শান্তি ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী, সমাজসেবক

শান্তি ঘোষ (দাস) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের নারী বিপ্লবী। তিনি ছিলেন কুমিল্লার নারী বিপ্লবী। নির্যাতিত মানুষের জন্য নানা সেবামূলক কাজ করেছেন।  তিনি লেখক ছিলেন ও মেয়েদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সম্পর্কে জ্ঞানী করে তোলার জন্য সাংগঠনিক কাজ করেছেন। তিনি যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সাত বছর কারাবন্দী ছিলেন। কারামুক্ত হওয়েও রাজনৈতিক কাজ করেছেন বিভিন্ন ভাবে।[১]

জন্ম ও পারিবারিক জীবন:

১৯১৬ সালের ২২শে নভেম্বর শান্তি ঘোষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলিকাতায়। তাঁর পিতৃভূমি বরিশাল, কিন্তু তিনি মানুষ হয়েছিলেন কুমিল্লায়। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ ছিলেন কুমিল্লা কলেজের প্রফেসার। তাঁর মাতা সলিলাবাল ঘোষ। শান্তির পিতা ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী ও আদর্শবাদী।

তার ঐকান্তিক আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, সন্তানরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মত্যাগ করতে শেখে। তিনি নিজেই তাদের স্বদেশী গান শেখাতেন। একবার সরোজিনী নাইডু কুমিল্লায় একটি সভায় বক্তৃতা দেন। সেই সভায় শান্তি গাইলেন “ভারত আমার, ভারত আমার/ যেখানে মানব মেলিল নেত্র” সভা থেকে ফিরে এসে বাবার কাছে শান্তি যখন মহা উৎসাহে সভার বর্ণনা করছিলেন, বাবা বললেন, “আজ তুমি যার সভায় গান গাইলে, একদিন যেন তুমি তার মতো বড় হতে পারো।” ১৯২৬ সালে শান্তির পিতার অকালমৃত্যু হয়।

শিক্ষা ও বৈবাহিক জীবন:

অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলি করে মারার কারণে জেলে যান ১৯৩১ সালে। জেল থেকে মুক্তির পর শান্তি পড়াশুনা করতে থাকেন। এরপরে  তিনি ম্যাট্রিক পাস করলেন। তারপর পাস করেন আই.এ। শান্তির রুচি ফুটে উঠল সাহিত্যের প্রাঙ্গণে। আপন জীবনকাহিনী তুলে ধরেছেন তিনি ‘অরুণ-বহ্নি’ নামক পুস্তকে। নানা জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি কর্মমুখব। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রামের চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। শান্তি ঘোষ বঙ্গীয় প্রাদেশিক বিধানসভার সদস্য ছিলেন।

রাজনৈতিক কাজ:

১৯২৮ সালে সাইমন-কমিশনের বিরুদ্ধে কুমিল্লায় যে তীব্র বিক্ষোভ জেগেছিল তাতে শান্তির অন্তর আলোড়িত হয়ে ওঠে। ১৯৩০ সালে কুমিল্লায় চলেছিল আইন অমান্য আন্দোলন। জনতার উপরে ইংরেজের অত্যাচার কুমিল্লার সমস্ত কিশোর ও যুবমনকে প্রচণ্ড একটা ঘা দিয়ে ফিরছিল। তার ঢেউ এসে ধাক্কা দিতে লাগল শান্তি, সুনীতি, প্রফুল্প প্রভৃতিকেও। তাঁদের মনে হতো ইংরেজ তাড়াতে পারলে তবেই আসবে আমাদের দেশের মঙ্গল। শোভাযাত্রার উপরে লাঠিচার্জের ফলে কর্মীদের রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে তাদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠত।

তাঁরা চমৎকার লাঠি ও ছোরা খেলা শিখে নিলেন। তারপর অভ্যাস করতে লাগলেন রিভলভার চালানোর; এজন্য যেতে হতো ময়নামতী পাহাড়ে। পাড়ায় পাড়ায় লাঠি-ছোরা খেলা শেখাবার ও বিপ্লবাত্মক পুস্তক পড়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা সংগঠন করে চলেছিলেন। উৎসাহের একটা নতুন জোয়ারে ছোট কুমিল্লা শহর তখন জীবন্ত।

১৯৩১ সালের প্রথমার্ধে কুমিল্লায় ছাত্র-কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে গড়ে তুলেছিলেন ছাত্রীসংঘ। প্রফুল্পনলিনী ব্রহ্ম তার সভানেত্রী, শান্তি ঘোষ সম্পাদিকা এবং সুনীতি চৌধুরী ক্যাপটেন। ছাত্রীসংঘে প্রায় ৪০ থেকে ৬০টি ছাত্রীকে ক্যাপটেন সুনীতি শেখাতেন ড্রিল ও প্যারেড। এই ছাত্রীরা ছিলেন ছাত্র-কনফারেন্সেরে সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুগ স্বেচ্ছাসেবিকা।

ইতিমধ্যে প্রফুল্ল, শান্তি, সুনীতি শুনেছেন বিপ্লবীদের অনুষ্ঠিত গার্লিক হত্যা, সিম্পসন হত্যার ঘটনাবলী । প্রফুল্ল ও শান্তি ভাবলেন তারাও কেন করবেন না? দলের নেতাদের কাছে প্রফুল্ল ও শান্তি কিছু একটা বিপ্লবী কাজ করবার জন্য বারবার তাগিদ দিতে থাকেন।

দলে নেতারা অবশেষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, শান্তি ও সুনীতি কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে গুলী করে বৃটিশ গভর্নমেন্টকে চরম আঘাত হানবেন। দলের পুরাতন কর্মী হিসাবে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে প্রধান থাকবেন বাইরে । দরকার হলে তিনি আত্মগোপন করে কাজ করে যাবেন। তার বাইরে থাকা তখন বেশী প্রয়োজন ছিল। আরো স্থির হয় যে, শান্তি ও সুনীতি একটা দরখাস্ত দেবার অজুহাতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোতে গিয়ে কাজ হাসিল করবেন।

স্টিভেন্সকে হত্যার চেষ্টা:

১৯৩১ সালে ১৪ই ডিসেম্বর সকালে শাস্তি সেজেগুজে বসে আছেন এমন সময় একটা ঘোড়ার গাড়ী এল দলের দাদাদের নির্দেশমতো। শান্তি গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ীতে ছিলেন সুনীতি। তাঁদের গাড়ী গিয়ে ঢুকলো জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কুঠিতে। চাপসীর হাতে তাঁর ইণ্টারভিউ-কার্ড পাঠিয়ে দিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স বেরিয়ে এলেন। দায়িত্ব পালনের সুযোগ সমাগত দেখে শান্তি সুনীতি গুলী ছুডলেন। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রাণহীন দেহ ভূলুণ্ঠিত হলো। শান্তি দেখলেন সমস্ত ঘরটাতে চলেছে ছুটোছুটি দাপাদাপি এবং বিকট চীৎকার। সুনীতিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে দুজন লোকে তাঁকে জাপটে ধরেছে রিভলভারটা কেড়ে নিতে। শান্তিকে পেছন থেকে একজন লোক শক্ত করে ধরে রয়েছে, আরেকজন শাস্তির রিভলভার শুদ্ধ হাতটা চেপে ধরেছে। অশ্রাব্য ভাষায় তাকে গালাগালি করছে। চাপরাসীরা তাঁদের কিল, চড়, লাথি, ঘুষি মারছে। পুলিস-লাইনের সামনে পাগলা-ঘটি বেজে উঠল। মুহুর্তের মধ্যে পুলিশ এসে সব ঘিরে ফেলল ; শান্তি-সুনীতির হাত পেছনে বেঁধে দিয়ে তাদের বেদম প্রহার করতে লাগল। এমন সময় ডি.আই.বি. ইন্সপেক্টার এসে প্রহারের হাত থেকে উদ্ধার করে তাঁদের দুজনকে দুই জায়গায় সরিয়ে দেয়। জেরা চলে আলাদা আলাদা ভাবে । গুপ্তকথা পুলিশ কিছুই আদায় করতে পারেনি।

জেলের জীবন:

পুলিশ প্রথমে তাদের নিয়ে যায় কুমিল্লা জেলে। পরদিন বন্দী হয়ে এলেন সেখানে প্রফুলিনী ব্রাহ্ম ও চট্টগ্রামের ইন্দুমতী সিংহ। চট্টগ্রামে অনন্ত সিংহের ভগ্নী ইন্দুমতী সিংহ তখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার অর্থসংগ্রহের জন্য কুমিল্লায় গিয়েছিলেন।

কয়েকদিন পবে শান্তি-সুনীতিকে নিয়ে আসা হয় কলিকাতাষ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। মামলা শুরু হয় ১৯৩২ সালের ১৮ই জানুয়ারি। মামলার সময় শান্তি ও সুনীতি তাদের হাসি, উচ্ছ্বাস ও তেজস্বীতায় সমস্ত কোর্টকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। মামলা দ্বিতীয় দিনে ডকে তাঁদের বসতে চেয়ার দেওয়া হয়নি বলে তারা পিছন ফিরে দাড়িয়ে রইলেন। তারপর থেকে শেষদিন পর্যন্ত ডকে তাদের চেয়ার দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে ১৯৩২ সালের ২৭শে জানুয়ারি শান্তি-সুনীতি সমগ্র সত্তা কেন্দ্রীভূত করে যখন অপেক্ষা করছিলেন ফাঁসির আদেশ শুনবার জন্য ঠিক তখন তারা দণ্ডাদেশ শুনলেন যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের। অফুরন্তু উৎসাহভরা প্রাণ তাঁদের সেই মুহূর্তে নিরাশ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারা যে ১৪ ও ১৫ বছরের কিশোরী নাবালিকা। স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ফাঁসি কি করে হবে?

এই দুটি কিশোরী মেয়ের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের বুকে যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল তা তখনকার দিনের লোক আজও হয়তো ভুলে যাননি। যে বাংলাদেশের নারী-সমাজ শত লাঞ্ছনাও মুখ বুজে সহ্য করেন, শত আঘাতেও নীরবে অশ্রুপাত করেন কিন্তু প্রত্যাঘাত করার কথা মনে আনেন না, সেই সমাজের দুটি কিশোরীর একি রণরঙ্গিণী মুর্তি। দ্বিধাগ্রস্তের মনে সেদিন দৃঢ়তা জাগলো। যুবসমাজের চিত্তে জাগলো চমক, উৎসাহে উদ্দীপনায় তারা দুঃসাহসের পথে পা বাড়াতে প্রস্তুত। ছোট্ট দুটি মেয়ে যেন ধুমকেতুর মতো সমগ্র দেশকে তোলপাড় করে দিয়ে গোটা সমাজের হয়ে শান্তি বহন করতে কারান্তরালে চলে গেলেন দেশবাসীকে চাঞ্চল্যে ও বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে।

শান্তিকে করা হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর কয়েদী, সুনীতিকে তৃতীয় শ্রেণীর। বিচ্ছেদ এনে শাসন করা হচ্ছে ইংরেজের নীতি। শান্তি-সুনীতিকে মাঝে মাঝে একসঙ্গে রাখে কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আলাদা আলাদা করে প্রেসিডেন্সি, মেদিনীপুর, রাজশাহী, হিজলী প্রভৃতি জেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্থানান্তরিত করা হত।

যখন তারা মেদিনীপুর জেলে ছিলেন তখন সেখানকাব জেলার ও মেট্রনের অনাচারের বিরুদ্ধে শান্তি, সুনীতি ও বীণা দাস অনশন করেছিলেন সাতদিন। ফলে জেলারকে ওখান থেকে বদলি করা হয়। কিন্তু এই বন্দিনীদেরও পৃথক পৃথক জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। শান্তি ও বীণা গেলেন হিজলী জেলে, যেখানে ছিলেন বিনাবিচারে বন্দী রাজবন্দী মহিলাগণ। সুনীতিকে নিয়ে যায় রাজশাহী জেলে। শান্তি সুনীতি যেখানেই যখন গেছেন, তাদের চমৎকার কণ্ঠসঙ্গীতে অন্যসকল মাতিয়ে রাখতেন।

কারাপ্রাচীরের দুর্ভেদ্য লৌহবর্ষের মধ্যে শান্তি ও সুনীতি কাটিয়ে দিলেন সাতটা শীত ও বসন্ত। অবশেষে গান্ধীজীর প্রচেষ্টায় অন্যসকল রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে তাদেরও মুক্তির আদেশ আসে ১৯৩৯ সালের এক প্রাতে।

মৃত্যু: শান্তি ঘোষ সাহিত্য সাধনা ও জনসেবা করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। তিনি ২৭ মার্চ, ১৯৮৯ মারা যান।

তথ্যসূত্র:

১. দোলন প্রভা, ৮ আগস্ট , ২০১৯, “শান্তি ঘোষ ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের নারী বিপ্লবী”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/biography/shanti-ghosh/

২. কমলা দাশগুপ্ত (জানুয়ারি ২০১৫)। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী, অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯। কলকাতা: র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন। পৃষ্ঠা ১১৩-১১৮ আইএসবিএন 978-81-85459-82-0।

Leave a Comment

error: Content is protected !!