মোহিনী চৌধুরী ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের গীতিকার, কবি ও চিত্র পরিচালক

মোহিনী চৌধুরী বা মোহনীমোহন চৌধুরী (৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ – ২১ মে ১৯৮৭) ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের খ্যাতনামা গীতিকার, বাঙালি কবি ও চিত্র পরিচালক। চলচ্চিত্রে গান লিখতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন সেই শিল্পেও। তিনি সবসময় সক্রিয় ও উদ্যমী ছিলেন গান রচনায়। কয়েক সহস্র গান লিখেছেন মোহিনী চৌধুরী।

জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার ডহরপাড়া গ্রামে। শৈশব কৈশোর কেটেছে উত্তর কলকাতায়। নানা বিদ্যালয় বদল করে শেষ পর্যন্ত রিপন স্কুল থেকে বৃত্তিসহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রিপন কলেজ থেকে ইংরাজি সাহিত্যের সাম্মানিক স্নাতক।

বাংলা কাব্যসঙ্গীতকে তখন সমৃদ্ধশালী করেছেন প্রধানত পঞ্চগীতিকবি এবং তাঁদের পাশাপাশি আধুনিক বাংলা গানের ক্ষেত্রে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিলীপকুমার রায়, তুলসী লাহিড়ী, হীরেন বসু, অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরোকায়স্থ, শৈলেন রায়, প্রণব রায় প্রমুখ প্রবাদপ্রতিম সব গীতিকবির দল। বাংলা গানের সেই স্বর্ণ যুগেই আবির্ভাব ঘটেছিল মোহিনীমোহন চৌধুরীর এবং আদৃত হয়েছিলেন তিনি বিপুল ভাবে।

কর্মজীবনে চাকরি করেছেন একাধিক। জীবিকার জন্য কখনও ডাকঘরের চাকরি, কখনও চিত্র পরিচালনা, কখনও বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহা অথবা শিল্পপতি ডি. এন. ভট্টাচার্যের একান্ত সচিবের কাজ করেন।

মোহিনী চৌধুরীর বাড়িতে গানবাজনার পরিবেশ ছিল। বাবা এসরাজ বাজাতেন, কাকা ছিলেন সংগীতশিক্ষক। গীতকাররূপে তার আত্মপ্রকাশ ১৯৩৫ সালে বন্ধু বিনোদ লাহিড়ীর নাটকে গান রচনার সূত্রে। ১৯৩৮ নাগাদ জ্যেষ্ঠভ্রাতার প্রেরণায় অনেক গান লেখেন। ১৯৪২ সালে প্রথম গানের রেকর্ড বেরোয় । ক্রমেই তিনি গান লিখে যশস্বী হতে থাকেন। সব রেকর্ড কোম্পানিতেই ডাক পড়ে তার। চলচ্চিত্রে গান লিখতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন সেই শিল্পেও। তার মাত্র চুয়াল্লিশখানি গান নিয়ে বহু কাল আগে বেরিয়েছিল এক শীর্ণ সংকলন। জনপ্রিয়তা ছাড়া অন্য কোনো পুরস্কার পাননি আজও।

১৯৮৭ সালের ২১ মে রাত সাড়ে নয়টায় অকষ্মাৎ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বাংলার রোম্যান্টিক, সংগ্রামী-প্রতিবাদী ও শরণার্থী মোহিনী চৌধুরী। জীবনসঙ্গিনী লীলা চৌধুরীর জন্য রেখে গিয়েছিলেন লেখনীর কালি ও কলম খানি। লীলা চৌধুরী মারা যান ২০১৪ সালে। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে মোহিনী চৌধুরীর স্মৃতিবিজড়িত কোটালীপাড়ার ডহরপাড়া গ্রাম এবং ভ্রাতুষ্পুত্র গৌরঙ্গলাল চৌধুরীর বাড়ি ঘুরে দেখে যান লীলা চৌধুরী।

আরো পড়ুন:  হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন উপমহাদেশের বাংলা গণসংগীতের জননন্দিত মহাযোদ্ধা

মোহিনী চৌধুরীর গানের বিষয়

আবির্ভাব লগ্নেই মোহিনী চৌধুরী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি শুধু অন্য একজন কবি নন, তিনি অনন্য একজন গীতিকবি। সে সময় পুজোয় অনেক অনেক গান বের হত, শ্রোতারাও উন্মুখ হয়ে থাকতেন পুজোর গানের জন্য। ১৯৪৫ সালে পুজোর গানের মধ্যে কমল দাশগুপ্তের সুরে এবং সত্য চৌধুরীর কণ্ঠের একটি গান শ্রোতাদের উদ্বেলিত করে তুলেছিল। জনপ্রিয়তার বানভাসি ঢেউ সেদিন গানটিকে নিয়ে গিয়েছিল বাংলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। মানুষের মুখে মুখে ফিরছিল- ‘পৃথিবী আমারে চায়- রেখোনা বেঁধে আমায়, খুলে দাও প্রিয়া- খুলে দাও বাহুডোর’। অবাক-বিষ্ময়ে সেদিন শ্রোতারা দেখেছিলেন গানটির রচনা কৌশল। গানটি কোন তালিকাভুক্ত ? প্রেম- নাকি স্বদেশ? গানটিতে প্রেম আছে কিন্তু সে প্রেমকে অতিক্রম করে নিপীড়িত মানুষের কান্না ফুটে উঠেছে। ঘরে নয়, প্রিয়াকে বাইরে ডেকেছেন বঞ্চিত মানুষের কান্না-হাহাকার ঘুচাতে। ‘শোন না কি ঐ আজ দিকে দিকে হায়- কত বধু কাঁদে,- কাঁদে কত অসহায়, পথ ছেড়ে দাও, নয় সাথে চলো- মুছে নাও আঁখিলোর’।

আত্মভোলা তন্ময় কবির একান্ত আপন পৃথিবীতে তখন-‘বাতাসে জাগিছে বাতাবী ফুলের গন্ধ, বনে বনে জাগিছে ঝিল্লি-নূপুর ছন্দ’। আত্মহারা রোম্যান্টিক কবির হৃদয়ে জেগে উঠেছে চিরন্তন হাহাকার- ‘ভালবাসা মোরে ভিখারী করেছে, তোমারে করেছে রাণী’। আত্মমগ্ন এই প্রেমিক কবির হৃদয়ে ছিল মানুষের জন্য প্রেম-প্রীতি-করুণা। তাইতো প্রেমে নিমগ্ন সেই প্রেমিক কবিই আবার প্রেমকে রুদ্ররোষে ধিক্কার জানিয়ে লিখেছেন- ‘পরাধীন দেশে প্রেম চির অভিশপ্ত, মুক্তির পথে কত বাধা কত রক্ত’। জীবনে আত্মপ্রকাশের ঊষালগ্নেই- মানবতাবাদী, প্রতিবাদী ও জীবন-সংগ্রামী মোহিনী ‘তিমির-বিদার উদার অভ্যুদয়’-এর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তাইতো তিনি ‘দু’শো বছরের নিঠুর শাসনে গড়া পাষাণ বেদীকে ‘দুরন্ত বৈশাখী ঝড় হয়ে ভেঙে তছনছ করে দিতে চেয়েছেন। নারীকে শুধু কল্যাণময়ী, প্রেয়সী, নর্মসহচরী রূপে নয়, তিনি তাকে চেয়েছেন- মানসী, স্বপ্নসহচরী ও পথের সাথী রূপে। বাঙালির গার্হস্থ জীবনের অচলায়তনকে ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়ে প্রিয়াকে তাই তিনি ‘বহ্নিশিখা’ রূপে দেখতে চেয়েছেন।

আরো পড়ুন:  কত মধুরাতি এলো, এলো আর চলে গেল

মোহিনীর রোম্যান্টিক ভাবনায় শুধু কাব্যময়ই নয়, তাঁর সুতীব্র আবেগ অনায়াসেই ছুঁয়েছিল সকল বাঙালিকে। তিনি লিখেছেন ‘হায় কী যে করি মন নিয়া?-সে যে প্রণয় হুতাসে উঠে উছলিয়া’। বাঙালির প্রণয়কাতর হৃদয়ে তখন যেন অগচরে গেয়ে ওঠে- মোহিনীর লেখা আরেক গান- ‘এনেছি আমার শত জনমের প্রেম- আঁখিজলে গাঁথা মালা, ওগো সুদূরিকা আজও কি হবে না শেষ, তোমারি চাওয়ার পালা’?।

কুমিল্লার অবিস্মরণীয় গীতিকবি অজয় ভট্টাচার্যের অকাল প্রয়াণে (১৯০৬-১৯৪৩) শোকে মুহ্যমান শচীন দেববর্মণ মোহিনী চৌধুরীকে তাঁর জন্য গান লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। শচীন কর্তার জন্য তিনি লিখলেন বেশ কিছু গান। মীরা দেববর্মণের কণ্ঠে রেকর্ড হয় ‘কেন হায়, স্বপন ভাঙার আগেই’, ‘বাঁশি তোমার হাতে দিলাম’ গান দুটি। বাম কলামের গানগুলো শচীন দেববর্মণ গেয়েছেন, ডান কলামের গানগুলো মোহনীমোহন চৌধুরীর কয়েকটি জনপ্রিয় গান:

১. হায় কী যে করি মন নিয়া

২. ও প্রেম যমুনায় হয়তো কেউ ঢেউ দিল ঢেউ দিল,

৩. ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে,

৪. সেই যে দিনগুলি- বাঁশি বাজাবার দিনগুলি,

৫. এই চৈতী সন্ধ্যা যায় বৃথা,

৬. কেন হায় স্বপন ভাঙার আগে,

৭. ভুলায়ে আমায় দুদিন,

৮. কে আমারে আজও পিছু ডাকে,

৯. গায় যে পাপিয়া,

১০. আজ দোল দিল কে প্রাণে,

১১. পিয়া সনে মিলন পিয়াস,

১২. কে দিল ঘুম ভাঙায়ে,

১৩. মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান – শিল্পীঃ কৃষ্ণচন্দ্র দে।
১৪. পৃথিবী আমারে চায়- রেখোনা বেঁধে আমায়- শিল্পীঃ সত্য চৌধুরী।
১৫. ভালবাসা মোরে ভিখারী করেছে-তোমারে করেছে রাণী- শিল্পীঃ জগন্ময় মিত্র।
১৬. ভুলি নাই ভুলি নাই, নয়নে তোমারে হারায়েছি প্রিয়া – শিল্পীঃ জগন্ময় মিত্র।
১৭. আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তুমি যে বহ্নিশিখা – শিল্পীঃ জগন্ময় মিত্র।
১৮. যাদের জীবন ভরা শুধু আঁখিজল – শিল্পীঃ জগন্ময় মিত্র।
১৯. ঝরা ফুলে ভরা এই যে সমাধীতল – শিল্পীঃ জগন্ময় মিত্র।
২০. এনেছি আমার শত জনমের প্রেম – শিল্পীঃ গৌরীকেদার ভট্টাচার্য।

আরো পড়ুন:  বিনয় রায় রাজনৈতিক কর্মী এবং আধুনিক বাংলা গানের গীতিকার

১৯৪৪ সালে মোহিনী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন লীলা চেীধুরীর সঙ্গে। জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গীতানুরাগ তাঁকে গান লিখতে প্রেরণা যুগিযেছিল আজীবন। এক সময় ছায়াছবির শিল্পজগৎ তাঁকে আকৃষ্ট করে। ‘রায়-চৌধুরী’ ছবিতে সহকারী পরিচালকের কাজ করেন প্রথমে। তাঁর লেখা গানের বিপুল জনপ্রিয়তা আবার ছবির প্রতি মোহিনীর তীব্র আকর্ষণ এবং পার্লামেন্টারীতে চাকুরী। সময়ের অভাবে এবং শিল্পের টানে অদূরদর্শী মোহিনী ১৯৪৭ সালে গুরুত্বপূর্ণ সে চাকুরী ছেড়ে দেন।

ছবি করবার নেশায় পেয়ে বসে মোহিনীকে। ছবি (সাধনা) করতে গিয়ে নিজের জমানো সকল অর্থ এবং শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর গহনাও খোয়াতে হয়। ‘সাধনা’ ছবির গল্প, গান, পরিচালনা ও প্রযোজনা সমস্তই ছিল মোহিনীর নিজের। আর্থিক অনটন দেখা দেয় সংসারে। অনটন থেকে একান্নবর্তী সংসারে অসন্তোষও দেখা দেয়। এক সময় গৃগত্যাগ করে সব ছেড়ে অভিমানী মোহিনী দিল্লী গিয়ে প্রাইভেট সেক্রেটারীর চাকরী নেন। কিছুদিন পরে আবার ফিরে আসেন কোলকাতায়। স্বামী বিবেকানন্দের ‘রাজযোগ’ বইখানি পড়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান এবং শরণ নেন সপরিবারে বেলুরমঠে। ‘কালস্রোত’, ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’, ‘রাজদ্রোহী’, ‘নায়িকা সংবাদ’, ‘শুকসারী’ প্রভৃতি ছবির জন্য গান লিখলেন। আমরা পেলাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে- ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি, এ মিষ্টি এ সকাল’-এর মত কত কালজয়ী গান । এরপর অসংখ্য ছবির জন্য গান লেখা, চিত্রনাট্ট লেখা কখনো সহকারী পরিচালকের ভূমিকা পালক করেছেন।

তথ্যসূত্র:

১. সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা গান, প্যাপিরাস, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৩৯৪, পৃষ্ঠা, ১৭৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!