ডেনিস দিদেরো ফরাসি বিপ্লবের প্রস্তুতকারী মহান দার্শনিক ও লেখক

ডেনিস দিদেরো বা দিদেরত (ইংরেজি: Denis Diderot; ৫ অক্টোবর ১৭১৩ – ৩১ জুলাই ১৭৮৪ খ্রি.) ছিলেন অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ। একাধারে দার্শনিক, লেখক, সমালোচক ও শিল্পী দিদেরোকে সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। দিদেরোর স্থান বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের পুরোভাগে।[১]

দিদেরো ফ্রান্সে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের জন্য ‘বিশ্বকোষ’ রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন মুক্তবুদ্ধির যে পথিকৃতরা তাঁদের অন্যতম ছিলেন। ইংল্যাণ্ডে প্রকাশিত সেকালের বিশ্বকোষের আদর্শে দিদেরো ফরাসি ভাষায় বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির উপর বিশ্বকোষ রচনার কথা চিন্তা করেন। এ কাজে তার অপর এক সঙ্গী ছিলেন ডি’ আলেম্বার্ট।[২]

বিরাট প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দিদেরো এবং ডি’ আলেম্বার্ট জ্ঞান প্রচারের এই পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকলে ১৭৫৯ সনে সামন্তবাদী সরকার এ পরিকল্পনার কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এমন অবস্থায় অনেক সঙ্গী তাঁকে পরিত্যাগ করেন। কিন্তু দিদেরো পরাজয় স্বীকার না করে শ্রমজীবী মানুষের কর্মস্থলে গোপনে যাতায়াত করে বাস্তব জীবনের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। তার এই অদম্য চেষ্টা ক্রমান্বয়ে তাঁকে ফরাসি বিদ্বৎ মহলে সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। অভিজাত শ্রেণির উদারপন্থী ব্যারণ এবং লেখক ডি হলবাক তাঁর পৃষ্ঠপোষক হন। বিশ বছরের চেষ্টায় ফরাসি বিশ্বকোষের যে ১৭টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল, সে জ্ঞানকোষ ফরাসি জনমানসে নতুন বৈজ্ঞানিক ও ইহজাগতিক এক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল।

দারিদ্র্যের কারণে নিজের অপরিসীম পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত তার গ্রন্থাগার বিক্রি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন গ্রন্থাগারটি ক্রয় করে, গ্রন্থাগারটিকে প্যারিস থেকে স্থানান্তর না করে প্যারিসে দিদেরোকে তার গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত করেন। বিশ্বকোষ তৈরির উদ্যোগের পূর্বে দিদেরো ফরাসি দেশের প্রচলিত ব্যবস্থার অন্যায় এবং কুসংস্কারকে ব্যঙ্গ করে যে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সরকার তা নিষিদ্ধ করে দিদেরোকে কারাগারে বন্দি করেছিল। কিন্তু কোনো নির্যাতন শুভবুদ্ধির প্রবক্তা দিদেরো দমিত করতে পারে নি।

দিদেরো দীর্ঘকাল ‘নবীন ও উন্মাদ’ (jeune et fou) ছিলেন। কঠিন শ্রমের মূল্যে তিনি শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া ভদ্রলোকে পরিণত হন এবং বিত্তশালী ব্যাঙ্কমালিক ও করসংগ্রাহকের সমাজে গৃহীত হন। মেয়ের বিয়ে দেন বনেদী আংগ্রায়া পরিবারে।

বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা থেকে তিনি ক্রমশ নানা সমস্যার দ্বন্দ্বমূলক বিচারে পৌঁছান এবং বস্তুবাদী নাস্তিকে পরিণত হন। কিন্তু তৎকালীন নানা স্ববিরোধিতার সমাধানের জন্যেই তিনি এই তত্ত্বে পৌছান। এখানেই দিদেরোর মৌলিকতা। তিনি প্রধানত গতিশীলতার ব্যাখ্যাকার এবং এই ব্যাখ্যা মানুষের ভিতরের ও বাইরের পরিবর্তন, মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর মননপ্রসূত। তিনি কোনো পূর্ণাঙ্গ তন্ত্র রচনা করেন নি, বিশ্বজগতের কোনো সুশৃঙ্খল, সুসমন্বিত রূপরেখাও আঁকার চেষ্টা করেন নি। 

তাঁর চিন্তা স্ববিরোধিতাপূর্ণ, এবং এ-সম্পর্কে তিনি সচেতন। দিদেরো চেয়েছিলেন মানুষ তার অখণ্ড সমগ্রতায় তার দার্শনিক জ্ঞানান্বেষণের কাছে ধরা দেবে। সুতরাং দিদেরার বস্তুবাদ নাস্তিকের যুক্তিসহ ভিত্তিমাত্র নয়। শারীরতত্ত্ববিদদের আহৃত জ্ঞান অবলম্বন করে দিদেরো বস্তুবাদের দুটি প্রধান সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিলেন: অচেতন জড় পদার্থের জীবন্ত পদার্থে উত্তরণের সমস্যা ও জীবন্ত পদার্থের সংগঠনের সমস্যা। খ্রিস্টীয় দ্বৈতবাদের পরিবর্তে তিনি বস্তুবাদী অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা। কিন্তু মানুষ তার জৈবিক সংগঠনের দ্বারা সংকীর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত, মানুষের চিন্তা ও কর্ম বস্তুর আন্দোলনের প্রতিফলন মাত্র, এই যান্ত্রিক বস্তুবাদ থেকে দিদেরোর প্রত্যয় অনেক দূরে। তার মতে এ-জাতীয়, বস্তুবাদী নিয়ন্ত্রণবাদ মানুষের স্বাধীনতার অস্বীকৃতি। পরিপার্শ্বের পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মানুষের সহজাত। এই ক্ষমতাই মানুষকে মনুষ্যত্ব দিয়েছে, অন্যান্য জীব থেকে আলাদা করেছে।

দিদেরো রচনাবলী

দিদেরো বিশ্বকোষ রচনা করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। Pensees Philo sophiques ও Promenade d’un Sceptique থেকে Rêve do Alenbert-এ এসে দিদেরোর চিন্তা সুনির্দিষ্ট হয় ও গভীরতা লাভ করে।

দিদেরার চিন্তায় রোমান্টিক অভিজ্ঞতার প্রাধান্য। এই অভিজ্ঞতা তার দার্শনিক প্রত্যয়কে জীবন্ত করে তুলেছে। দিদেরোর মতে মানুষ কোনো বিমূর্ত নীতি অনুসরণ করে জীবনযাপন করে না। সুখের অভীপ্সাই একমাত্র নৈতিকতা। এই অভীপ্সার প্রচণ্ড আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলো la Religieuse অথবা Jacques le Fataliste। উপন্যাসে ও ছোটো গল্পে যেখানে দিদোরো জীবন্ত মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তাদের মধ্যেই তার নৈতিকতা খুঁজতে হবে। কারণ, একমাত্র জীবনের আভজ্ঞতার স্তরেই তার নৈতিক অর্থময় হয়ে ওঠে। দিদেরার অন্যান্য উভেখযােগ্য রচনা: Prospectus de Encydopedie; le fils naturel on les epreuves de la vertu, Entretien avec le fils naturel : Dorval et moi; Essai sur la vie de Sénèquo ; Essai sur les rêgnos do Claude et de Neron ; Refutation d’Helvetius প্রভৃতি।[৩]

দিদেরোর জীবনকালেই তিনি ফরাসি দেশের অন্যতম অগ্রসর চিন্তানায়ক এবং লেখক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি সত্য এবং মিথ্যা সম্পর্কে যেসব উক্তি করেছিলেন সেসবের ভেতরে একটি হচ্ছে যে, “যেসব মিথ্যা আমাদের তোষামোদ করে সেগুলোকে আমরা লোভের সাথে গিলে খাই, কিন্তু যেসব সত্যকে আমরা তিতকুটে দেখি, সেগুলো আমরা খুব অল্প অল্প করে চুমুক দিয়ে খাই।”

তথ্যসূত্র:

১. অনুপ সাদি, ২০ মার্চ, ২০১৮, “ডেনিস দিদেরো ফরাসি বিপ্লবের প্রস্তুতকারী মহান দার্শনিক ও লেখক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/denis-diderot/
২. সরদার ফজলুল করিম, দর্শনকোষ, প্যাপিরাস, পঞ্চম সংস্করণ, জুলাই ২০০৬, পৃষ্ঠা ১৩৮।
৩. প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী, ফরাসী বিপ্লব, পৃষ্ঠা ৪৭৭-৪৭৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!