কৌটিল্য বা চাণক্য প্রাচীন ভারতীয় কূট রাজনৈতিক গুরু ও অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা

কৌটিল্য বা চাণক্য (সংস্কৃত: चाণक्य) (আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের (আনুমানিক ৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ – ২৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) উপদেষ্টা ও প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর ক্ষমতার উত্থানের স্থপতি, প্রাচীন ভারতীয় কূটকৌশলী রাজনৈতিক গুরু ও সামন্তবাদী দার্শনিক এবং অর্থশাস্ত্র নামক গ্রন্থের রচয়িতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিষয়ে প্রাচীন ভারতে তিনি ছিলেন একজন দিকপাল। অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বিচক্ষণতার অধিকারী কৌটিল্য সমকালীন পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তক প্লেটো ও এরিস্টটলের সমতুল্য স্পষ্ট ও মৌলিক ছিলেন। কেবল কৌটিল্য নয়, ইতিহাসে তাঁকে চাণক্য এবং বিষ্ণুগুপ্ত বলেও উল্লেখিত হতে দেখা যায়।[১]

গ্রিক সম্রাট আলেক্সান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সনে ভারত অভিযানে আসেন। কৌটিল্যকে এই সময়কার রাজনীতিক বলে অনুমান করা হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, গ্রীকরা ভারতে আক্রমণ করার সময় তিনি তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন এবং গ্রিকদের বিতাড়ন করার প্রতিশ্রুতি দেন।[২]

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের অব্যবহিত পরে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রাহ্মণ পন্ডিত কৌটিল্য বা চাণ্যক্য চন্দ্রগুপ্তের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী এক রাজার কাছ থেকে রাজ্য অধিকারে কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রণাদাতা হিসাবে কাজ করেন এবং চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।

কৌটিল্য বা চাণক্যের পরিচয়

প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার একজন উল্লেখযোগ্য দিকপাল কৌটিল্য খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ অব্দে এক বিদ্যোৎসাহী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান সম্পর্কে নানা মত প্রচলিত রয়েছে। বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবংশটীকা অনুসারে তক্ষশীলায় তার জন্ম। জৈন পুঁথি ‘অদ্বিধন চিন্তামণি’ অনুযায়ী তিনি দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী ছিলেন। হেমচন্দ্র প্রণীত ‘পরিশিষ্টপর্ব’ গ্রন্থানুসারে তিনি চণক নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কৌটিল্য প্রাচীন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। চাণক্য নিজের তীক্ষ্ম বুদ্ধির প্রভাবে বেদসমূহ ও নীতি শাস্ত্রসমূহে পারদর্শিতা অর্জন করেন।

শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর সেখানেই অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে যৌবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে তিনি নন্দবংশের রাজা ধন নন্দের রাজদরবারে চাকরি গ্রহণ করে অমাত্যের পদে অধিষ্ঠিত হন। অচিরেই রাজার সঙ্গে তাঁর মতদ্বৈততা দেখা দেয়। এ দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কারণে একদিন ভােজনের সময় তিনি রাজা কর্তৃক ধিকৃত হয়ে অপমানজনকভাবে রাজদরবার ত্যাগ করেন। তাঁর প্রতি নন্দ রাজার অসম্মানের প্রেক্ষাপটে তিনি নন্দ সাম্রাজ্য ধ্বংস করার প্রতিশােধমূলক প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। 

একদিকে নন্দ সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধন এবং অন্যদিকে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন—এ দ্বিবিধ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর শিষ্য উচ্চাভিলাষী তরুণ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে প্রশিক্ষিত করে তােলেন। কৌটিল্যের পরামর্শে চন্দ্রগুপ্ত স্থানীয় অধিবাসীদের সংঘবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন। অতঃপর কৌটিল্য অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সক্ষম হন। অর্থাৎ নন্দরাজবংশের ধ্বংস সাধন করে মৌর্যবংশের চন্দ্রগুপ্তকে মগধ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরােহণ করান। খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ অব্দে চন্দ্রগুপ্ত সম্রাট হন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে কৌটিল্যকে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন।[৩]

কৌটিল্য ও অন্যান্য নাম বিভ্রাট

কৌটিল্যের ব্যক্তিপরিচয় সম্পর্কে তাঁর তিনটি নাম পাওয়া যায়। যথা: চাণক্য, বিষ্ণুগুপ্ত এবং কৌটিল্য। প্রথমত, তাঁর পিতা ছিলেন চাণক্য ঋষি, এজন্য তাঁর নাম হয়েছিল চাণক্য। অথবা চণক নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল চাণক্য, এই অভিমতও কেউ কেউ পোষণ করেন। 

দুই, কৌটিল্যের দ্বিতীয় নাম বিষ্ণুগুপ্ত। কামন্দকীয় নীতিসার, দণ্ডীর দশকুমার চরিত, বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস নাটক ইত্যাদি গ্রন্থে অর্থশাস্ত্র রচয়িতা হিসেবে বিষ্ণুগুপ্তের নাম পাওয়া যায়। প্রচলিত ধারণানুযায়ী, বিষ্ণুগুপ্ত কৌটিল্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম।

তিন, বিষ্ণুগুপ্ত তথা চাণক্যের একটি তৃতীয় নাম রূপে কৌটিল্য এই সংজ্ঞাপদটির উল্লেখ বহুস্থানে পাওয়া যায়। বস্তুত কৌটিল্য এই বিশেষ নামেই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। অর্থশাস্ত্র গ্রন্থেও ‘ইতি কৌটিল্য’ বা ‘নেতি কৌটিল্য’ ইত্যাদি উক্তির দ্বারা, অর্থশাস্ত্রের প্রবক্তারূপে কৌটিল্য নামটিই উল্লিখিত হয়েছে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, কৌটিল্য পদটি ‘কুটিল’ শব্দ থেকে উৎপন্ন ভাববাচক বিশেষ্য এবং এর অর্থ কুটিলমতিত্ব। 

তবে এই বিবরণটিই সর্বজনবিদিত যে, বিষ্ণুগুপ্ত, চাণক্য এবং কৌটিল্য তিন নামের এই ব্যক্তিই তাঁর কুটবুদ্ধি কৌশলে নন্দবংশের ধ্বংস ঘটিয়ে মগধের সিংহাসনে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন এবং অর্থশাস্ত্র ঐ সময়েই অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। 

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র

কৌটিল্যের মহামূল্যবান গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র (ইংরেজি: Arthashastra) ভারতীয় রাজশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে প্রাচীনতম। প্রাচীনতম লিখিত গ্রন্থ হলেও রাজনীতি বিষয়ক আলোচনার সূত্রপাত যে এই গ্রন্থ থেকে হয়েছিল সে কথা বলা যায় না। ধারণা করা হয়, গ্রন্থ রচনার সময় কৌটিল্যের সামনে অর্থশাস্ত্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি ঐতিহ্য অবশ্যই ছিল এবং পূর্ণকালীন আচার্যগণের দন্ডনীতি বিষয়ক চিন্তাভাবনার মধ্যে সমন্বয় করে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থের সূচনায় স্পষ্ট ভাষায় তাঁর পূর্বসূরীগণের নিকট তিনি ঋণ স্বীকার করেছেন।

মূল নিবন্ধ: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র

কৌটিল্য ছিলেন রাজনৈতিক ইতিহাসে একজন বাস্তববাদী ও প্রথিতযশা ব্যক্তি। মেকিয়াভেলিকে যে কারণে ইউরোপের আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় ঠিক সেই একই কারণে কৌটিল্যকে প্রাচীন ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান তথা রাষ্ট্রদর্শনের জনক বলে গণ্য করা হয়। সার্বিক বিবেচনায় বিশ্ব জ্ঞানভান্ডারে যে সকল গ্রন্থ রচনা প্রসিদ্ধ লাভ করেছে কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র তাদের মধ্যে অন্যতম। কৌটিল্য এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি সর্বপ্রথম ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদাভাবে চিন্তা ভাবনা করেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পরিচিতি গ্রন্থটি ১৬টি খন্ডে বিভক্ত। তবে এরমধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে স্থান পেয়েছে। যথা :

১. প্রশাসন (Administration), 
২. কুটকৌশল (Diplomacy),
৩. অর্থশাস্ত্র (Economics)।

মহাজ্ঞানী পন্ডিত কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত হলো যে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি অনন্য গ্রন্থ এতে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। আবার অনেকের মতে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ছিল প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক অভিধান। ভারতের মহিশুরের পন্ডিত ড. আর শ্যামশাস্ত্রী সর্বপ্রথম কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটির একটি প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন ১৯০৯ সালে। পরবর্তীতে তিনি একে ভারতীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত করার প্রয়াস পান।[৪]

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ৫ জুন, ২০১৯, “কৌটিল্য ছিলেন প্রাচীন ভারতের কূট রাজনীতিজ্ঞ এবং অর্থশাস্ত্রের প্রণেতা”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/kau%e1%b9%adilya/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৫১-২৫২।
৩. বায়েজীদ আলম, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪
৪. মো. আবদুল ওদুদ, “কৌটিল্য”, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমাজ ও রাষ্ট্রের দার্শনিক চিন্তা, মনন পাবলিকেশন, প্রথম প্রকাশ, ১৪ এপ্রিল ২০০৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৬১৬-৬১৭।

রচনাকাল: ৫ জুন, ২০১৯, নেত্রকোনা, বাংলাদেশ।  

Leave a Comment

error: Content is protected !!