভিদের এপোসিনাসি পরিবারের একটি গণ

সাবধানতা, যাঁদের অর্শ আছে আবার হারিশও বেরিয়ে আসে, তাঁরা যেন এ ক্বাথ ব্যবহার করবেন না, বিপদ আসতে পারে, মলদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসা সরলান্ত্রটি সংকুচিত হয়ে মাঝপথে আটকে যেতে পারে।

৪. বিষম জ্বরে: নতুন জ্বরকে চাপা দিয়ে ছাড়ানো হলো, কিন্তু অগ্মিবল রক্তে ফিরে গেল না, ঢিসঢিসে শরীর, মুখেও কিছু ভাল লাগে না, তার সঙ্গে যা তা খেয়েই চলেছে, আবার দেখা যাচ্ছে বিকালের দিকে শরীরটায় একটু উত্তাপ, কোনো দিন একটু ভালো কোনো দিন মন্দ এই ভালো মন্দটা কিন্তু অগ্মিমান্দ্যের জন্য হয়। এই করে রক্তের অগ্নিবল নষ্ট হয়ে যায় যাকে বলা যায় রক্তের মেটাবলিজিম হ্রাস পেয়ে যাওয়া, এক্ষেত্রে কুড়চি ছাল চূর্ণ ১ গ্রাম ও তার বীজ ইন্দ্রযব চূর্ণ ১ গ্রাম, এই দুটি একসঙ্গে সকালে ও বিকালে দুবার জল দিয়ে খেতে দিতে হয়। আরও আশ্চর্য ফল পাওয়া যায় যদি শিউলি পাতার (Nyctanthes arbortristis.) রস ৪ চা চামচ একটু গরম করে ওর সঙ্গে একবেলা বা দুবেলা মিশিয়ে খাওয়া যায়; যদি নিতান্ত দুবেলা না হয়, একবেলা খেলেও চলে। অনেক সময় এইসব ক্ষেত্রে মুখে অরুচিও হয়, সেক্ষেত্রে মুখ ছাড় হিসেবে একটি ফুলুরির কথা বলি শিউলির পাতা ও কাঁচা মুগের ডাল একসঙ্গে বেটে বড়া করে খেলে মুখের রুচি ফিরে আসবে।

৫. রক্তপিত্তে:  সর্দি নেই কাসি নেই। অথচ মুখ থেকে রক্ত পড়ে, এ সময় গলা সুড়সুড় করে কাসির বেগে রক্তটা বেরিয়ে আসে, আবার কারও অর্শের যন্ত্রণা নেই। অথচ দাস্তের সময় কাঁচা রক্ত পড়ছে, আবার এও দেখা যায় প্রস্রাবের কোনো জ্বালা যন্ত্রণা নেই। অথচ প্রস্রাবের সময় রক্ত পড়ছে ; এসব ক্ষেত্রে এটা যে রক্তপিত্ত সেটা নিঃসন্দেহ হতে পারা যায়। আরও পরিষ্কার করে বলি পিত্তবিকার হলে বমি হয়, রক্ত বিকারগ্রস্ত হলে বমি হয় না, কিন্তু রক্ত ও পিত্তের সমধর্মিতা থাকায় এই রক্ত পিত্তই বমি হয়। এদের পক্ষে ভাল কুরচি গাছের ছাল চূর্ণ দেড় গ্রাম মাত্রায় বা দুই আনা দুইবেলা জলসহ খাওয়া, তবে একটু ছাগদুগ্ধ দিয়ে খেলে আরও ভালো হয়।

আরো পড়ুন:  জবা ফুল ও গাছের দশটি ভেষজ গুণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি

৬. বাতরক্তে: এটি বংশপরম্পরায় যেমন আসে, আবার বিরুদ্ধ ও অহিত ভোজনেও আসে। এ রোগের প্রধান লক্ষণ যেখানে সেখানে ফুলে ওঠা ও ব্যথা, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্রাবী ক্ষতও হয়। এই রোগটা কুষ্ঠেরই একটা সংস্করণ। এক্ষেত্রে কুড়চি ছাল ৫ থেকে ১০ গ্রাম মাত্রায় নিয়ে ৪ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সকালে ও বিকালে দুবার খেতে হবে। এটা বেশ কিছুদিন ব্যবহার করতে হবে; তবে এক নাগাড়ে ব্যবহার না করে ৬ থেকে ৭ দিন খাওয়ার পর আবার ৬ থেকে ৭ দিন বন্ধ রেখে পুনরায় ৬ থেকে ৭ দিন খেতে হবে। এইভাবে এক বা দেড় মাস খেলে ঐ দোষটা চলে যাবে।

৭. মূত্রকৃচ্ছ: কৃচ্ছ শব্দের অর্থ হলো কষ্টে হওয়া। এটা অনেক কারণেই আসতে পারে প্রোষ্টেট গ্ল্যান্ড বড় হলে কৃচ্ছতা ততটা থাকে না। কিন্তু প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, সেটাকে মূত্রাঘাত বলা হয়; তবে যেখানে প্রস্রাবের কৃচ্ছতা থাকে, সেখানে কুরচির ছাল চূর্ণ ৮/১০ গ্রাম পূর্বদিন রাত্রে ১ গ্লাস গরম জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে, তার পরদিন সকালে ছেকে নিয়ে ১/১২ ঘণ্টা অন্তর ৪/৫ বারে সেটা খেতে হবে। এটাতে ঐ কৃচ্ছতাটা চলে যাবে।

৮. কেঁচো ক্রিমিতে: প্রায় সময় মুখ দিয়ে জল ওঠে, থু থু ফেলার অভ্যেস, পেট গুলোয়, এক্ষেত্রে কুরচি বীজ অর্থাৎ তিক্ত ইন্দ্রযব যাকে বলা যায় কুটজ বীজ চূর্ণ আধ থেকে ১ গ্রাম মাত্রায় মধু মিশিয়ে চেটে খেতে দিতে হয়। কিন্তু বালকদের এই চূর্ণ খাওয়ানো খুবই মুশকিল।

৯. ফোড়ায়: যে ফোঁড়া পাকেও না, বসেও না, যাকে চলতি কথায় বলে দড়কচা মেরে যাওয়া; এই ফোঁড়ায় কুরচির ছাল বেটে একটু গরম করে ফোঁড়ার উপর প্রলেপ দিলে পেকে ফেটে যায়।

১০. মুখের ক্ষত: কুরচির ছাল আন্দাজ ১০ গ্রাম নিয়ে ৩ কাপ জলে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে নিয়ে সেই ক্বাথ মুখে পুরে ৫ থেকে ৭ মিনিট বসে থাকতে হবে, এইভাবে ৩ থেকে ৪ বারে ঐ ক্বাথ দিয়ে কবল ধারণ করতে হবে। এটাতে ঐ ক্ষতটা সেরে যাবে।

আরো পড়ুন:  কাইনজাল বাংলাদেশের পার্বত্যঞ্চলে জন্মানো ভেষজ বৃক্ষ

এ ভিন্ন যেসব ক্ষত কিছুতেই সারছে না, সেসব ক্ষেত্রে এই কুরচি ছালের ক্বাথ দিয়ে ধুলে ক্ষত সেরে যাবে।

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য: চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৪, পৃষ্ঠা, ২৯৮-৩০৬।

Leave a Comment

error: Content is protected !!