বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে কথাসাহিত্যিক

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর পূর্বপুরুষের আদিনিবাস ছিল পশ্চিম চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রামে। তাঁর পিতামহ তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পিতৃগ্রাম পরিত্যাগ করে স্থায়ীভাবে চলে আসেন অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার বারাকপুর গ্রামে। বর্তমানে এই বারাকপুর গ্রাম পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। ইছামতী-লালিত সবুজ-সমৃদ্ধ গ্রাম বারাকপুর। লোকে বলে চালকি-বারাকপুর। চালকি পাশের গ্রাম। কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত ব্যারাকপুর থেকে আলাদা করে বোঝানোর জন্যেই এই নামকরণ—চালকি-বারাকপুর। তারিণীচরণের শ্বশুরবাড়ির সূত্রে কিছু আত্মীয়-স্বজন এই গ্রামের আশপাশে ছড়িয়ে ছিলেন। গ্রামগুলো হলো সাইলেপাড়া, শিমুলিয়া, শিলহাটি, মোল্লাহাটি, সুন্দরপুর, মাধবপুর, দুর্গাপুর, নিশ্চিন্দিপুর ইত্যাদি।

কবিরাজ তারিণীচরণের আশা ছিল বারাকপুরে এসে চিকিৎসা-ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করবেন। সেই সাফল্য যে অর্জিত হয়নি তাও নয়। চিকিৎসাব্রত যখন ভালোভাবেই উদযাপন করছিলেন তখনই অকস্মাৎ মারা গেলেন তার স্ত্রী কাশীশ্বরী। তারিণীচরণ-কাশীশ্বরীর একমাত্র সন্তান মহানন্দ। তাকে নিয়েই তারিণী পাড়ি দিতে চান সংসারতরণী। কিন্তু মহানন্দ পিতার পথ অনুসরণ করেননি। তিনি ছিলেন ছন্নছাড়া ও ভবঘুরে প্রকৃতির। এমতাবস্থায় তাকে গৃহমুখী করার জন্যে বৈরামপুর গ্রামের জমিদার খগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা হেমাঙ্গিনী দেবীর সঙ্গে বিয়ে দেন তারিণী। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে তিনি চলে যান কাশীতে; সেখানে বেশ কয়েকবছর শাস্ত্রাধ্যয়নের পর প্রাপ্ত হন ‘শাস্ত্রী’ উপাধি এবং জীবিকার উপায় হিসেবে বেছে নেন কথকতা ও পৌরোহিত্য।

মহানন্দ-হেমাঙ্গিনীর দাম্পত্যজীবন ছিল সুখের। কিন্তু তাঁদের কোনো সন্তান-সন্ততি ছিল না। হেমাঙ্গিনী ছিলেন উদারমনস্ক ও স্বামীঅন্তপ্রাণ । তিনি তার বন্ধ্যাত্ববিষয়ে নিশ্চিত হয়ে বংশরক্ষার প্রয়োজনে মহানন্দকে দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহণে বাধ্য করেন (২৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৬) এবং চিরদিনের জন্যে কাশীবাসী হন। মহানন্দের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম মৃণালিনী; কাঁচড়াপাড়া সংলগ্ন মুরাতিপুর গ্রামের গুরুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা। মৃণালিনী-মহানন্দ দম্পতির পাঁচ সন্তান : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দুভূষণ, জাহ্নবী, সরস্বতী ওরফে মণি এবং নুটুবিহারী ।

জন্ম ও শৈশব:

মৃণালিনীর সঙ্গে মহানন্দের বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর পর মাতুলালয় মুরাতিপুরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জন্ম গ্রহণ করেন, ১৩০১ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্র ( ১২ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪), বুধবার সকাল সাড়ে দশটায়। দরিদ্র পিতা-মাতার অবারিত স্নেহচ্ছায়ায় বেড়ে উঠছিলেন বিভূতিভূষণ। আর্থিক অনটন আর গুরুজনদের উদাসীনতার কারণে পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটলেও বরাবরই তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিভূতিভূষণ যখন অষ্টম শ্রেণি ! তখন মারা যান মহানন্দ। বিভূতির অবস্থা তখন কাণ্ডারিবিহীন নৌকোর মতো। কী করবেন তিনি? মহানন্দ তাঁর জীবদ্দশায় বড়ো মেয়ে জাহ্নবীর বিয়ে দিয়ে গেছে । সরস্বতীর বিয়ে তখনও বাকি। ছোটোভাই নুটুবিহারী, মা মৃণালিনী, সবার দাদা! তো জ্যেষ্ঠসন্তান বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ট্যুইশনি করে, খেয়ে-না-খেয়ে দুরূহ-কঠিন সব দায়িত্ব পালন করে যান বিভূতি; চালিয়ে যান পড়ালেখা, মনুষ্যত্বের সাধনা।

শিক্ষা:

কথকতার বায়না নিয়ে মহানন্দ সপরিবার হুগলি জেলার শাগঞ্জ-কেওটায় প্রায় দেড় বছর বসবাস করেন (১৩০৫-১৩০৭)। এখানে প্রসন্নচরণ মোদকের পাঠশালা হাতেখড়ি হয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর! অকস্মাৎ পাঁচবছরের শিশুপুত্র ইন্দুভূষণ হুপিং কাশিত মারা গেলে কেওটার পালা সাঙ্গ করে মহানন্দ সপরিবার ফিরলেন বারাকপুরে। কিছুদিন পরে মৃণালিনী পিত্রালয়ে গেলে সেখানে বিপিন মাস্টারের স্কুলে মাসখানেকের মতো যাতায়াত করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বারাকপুরে আসার পর মহানন্দের প্রতি-হরিমোহন রায়ের পাঠশালায় ভর্তি হলেও মাইনে যোগাতে না পারায় সেখান থেকে ফিরে আসতে হয় বিভূতিকে।

অতঃপর গোপালনগর গ্রামের রাখাল বাঁড়। পাঠশালায় ভর্তি হতে হয় তাকে। কিন্তু সরকারি অনুদানের অভাবে পাঠশালা বন্ধ হবার উপক্রম হলে বিভূতিকে বাড়িতেই পড়তে হয় পিতার তদারকিতে। কিছু পর আর টোল-চতুষ্পঠী নয়, মহানন্দ মহোৎসাহে বিভূতিকে ভর্তি করিয়ে দিন। গোপালনগরে গগন পালের ইউ পি স্কুলে। অল্প বেতনে মহানন্দও প্রাপ্ত হলেন অস্থায়ী সেকেন্ড মাস্টারের পদ। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ভ্রমণবাতিকগ্রস্ত মহানন্দ পালাতে শুরু করলেন। পিতার স্বভাব সংক্রমিত হলো পুত্রের মধ্যেও। তবু হেডমাস্টার গগন পাল দেখেন বার্ষিক পরীক্ষার শ্লেট-খাতায় বিভূতির আশ্চর্য মেধার স্বাক্ষর। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তরে উজ্জ্বল বুদ্ধির দীপ্তি। মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছে মহানন্দের ছেলে বিভুতি।

একসময় ইউ পি স্কুলের পাঠ সাঙ্গ হলে বিভূতি হয়ে ওঠে অরণ্যের মতো অশাসিত ইছামতীর ন্যায় উচ্ছল, পাখির মতো মুক্ত। ধারে কাছে যেহেতু কোনো উচ্চ বিদ্যায়তন নেই সেহেতু তাকে ভর্তি করানো হলো সাড়ে পাঁচ মাইল দূরবর্তী বনগাঁ হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে। তখন ১৯০৮ সাল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বয়স ১৪ বছরের। নিঃসন্দেহে শুরুটা অনেক দেরিতেই হয়েছে। তাই আর পেছন ফিরে তাকানো নয়, কেবলই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই এগিয়ে চলার পথে পিতার মৃত্যু, আর্থিক অনটন কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। স্কুলের বছর-শেষের পরীক্ষা তিনি বরাবরই প্রথম হয়েছেন। বিনা বেতনে পড়েছেন, ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছেন জীবনের পথে; পথের দেবতার আবাহনে-ইঙ্গিতে।

আরো পড়ুন:  অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও আলোকচিত্রী

১৯১৪ সালে বিভূতিভূষণ বনগ্রাম হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর তিনি পড়তে যান কলকাতায়। কলকাতায় পড়বার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি নিজেই। বনগ্রাম হাইস্কুলের ছাত্রবৎসল প্রধান শিক্ষক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়েরও ইচ্ছা বিভূতি কলকাতায় পড়ন। কলকাতায় বঙ্গবাসী করো। পরিবেশ বিভূতির ভালো লাগেনি। সেন্ট পলস কলেজ আর সিটি কলেজেও গিয়েছিলেন তিনি।

পরিশেষে রিপন কলেজে যে ভর্তি হয়েছিলেন তার মূল কারণ ছিল এ-কলেজের ছাত্রবেতন অন্যান্য কলেজের তুলনায় কম। কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুকাল ব্যবধানে তিনি সেন্ট পলস কলেজে রবীন্দ্রনাথকে দেখেন। কলেজ-জীবনে যাদের সংস্পর্শে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন ও অনুপ্রাণিতবোধ করেছেন তাঁরা হলেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যক্ষ আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিজ্ঞান কলেজের প্রাণপুরুষ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এইসব মহান বাঙালি ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শধন্য বিভূতি অভাব-অনটনের মধ্যেও অন্তর্লোকে অবিরাম লালন করেছিলেন শুভবোধ; উত্তীর্ণ হন প্রথম বিভাগে আইএ (১০১৬) এবং একই কলেজে ভর্তি হন বিএ ক্লাসে। ১৯১৮ সালে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন ও আইন বিভাগে এম এ শ্রেণিতে ভর্তি হন; কিন্তু নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তিনি এমএ সম্পন্ন করতে পারেননি।

বিবাহ:

১৩২৪ বঙ্গাব্দের ৩২ শ্রাবণ (১৯১৭) বিভূতিভূষণ বিয়ে করেন গৌরী দেবীকে। চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাটে মোক্তার ছিলেন পানিতর গ্রামের জমিদার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়। তাঁর চোদ্দবছরের মেয়ে গৌরী এলেন তেইশ বছরের যুবক বিভূতিভূষণের বউ হয়ে। গৌরী ছিলেন গৌরবর্ণা, রূপবতী। বিভূতি-গৌরীর ফুলশয্যা হয়েছিল বিভূতিভূষণের মামাবাড়িতে, মুরাতিপুর গ্রামে। ১৯১৮ সালে বিভূতিভূষণ গৌরীকে নিয়ে এসেছিলেন বারাকপুর গ্রামে। এই বছরেই ১৯১৮ সালের ২২ নভেম্বর (৬ অগ্রহায়ণ ১৩২৫) নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পিত্রালয়ে মৃত্যু হয় গৌরী দেবীর। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনে অন্তসত্তায় গৌরীর প্রভাব ছিল সুদূরসঞ্চারী বলা যায় দীর্ঘস্থায়ী। গৌরীকে তিনি বিস্মৃত হননি একদিনের জন্যেও। তবু ২২ বছর পর ১৯৪০ সালের ৩ ডিসেম্বর ছেচল্লিশ বছর বয়সে ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের অষ্টাদশী কন্যা রমা দেবীর (ডাকনাম কল্যাণী) সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিভূতিভূষণ। এই বিয়ে হয়েছিল রমা দেবী এবং তার পরিবারের ইচ্ছানুক্রমে। বয়সের অসমতা সত্ত্বেও এই দম্পতি যাপন করেছেন সুখীজীবন। বিভূতিরমা দেবীর একমাত্র সন্তান তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (ডাকনাম বাবলু)। তার জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অক্টোবর।

কর্মজীবন:

আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ছাত্রজীবন থেকেই টিউশনি করেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্রজীবন শেষে, গৌরী দেবীর মৃত্যুর ঠিক আড়াই মাস পরে, হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে অস্থায়ী প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন তিনি, বেতন পঞ্চাশ টাকা। এই স্কুলে যোগদান করেন ১৯১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯২০-এ প্রায় একবছরের ব্যবধানে এই চাকরি ছেড়ে দিতে হয় তাকে। এ-বছর ১ জুলাই তিনি সহকারী শিক্ষকপদে যোগ দেন সোনারপুর-হরিনাভির সুপ্রাচীন বিদ্যায়তন হরিনাভি অ্যাংলো স্যানসক্রিট ইন্সটিটিউশনে। ১৭ জুলাই ১৯২২ সালে সোনারপুর পরিত্যাগ করেন তিনি। অতঃপর মাড়োয়ারি কেশোরাম পোদ্দারের ‘গো-রক্ষিণী সভা’র প্রচারকের চাকরি নিয়ে তিনি গো-সম্পদ রক্ষার প্রচারকার্যে ব্যস্ত ছিলেন এ-বছরের শেষ পর্যন্ত।

এই চাকরির সুবাদে তিনি কুষ্টিয়া, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, মাদারিপু, বরিশাল, ঢাকা, আগরতলা, নোয়াখালি, ফেনি, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংডু, সিঙজু, আরাকান, আকিয়াব প্রভৃতি অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছেন। প্রত্যক্ষ করেছি প্রকৃতি ও নিসর্গের অবারিত সৌন্দর্য; মানবভূগোলের বৈচিত্র্যময় ঐশ্বর্য।

বিভূতিভূষণ পরবর্তী কর্মক্ষেত্র কলকাতার খেলাতচন্দ্র ঘোষ এস্টেট। পাথুরিয়াঘাটার জমিদার খেলাতচন্দ্র ঘোষের পৌত্র সিদ্ধেশ্বর ঘোষের পিতৃমাতৃহীন ভাগ্নে বিভূতি নোসর গৃহশিক্ষকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন বিভূতিভূষণ; দিনটি ছিল ১৯২৩ সালের ১ জানুয়ারি। এরপর সিদ্ধেশ্বর ঘোষের জমিদারি সেরেস্তায় চাকরি করেছেন। গৃহশিক্ষকের মাসি বেতন ছিল ত্রিশ টাকা, জমিদারি সেরেস্তায় হলো চল্লিশ। তারপর ঘোষ এস্টেট পূর্ণিয়া-ভাগলপুর জঙ্গলমহালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছেন বিহারে। মাইনে হয়েছে মাসে পঞ্চাশ টাকা। ১৯২৯ সালে বিহার থেকে এসে যোগ দিয়েছেন সিদ্ধেশ্বর ঘোষের প্রতিষ্ঠিত স্কুল খেলাতচন্দ্র ক্যালকাটা ইন্সটিটিউশনে বাংলার শিক্ষক হিসেবে। এ চাকরি তিনি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেন ১ ডিসেম্বর ১৯৭১। উদ্দেশ্য বারাকপুরে গিয়ে স্বাধীন-জীবননির্বাহ, জনকোলাহলমুক্তি এবং সাহিত্য।[১] ১৯৪১ সালের ১৬ আগস্ট রমা দেবীকে লিখিত পত্রে তার আভাস মেলে—

আরো পড়ুন:  পল লাফার্গ ছিলেন বিপ্লবী মার্কসবাদী, সাহিত্য সমালোচক এবং রাজনৈতিক লেখক

‘ভালো করে বিবেচনা করে দেখলাম চাকরি ছাড়া আমার পক্ষে সঙ্গত ।…বারাকপুর সস্তার জায়গা এবং কলকাতার নিকটে। ওখানে বসে লিখলে এবং কলকাতার বইয়ের দোকানে দিলে আমার যা আয় হবে তা বর্তমান  অপেক্ষা কম নয়।…রোজ যদি ৩ পাতা লিখি তবে ৩৬০ দিনে (এক বছর) আমি লিখবো …১০৮০ পাতা। যা ৪ খানা বড়ো উপন্যাস। সেই জায়গায় বাদ দিয়েও লিখব তিন খানা উপন্যাস-ধরো যদি সবদিন তিন পাতা লিখতে নাও পারি। তাতে ২০০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা বইয়ে আয় দাঁড়ায়। তার ওপর যদি আমি কিছু ধানের জমি করি, তবে ঘরের ভাত ঘর থেকেই হলো। …২০০০ টাকাও যদি বছরে আয় , তবে বারাকপুরের মাসিক খরচা মাসে মাত্র ২৫ টাকা কি ৩০ টাকা হিসাবে ৩১৬ টাকা বছরে। নুটুকে ৪০ টাকা ধরে ৪৮০ টাকা। মোট ব্যয় ৩৬০+৪৮০= ৮৪০ টাকা। বছরে ১১৬০ টাকা বা ধরো ১০০০ টাকা জমা সোজা কথা নয়। দশ বছরে, দশ হাজার টাকা হাতে জমে যাবে।…আমার বর্তমান আয় বছরে ২৫০০ টাকার নেশা নয়। স্বাধীনভাবে যদি ওই টাকাই পাই তাতে কলকাতার খরচ লাগবে না অথচ ভালও খাবো ও থাকবো। স্বাধীনভাবে থাকলে লেখার দিকও ভালো হবে।…কি বোকামি করেচি বছর দুই আগে চাকুরী ছেড়ে না দিয়ে। হাতে আরও অনেক টাকা জমতো। শুধু বারাকপুর কেন, আমরা যে কোনো ভালো জায়গায় থাকতে পারি-কলকাতা শহর বাদে। এখানে থাকার বাধা প্রথম তো খরচ বেশি হয়, বড়ো ভিড় লোকের। সর্বদা আসবে আমাকে বিরক্ত করতে। তাতে ৩ পাতা লিখবার সময়ও পাবো না । সময় নষ্ট হবে বড়।’ [২]

কলকাতা ছেড়ে বারাকপুরে চলে আসার কিছুদিন পর তিনি বনগাঁর নিকটবর্তী গোপালনগর হরিপদ ইন্সটিটিউশনে শিক্ষকতা শুরু করেন। অতঃপর ১৯৫৫ সালে ৬ সেপ্টেম্বর বনগাঁ কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে অধ্যাপক পদে নিয়োগদান করেন। কথা ছিল পুজোর ছুটির পরে ১৬ নভেম্বর কলেজ খুললে তিনি ক্লাস নেবেন; কিন্তু আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তাঁর সেই স্বপ্নকাক্ষা অপূর্ণ থেকে যায়।

সাহিত্যসাধনা:

১৯২২ সালে বিভূতিভূষণ ছিলেন সোনারপুর-হরিনাভি স্কুলের শিক্ষক; থাকতেন রাজপুরে, নগেন বাগচির বাড়িতে। তখন বর্ষাকাল, বৈঠকখানা ঘরের সামনের ছোট্ট বারান্দায় বসে সদর রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিভূতিভূষণ। এমন সময় একটি ষোলো-সতেরো বছরের ছেলেকে বই-হাতে যেতে দেখে তিনি তাকে ডাকলেন। জানা গেলো তার নাম পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী (আসল নাম যতীন্দ্রমোহন রায়), কিন্তু এ গ্রামে সবাই তাকে বালক-কবি বলে জানে। সে কবিতা লেখে । তাদের গ্রাম থেকে বিশ্ব নামে যে পত্রিকা বেরোয়, সেখানে ‘মানুষ’ নামে কবিতা লিখেছে পাঁচুগোপাল। তার বিশ্বাস, বিভূতি যেহেতু বিএ পাশ, সেহেতু তার পক্ষে সাহিত্যচর্চা সহজ। তাই তার প্রস্তাব— ‘আসুন আপনাতে আমাতে…উপন্যাস সিরিজ বের করা যাক। খুব বিক্রি হবে…আপনি যদি ভরসা দেন, আমি উঠে পড়ে লাগি।…আপনি যখন বি-এ পাস, তখন আপনার কাছে এমন কিছু কঠিন হবে না। কিন্তু বিভূতিভূষণ তো সাহিত্য রচনার ধারেকাছেই নেই। তবু তাঁর মতের অপেক্ষা না করেই দশদিনের মধ্যে স্কুলের নোটিশ-বোর্ডে, দেওয়ালের গায়ে, নারকেল গাছের গুঁড়িতে, আশপাশের দু-পাচটা গ্রামে ছাপানো কাগজের পোস্টার সেটে দেয়া হলো : ‘বাহির হইল! বাহির হইল!! বাহির হইল!!! একটাকা মূল্যের গ্রন্থমালার প্রথম উপন্যাস চঞ্চলা! লেখক শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজটি পাঁচুগোপালের, কিন্তু এখানে-ওখানে। জবাবদিহি করতে হচ্ছে বিভূতিভূষণকে। কী কেলেঙ্কারি কাণ্ড! অনন্যোপায় বিভূতিভূষণ অতঃপর হাতে তুলে নিলেন কলম, লিখলেন ছোটোগল্প ‘উপেক্ষিতা’; ছাপা হয় সেকালের স্বনামখ্যাত পত্রিকা প্রবাসীতে। তখন ১৯২২ সাল, বয়স তাঁর আটাশ বছর। পরবর্তী আটাশ বছর বিরতিহীন সাহিত্যসাধনায় তিনি রচনা করেছেন ৬০টি গ্রন্থ : উপন্যাস ১৫টি, ছোটোদের উপন্যাস ৭টি, ছোটগল্পগ্রন্থ ১৯টি, অনুবাদগ্রন্থ ৩টি, ভ্রমণগ্রন্থ ২টি, দিনলিপি ৫টি, বারােয়ারি উপন্যাস ৪টি এবং বিচিত্র গদ্যরচনা ৫টি। পথের পাঁচালী তাঁর প্রথম উপন্যাস; যার মাধ্যমে তিনি অর্জন করেছেন পাঠক-পরিচিতি, বিশ্বখ্যাতি।

আরো পড়ুন:  বের্টোল্ট ব্রেশট আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় কবি

গ্রন্থ তালিকা:

উপন্যাস:

১. পথের পাঁচালী (১৯২৯; পরিবর্ধিত দ্বি, সং, ১৯৩২) ২. অপরাজিত (১৯৩২) ৩. দৃষ্টি-প্রদীপ (১৯৩৫) ৪. আরণ্যক (১৯৩৯) ৫. আদর্শ হিন্দু-হোটেল (১৯৪০) ৬. দুই বাড়ি (১৯৪১) ৭. বিপিনের সংসার (১৯৪১) ৮. অনুবর্তন (১৯৪২; পরিবর্ধিত দ্বি, সং, ১৯৪৩) ৯, দেবযান (১৯৪৪; পরিবর্ধিত দ্বি, সং, ১৯৪৬) ১০. কেদার রাজা (১৯৪৫) ১১. অথৈ জল (১৯৪৭) ১২. ইছামতী (১৯৫০)

মৃত্যুর পরে প্রকাশিত:

১৩. দম্পতি (১৯৫২) ১৪. অশনি সংকেত (১৯৫৯) ১৫. অনশ্বর (অসমাপ্ত; ১৯৭২)

ছোটোদের উপন্যাস:

১. চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭) ২. মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০) ৩. মিসমীদের কবচ (১৯৪২) ৪. ছোটদের পথের পাঁচালী (১৯৪৪) ৫. আম-আঁটির ভেঁপু (১৯৪৪) ৬. ছেলেদের আরণ্যক (১৯৪৬) ৭. হীরামানিক জ্বলে (১৯৪৬)

ছোটগল্প:

১. মেঘমল্লার (১৯৩১) ২. মৌরীফুল (১৯৩২) ৩. যাত্রাবদল (১৯৩৪) ৪. জন্ম ও মৃত্যু (১৯৩৭) ৫. কিন্নর দল (১৯৩৮) ৬. বেনীগীর ফুলবাড়ি (১৯৪১) ৭. নবাগত (১৯৪৪) ৮. তালনবমী (১৯৪৪) ৯. উপলখণ্ড (১৯৪৫) ১০. বিধু মাষ্টার (১৯৪৫) ১১. ক্ষণভঙ্গুর (১৯৪৫) ১২. অসাধারণ (১৯৪৬) ১৩. মুখোশ ও মুখশ্রী (১৯৪৭) ১৪. আচার্য কৃপালনী কলোনী (১৯৪৮), (১৯৫৯ সালে নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব নামে প্রকাশিত) ১৫. জ্যোতিরিঙ্গণ (১৯৪৯) ১৬. কুশল পাহাড়ী (১৯৫০) মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ১৭. রূপহলুদ (১৯৫৭) ১৮. অনুসন্ধান (১৯৬০) ১৯. ছায়াছবি (১৯৬০)

ছোটোদের সঙ্কলন:

১. বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৪৭) ২. ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৫৫) ৩. গল্প-পঞ্চাশৎ (১৯৫৬) ৪. সুলোচনা (১৯৬৩) ৫. প্রেমের গল্প (১৯৬৩) ৬. অলৌকিক (১৯৬৩) ৭. বিভূতি-বিচিত্রা (১৯৬৪) ৮. বাক্সবদল (১৯৬৫) ৯. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিশোর-সঞ্চয়ন (১৯৬৫) ১০. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোদের ভালো ভালো গল্প (১৯৬৫) ১১. বিভূতি বীথিকা (১৯৭০)

অনুবাদ:

আইভ্যানহো (১৯৩৮) ॥ টমাস বাটার আত্মজীবনী (১৯৪৩)

ভ্রমণ কাহিনি:

অভিযাত্রিক (১৯৪১) ॥ বনে-পাহাড়ে (১৯৪৫) ॥  হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮) ॥

দিনলিপি:

স্মৃতির রেখা (১৯৪১) ॥ তৃণাঙ্কুর (১৯৪৩) ॥ ঊর্মিমুখর (১৯৪৪) ॥ উল্কর্ণ (১৯৪৬) অন্তরঙ্গ দিনলিপি (১৯৭৬) ।

বারোয়ারি উপন্যাস, অন্যদের সঙ্গে লেখা:

কো-এডুকেশন (১৯৪০) ॥ মীনকেতুর কৌতুক (১৯৪১) ॥ পঞ্চদশী (১৯৪১) সুন্দরবনে সাত বৎসর (১৯৫২)।

বিচিত্র গদ্য-রচনা বিচিত্র:

জগৎ (১৯৩৭) ॥ অভিনব বাঙলা ব্যাকরণ (১৯৪০) ॥ সিমলা কালী বাড়ি পরিচয় (১৯৪৭) ॥ আমার লেখা (১৯৬১) ॥ বিপুলা এ পৃথিবী (১৯৮৭)।

মৃত্যু:

১৯৫০ সালের ২৯ অক্টোবর ধলভূমের রাজা কর্তৃক বৈকালিক চায়ের সভায় নিমন্ত্রিত হয়ে একদল সাহিত্যিকের সঙ্গে সেখানে যান বিভূতিভূষণ। রাজবাড়িতে জলযোগের সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। রাতেই গাড়িযোগে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঘাটশিলায় নিজগৃহে। অতঃপর দুইদিন আচ্ছন্নতায় কাটে। ১ নভেম্বর ১৯৫০ রাত্রি ৮টা ১৫ মিনিটে জীবনাবসানের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বিভূতিভূষণ বললেন, ‘বাবলু কই’? অন্তিম মুহূর্তে তার চোখ ছিল পুত্র বাবলুর দিকে, মুখে ছিল সরল-নিস্পাপ হাসি।[৩]

তথ্যসূত্র:

১. ভাষাপ্রকাশ নির্বাচিত শ্রেষ্ট গল্পমালা , বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রেষ্ট গল্প; ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ  ফেব্রুয়ারি, ২০১৬; পৃ: ২৩৩-২৩৯।

২ . কিশলয় ঠাকুর,পথের কবি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমি, কলকাতা , চতুর্থ মুদ্রণ ডিসেম্বর ১৯৯৭, পৃষ্ঠা-২৫৩-৫৪।

৩. ভাষাপ্রকাশ নির্বাচিত শ্রেষ্ট গল্পমালা প্রাগুক্ত, পৃ: ২৩৩-২৩৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!