ফুটি বা বাঙ্গি বা বাঙ্গী বা বাঙির কয়েকটি বহুমুখী ঔষধি গুনাগুণ

ফুটি বা বাঙ্গি বা বাঙ্গী বা বাঙি (বৈজ্ঞানিক নাম: Cucumis melo) হচ্ছে শসা পরিবারের একটি লতা জাতীয় উদ্ভিদ। ফল হিসেবে কাঁচাতে এটি সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। এছাড়া পাকলে কেটেই এবং সরবত করেও খাওয়া যায়। এছাড়াও ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয় এদের বীজ, মূল, পাতা। নিম্নে খাদ্য ও ভেষজ ওষুধ হিসেবে এর দুই ধরনের ব্যবহার এবং উপকারিতা উল্লেখ করা হলো।

আরো পড়ুন বাঙ্গি বা ফুটি একটি ভক্ষণযোগ্য সুস্বাদু দৃষ্টিনন্দন ফল

ফল হিসেবে বাঙ্গি খেলে পাওয়া যাবে অনেক উপকার। নিম্নে কয়েকটির উল্লেখ করা হলো।

১. বয়স ধরে রাখে: বাঙ্গি ত্বকের উপর পড়া বয়সের ছাপ দূর করে। এটি ত্বকের কোষ নষ্ট হয়ে গেলে তা সুস্থ করতে সাহায্য করে। বাঙ্গির ভেতরে থাকা প্রোটিন কম্পাউন্ড ত্বককে সুন্দর করে তোলে। বাঙ্গি মধুর সঙ্গে মিশিয়ে ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিট রাখতে হবে এবং এভাবে নিয়মিত ব্যবহার করতে হবে।

২. একজিমা ও ব্রণ দূর করেঃ ব্রণ বা একজিমার সমস্যায় ভুগলে প্রতিদিন এক গ্লাস বাঙ্গির শরবত খেতে দ্রুত উপকার পাওয়া যাবে। মূলত কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেই যেহেতু ব্রণ ও একজিমা হয়, বাঙ্গির আঁশ পেট পরিষ্কার করে, ফলে এই অসুখ সেরে যায়। এ ছাড়াও বাঙ্গি ভালো করে ব্লেন্ড করে ছেঁকে রসটুকু বের করে তা লোশনের মতো ব্যবহার করুন। এতে ব্রণ এবং একজিমার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। 

৩. চুল পড়া রোধে: বাঙ্গিতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘বি’। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘ইন্সনিটোল’, এই উপাদান আমাদের চুল নতুন করে গজাতে সাহায্য করে এবং চুল পড়া প্রতিরোধ করে থাকে। ফলে নিয়মিত বাঙ্গি খেলে চুলের অনেক উপকার অবশ্যই পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ব্লেন্ড করা বাঙ্গি শ্যাম্পু করার পর চুলে কন্ডিশনারের মতো ব্যবহার করাও ভালো।
৪. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে: বাঙ্গিতে আছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ বা ডায়াটারি ফাইবার, যা খাবার হজমে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, যা একটু আগেই বলেছি।
৫. অন্যান্য উপকার: বাঙ্গির পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। বাঙ্গি মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহে সাহায্য করে শরীরের অবসাদ ভাব দূর করে। গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুব উপকারী বাঙ্গি। নিয়মিত বাঙ্গির শরবত খেলে খাবারে অরুচি, নিদ্রাহীনতা, আলসার ও অ্যাসিডিটি দূর হয়। তা ছাড়া এই ফলে নেই কোনো চর্বি বা কোলেস্টেরল। তাই বাঙ্গি খেলে মুটিয়ে যাওয়ার ভয় নেই একেবারেই।

আরো পড়ুন:  আঙ্গুর লতা, পাতা ও ফলের তেরটি ভেষজ গুণাগুণ

ভেষজ ওষুধ হিসেবে বাঙ্গির লোকায়তিক ব্যবহার

এসব তো গেল বাঙ্গির ফল হিসেবে উপকার। এবার আসুন জেনে নিই ভেষজ ওষুধ হিসেবে বাঙ্গির ব্যবহার। ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয় এদের বীজ, মূল, পাতা। নিম্নে ওষুধ হিসেবে এর ব্যবহার আলোচনা করা হলো।

এই কাঁকুড় আমাদের শরীরে রসবহ ও মূত্রবহ স্রোতে কাজ করে সত্যি, কিন্তু যেখানে সান্নিপাতিক ক্ষেত্র হয়, যেমন বায়ু ও পিত্ত দুটি ধাতুই কুপিত এবং একসঙ্গে জোট বেঁধেছে, সেখানে এটাতে বিশেষ উপকার দর্শায় না।

১. প্রস্রাবের স্বল্পতায়: এই অসুবিধেটা এসেছে কিন্তু বায়ু বিকারগ্রস্ত হয়েছে বলে। যে বায়ু, আমাদের মল, মূত্র, শুক্র ও অধোবায়ুর নিঃসরণের স্বাভাবিকতা রক্ষা করে, সেক্ষেত্রে মিষ্টি কচি কাঁকুড়ের রস ২ চা চামচ ৭ থেকে ৮ চা চামচ জল ও একটু মিছরি মিশিয়ে সরবতের মতো করে প্রত্যহ একবার খেলে প্রস্রাবটা স্বাভাবিক হবে।

২. অগ্নিমান্দ্যজনিত মূত্রাল্পতায়: এখানে চিকিৎসার একটু অসুবিধা আছে। জল খেলেই কি এই রোগে সুবিধা হবে? তার উত্তরে বলা যায়, বেশি জল প্রথমত, অগ্নিবল আরও কমিয়ে দেবে, আর প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতাও কমে যাওয়ার অসুবিধ দেখা দিবে। এক্ষেত্রে মিষ্টি কচি কাঁকুড়ের রস ৩ থেকে ৪ চা চামচ মিছরি দিয়ে সরবত করে খেতে হবে, নইলে পাকা কাঁকুড়ের বীজ ১০ গ্রাম নিয়ে, তাকে জল দিয়ে বেটে, কাপড়ে ছেঁকে, একটু মিছরি দিয়ে সরবত করে খেতে হবে।

আপনারা হয়তো অনেকে জানেন এই ত্রপুষজাতীয় ফলের বীজগুলো খোসা ছাড়ানো অবস্থায় বাজারে বিক্রি হয়ে আসে। কাঁকুড়, শসা এর সঙ্গে আসে লাউ বীজ। এগালো ঠান্ডাই মগজ বলে ইউনানি সম্প্রদায়ের লোকেরা সর্বদা ব্যবহার করেন, সুতরাং প্রয়োজন বোধে আপনারা এই খোসা ছাড়ানো বীজগুলোকেও ব্যবহার করতে পারেন।

৩. অরুচিবমি: কয়েকদিন থেকে কিছুই মুখে রুচছে না, বমি আসে, মুখ দিয়ে তিতো (তিক্ত) জল বেরোয়, এক্ষেত্রে বুঝতে হবে, তাঁর রসবহ স্রোত বিকারগ্রস্ত। তাই সেখানে কচি কাঁকুড়ের রস ৩ থেকে ৪ চা চামচ একটু মিছরি মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে একবার খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধাটা চলে যাবে।

আরো পড়ুন:  আম গাছের ছাল, পাতা, ফলের ২০টি ওষধি গুণাগুণ

৪. উদাবর্ত রোগ: লোকে কথায় বলতো, ‘উদুরি বাদুড়ি যক্ষ্মা, তিনে নাই রক্ষা’, এই বাদুড়ি হচ্ছে উদাবর্ত রোগ, কারণ আপনি বায়ুর ক্রিয়া যখন একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন মলমূত্রের নির্গমন আর হয় না, এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুখ দিয়ে বিষ্ঠাগন্ধযুক্ত দ্রব্য এমন কি বিষ্ঠাও উঠে আসে, তাই একে গ্রাম্য বৈদ্যরা বলে থাকেন বাদুড়ি রোগ। এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হলো ঢেকুর ওঠা, সে ঢেকুরের এমন শব্দ যে, পাড়ার লোকে জেনে যায়; মনে হয় যেন মহিষের বাচ্চা ডাকছে; এর সঙ্গে থাকবে কোষ্ঠবদ্ধতা, প্রস্রাবও ভালো হচ্ছে না, জল খেলেও পেটে আরও বায়ু, এটা রসবহ স্রোতের বিকার, তারই পরিণতিতে এসেছে আপনি বায়ু কুপিত ও স্তম্ভিত ; যদিও সাধারণের ধারণা এটা এমন কিছু নয়, তা যা হোক, এক্ষেত্রে কিসমিস ৫ গ্রাম বা আধ তোলা আন্দাজ ও আধা পোয়া বা প্রায় ১১৪ মিলিলিটার জল একসঙ্গে সিদ্ধ করতে হবে। এক ছটাক বা প্রায় ৫০ মিলিলিটার থাকতে নামিয়ে, সেটাকে চটকে, ছেঁকে সেই জলে কাঁকুড় বীজ ৫ গ্রাম বেটে পুনরায় ছেঁকে প্রতিদিন একবার খেতে হবে। এর দ্বারা দাস্ত পরিষ্কার হবে, তার সঙ্গে প্রস্রাবটাও সরল হবে এবং ঢেকুর ওঠা কমে যাবে। এই যোগটি চরকীয় ব্যবস্থা।

এ রোগের এসব উপসর্গ তো থাকবেই, তাছাড়া যেখানে দেখা যাচ্ছে এই উদাবর্ত জন্য প্রস্রাব আটকে যাচ্ছে, হতে চাচ্ছে না, সেখানে কাঁকুড় বীজ ৫ থেকে ৬ গ্রাম খোসা ছাড়া হলেও চলবে; জলে বেটে, আধা পোয়া আন্দাজ করে বা প্রায় ১১৪ মিলিলিটার, তার সঙ্গে সৈন্ধব লবণ দেড় গ্রাম আন্দাজ মিশিয়ে, খেতে দিলে আপনি বায়ুর অনুলোম হয়ে প্রস্রাব হয়ে যাবে।

একটা কথা জেনে রাখা সৈন্ধিবের বিবন্ধতা নাশ করার শক্তি আছে ঠিকই, কিন্তু আসল সৈন্ধব বা আকৃত্রিম যদি না হয়, তা হলে কোনো কাজই হবে না। এখন বাজারে আসল সৈন্ধব দুর্লভ। কারণ বর্তমানে এটা বৈদেশিক দ্রব্য।

আরো পড়ুন:  জগডুমুর ঔষধি ফল হিসাবে খাওয়া নানাবিধ উপকারিতা

৫. মূত্রাঘাতে এবং মূত্ররোধে: মূত্রাঘাত আসে প্রোষ্ট্রেট গ্লান্ড (Prostate gland) বড় হলে, মূত্ররোধ হয়, আবার অন্য কারণেও হয়, সেক্ষেত্রে উপরিউক্ত মাত্রায় কাঁকুড় বীজকে বেটে ছেঁকে, সেটায় সৈন্ধব লবণ না দিয়ে, ৭ থেকে ৮ চা চামচ কাঁজি মিশিয়ে খেতে হবে।

এখন এই কাঁজি পাওয়াটাই সমস্যা, তবে এর অনুকল্প এই করা যেতে পারে, আধ সিদ্ধ ভাতের সঙ্গে ৮ গুণ জল মিশিয়ে, ৩ দিন ঢেকে রেখে দিয়ে ছেঁকে নিলেও চলবে।

৬. মূত্রনালীর ক্ষত: এই মুষ্টিযোগটি একটু অসুবিধজনক হলেও জেনে রাখা ভাল। বাংলার প্রাচীন বৈদ্যগণ কাঁকুড়ের বীজকে ঘানিতে ভাঙ্গিয়ে তেল করে রাখতেন, আর ঐ তেল ২ থেকে ৫ ফোঁটা করে অল্প দুধের সঙ্গে সমস্ত দিনে ৩ থেকে ৪ বার খেতে দিতেন, এর দ্বারা ঐ মূত্রনালীর ক্ষত সেরে যায়।

কাঁকুড়ের রাসায়নিক গঠন: (a) Fatty acids, protein. (b) Vitamin-A, Vitamin-B, Vitamin-B, Vitamin-C. (c) Sitosterol cetyl alcohol.

সতর্কীকরণ: ঘরে প্রস্তুতকৃত যে কোনো ভেষজ ওষুধ নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করুন।

তথ্যসূত্রঃ     

১. আয়ুবেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ২, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩৮৩, পৃষ্ঠা, ১৩৮-১৪০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!