নিসিন্দা গাছের ২৮টি ভেষজ গুণাগুণ ও ব্যবহার পদ্ধতি জেনে নিন

নিসিন্দা গাছের ভেষজ ব্যবহার:

নিসিন্দা ঔষধি গাছটির বোটানিক্যাল নাম Vitex negundo Linn. ফ্যামিলি Verbenaceae. আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে এই গাছটি বেশ উপকারী।

১. স্মৃতিশক্তি বাড়ানো:  ঘিয়ের সঙ্গে প্রতিদিন দুটি নিসিন্দা ঔষধি গাছের পাতা ভেজে খেলে স্মৃতি ধারক হয়। অবশ্য এটাও দেখতে হবে, যে ক্ষেত্রে আকস্মিক কোনো কারণে শ্লেমাবিকারে মস্তিকের  স্মৃতিকেন্দ্রটির কাজ ব্যাহত হলেই এটির কার্যকার হবে।

২. শিশু ও বৃদ্ধদের তরল পায়খানা হতে হতে মলদ্বারে ক্ষতের উপদ্রব হলে এর পাতার রস ২ থেকে ৩ দিন লাগালেই সেরে যায়।

৩. ফোড়ায়: তিলের তেলের সাথে এর পাতার রস মিশিয়ে পাক করলে (তেলের দ্বিগুণ রস) সেই তেল মাখলে ফোড়া পাকে, ফাটে ও শুকায়।

৪. খুস্কি ও টাক: নিসিদা পাতার রস পাক করা তেলের মতো ব্যবহারে মাথার খুস্কি মরে যায়। এমনকি অকামের টাকও উপমিত হয়।

৫. গাঁটের ব্যথা:  নিসিলার পাচন অব্যর্থ। যদি তাতে জ্বর থাকে, তবে এ সুন্দর উপকার হয়। ৩ থেকে ৪টি  পাতা সিদ্ধ করে ছেঁকে সেই জলটা খেতে হয়, তবে তার সঙ্গে হাই ব্লাডপ্রেসার থাকলে খাওয়া উচিত নয়।

৬.  পেটে বায়ুর জন্য শূল ব্যথা: নিসিন্দার চূর্ণ (পরিমাণ মতো) ২ থেকে ৩ রতি গরম জল দিয়ে খেলে অনেক ক্ষেত্রে তক্ষুনি ব্যথা কমে যায়, কিছুদিন খেলে বায়ুর শূল থাকে না।

৭. মেদবৃদ্ধিতে: স্থুল দেহ অর্থাৎ পেটমোটা লোক কিছুদিন নিসিন্দা পাতায় গুড়ো খেলে (জল সহ) ভুড়ি কমে। মাত্র আধ গ্রাম পর্যন্ত।

৮. গৃধশীবাত (Sciatica): নিসিন্দার চূণ ১/২ গ্রাম বা ৩ থেকে ৪ রতি গরম জল সহ খেলে খুব ভালো কাজ করে। এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধি বৈদ্যদের উপদেশ শিউলি ফুলের পাতা ৮ থেকে ১০টি সিদ্ধ করে সেই জল খাওয়া। এই গাছটির বোটানিক্যাল নাম Nyctanthes arbortristis.

৯. শিরোগত শ্লেষ্মা:  ১ চা চামচ মাত্রায় দিনে ৩ বার (পাতা বা ছালের) রস খেলে শ্লেষ্মা বমি হয়ে বেরিয়ে যায়। অবশ্য সব ক্ষেত্রে বমি করানো উচিত নয়। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন এবং মাত্রা বিচারও অবশ্য কর্তব্য।

আরো পড়ুন:  স্বর্ণ ঝিন্টি গুল্ম-এর ছয়টি ভেষজ গুণাগুণ

১০. কুচো ক্রিমিতে: নিসিন্দা পাতা চূর্ণ সিকি গ্রাম মাত্রায় খেলে ক্রিমির উপদ্রব উপশমিত হয়। (এটি পুর্ণবয়স্কের মাত্রা)।

১১. শ্বেত প্রদরের জন্য যোনি ক্ষত:  নিসিন্দার ক্বাথ দিয়ে সেচন করলে ২ থেকে ৪ দিনেই ক্ষত সারে।

১২. অগ্নিমাদ্যে: নিসিন্দার চূর্ণ ভাতের সঙ্গে খেলে (আন্দাজ সিকি গ্রাম) কিংবা নিম বেগুনের মতো বেগুন দিয়ে ঐ পাতা খেলে ক্ষুধা বাড়ে।

১৩. কুষ্ঠ: প্রথম প্রথম কুষ্ঠের যন্ত্রণায় নিসিন্দার ক্বাথ সেচন, নিসিন্দার প্রলেপ, নিসিন্দার ক্বাথ খুব ভাল কাজ করে। সেরে যায়, তবে এক্ষেত্রে দুধ-ভাত পথ্য করতে হয়।

১৪. চুলকানিতে:  নিসিন্দার তেল ব্যবহার করলে চুলকানি সেরে যায়। (তিলের তেলের সঙ্গে নিসিন্দার রসের পাক)

১৫. অরুচিতে:  নালতে পাতার মতো নিসিন্দা পাতার সুপ্ত (ঘিয়ে ভেজে) খেলে (একটি বোঁটায় ৩ থেকে ৪টি পাতা থাকে, সেই রকম একটি বা দুটি পাতা) পুরোনো অরুচি সারে। নিসিন্দার ফুলও ঐভাবে খেলে অরুচি সারে।

১৬. হাঁপানিতে:  নিসিন্দ গাছের ছালের ক্বাথ চায়ের মতো খেলে হাঁপ কমে যায়। ছাল সিকি তোলা (৩ গ্রাম) থেকে আধ তোলা (৬ গ্রাম) মাত্রার বেশি না হয়।

১৭. ঘুংড়ি কাসি:  নিসিন্দাপাতা ও তার গাছের ছালের ক্বাথে নিশ্চয়ই তা সারে। বরসানুপাতে মাত্রা ঠিক করতে হয়।

১৮. স্তন্যবৃদ্ধিজনিত শিশুদের পেটের দোষে-গ্রামাঞ্চলে এই পাতা সিদ্ধ জল অল্প গরম অবস্থায় মায়ের গায়ে প্রতিদিন ঢেলে থাকে। এই দ্রব্যটির গুণ স্তন্যশুদ্ধির সহায়ক।

১৯. সুতিকা রোগ: এই পাতা সিদ্ধ জলে স্নান করলে ভাল হয় এ কথা বলেছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী মনীসী রস্কবর্গ। তাছাড়া নিম-নিসিন্দার পাতা সিদ্ধ জলে যেকোনো প্রকার বা (ক্ষত) ধোয়ালে তাড়াতাড়ি বিষদোষ কেটে যায়। এটি আমাদের দেশী antiseptic বলা যেতে পারে।

২০. গলারোগে: ফেরিনজাইটিস (pharyngitis), টনসিলাইটিস (tonsillitis), বার আয়ুর্বেদে নাম কণ্ঠশাল্বক, প্রভৃতি রোগে ও দাঁতের মাড়ির ফুলায় এই পাতা সিদ্ধ হলে অল্প গরম অবস্থায় ২ থেকে ৪ গ্রেণ ফিটকিরির গুড়ো মিশিয়ে ৫ থেকে ৭ মিনিট মুখে রাখলে (যাকে আয়ুর্বেদের ভাষায় কবল ধারণ বলে) বা গারগেল (gurgle) করলে উপশম নিশ্চয়ই পাবেন।

আরো পড়ুন:  করন কর্পুর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চলে জন্মানো গুল্ম

২১. আব বা টিউমার: দেহের কোনো জায়গায় অর্বাকার (অব) (Tumour) হচ্ছে দেখলে এই পাতা বেটে গরম করে একদিন অন্তর বা প্রত্যহ লাগালে কিছুদিনের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। এভিন্ন মাংসগত রাতের জন্য পেশী-বিকৃতিতে শরীরের স্থানে স্থানে মাংস পিণ্ডাকার হতে দেখা যায়, সে ক্ষেত্রে এই পাতা বেটে গরম করে গায়ে মাখলে কমে যায়। তাছাড়া বাতে বা কোনো গ্রন্থি (Gland) ফুলাতে অনুরূপভাবে প্রলেপ দিলে একদিনেই ফুলা ও ব্যথার কিছু উপশম হবে।  

২২. কানের পুজ: পাতার রস বা পাতা বাটা দিয়ে তেল পাক করে সেই তেল ২ থেকে ১ ফোঁটা করে কানে দিলে ৭ দিনের মধ্যে পুজ পড়া বন্ধ হয়ে যায়, এভিন্ন সর্বপ্রকার ক্ষতে এটি ব্যবহার করা যায়।

২৩. জিভে বা মুখে ঘা (ক্ষত):  কিছুতেই সারে না, এই পাতার রস দিয়ে পাক করা ঘি দিনে ও রাতে দুইবার লাগালে উপকার হয়। এমনকি যেকোনো দুষিত ক্ষতে বিশেষ উপকারী।

২৪. শয্যামুত্রে:  দীর্ঘদিন পর্যন্ত  অনেক ছেলেমেয়েকে নিয়ে মায়েদের এই সমস্যায় ভূগতে হয়, এ ক্ষেত্রে এই পাতার গুড়ো ২ গ্রেণ মাত্রায় (৬ থেকে ৭ বৎসর বয়স হলে) বিকালে জলসহ খাওয়ালে ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে এ জ্বালা থেকে মায়েরা রেহাই পাবেন। যদি ৭ দিন ব্যবহারে না কমে, তবে সকালে-বিকালে ২ বার খাওয়াবেন। এটি ব্যবহারের সব থেকে সুবিধে হচ্ছে যেকোন প্রতিক্রিয়া (Reaction) নেই।

 ২৫. বয়স্ক যাদের রাতে প্রস্রাবের পরিমাণ বা বার বেশি হয়, তারা ২ থেকে ৩ রতি মাত্রায় পাতার গুড়ো জলসহ বিকালের দিকে একবার খেলে কয়েকদিনেই উপকার পাবেন। প্রয়োজন বোধে ২ বারও খেতে পারেন।

২৬. বাতের দোষ:  শরীরে ব্যথা ও যন্ত্রণা যারা মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়, পুর্ব লিখিত মাত্রায় একটু বেশিদিন ব্যবহার করে দেখন কি অপুর্ব ফল পাওয়া যায়।

 ২৭. মাথার যন্ত্রণা ও সর্দিজনিত কারণে:  যাঁদের প্রায়ই নাক বন্ধ হয়ে যায় অথবা সান্নিপাতিক দোষে গাল, গলা ও কর্ণমূলের ব্যথায় কষ্ট পান, তাঁরা এই পাতা শুকিয়ে বালিশের মতো করে মাথায় দেবেন।

আরো পড়ুন:  করবী গাছ নানা রোগের ভেষজ চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়

২৮. শয্যাক্ষত (Bedsore): শুকনো নিসিন্দা পাতার মিহি গুঁড়ে ক্ষতে ছড়িয়ে দিলে শীঘ্র শুকিয়ে যায়। আরও ভাল উপকার পাওয়া যায় যদি নিসিন্দা পাতার রসে পাক করা তেল দিনে একবার করে লাগান যায়। এটা বহু, পরীক্ষিত।

নিসিন্দার অর্থনৈতিক ব্যবহার ও গুরুত্ব:

১. যখন ন্যাপথলিন, এ দেশে জন্মেনি, কালজিরেও আসেনি (আদিম জন্মবাস দক্ষিণ ইউরোপে), তখন দামী জামা-কাপড় ও বই পোকার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিসিন্দার শুকনো পাতা কাপড়ে দিয়ে রাখা হত। এই পাতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাপড় জরে যায় না বা কোনো দাগ লাগে না।

২. গ্রামাঞ্চলে সংগৃহীত ডাল-কলাইয়ের উপর শুকনো পাতা দিয়ে রাখেন, তাহলে নাকি পোকা জন্মে না এবং বাইরে থেকেও আসে না।

৩. মশা তাড়াতে এর জুড়ি নেই এ কথা বলেন পণ্ডিতপ্রবর কবিরাজ। তিনি প্রত্যহ সন্ধ্যাবেলা ধুনোর সঙ্গে শুকনো পাতা ছড়িয়ে ধোঁয়া দেন এই পাতার গুড়ো মিশিয়ে ধুয়া তৈরী করাও তো অসম্ভব নয়।

রাসায়নিক গঠন:

(a) Alkaloids viz., nishindine & unidentified alkaloids. (b) Essential oil. (c) Sterols. (d) Terpenoid constituents.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ

১ আয়ূর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি‘ খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১০২-১০৫।

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Dinesh Valke

Leave a Comment

error: Content is protected !!