বিশ্বে পুঁজিবাদী দেশসমূহের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বরূপ

বিশ্বে পুঁজিবাদী দেশসমূহের মধ্যে প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ সহ উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিই পুঁজিবাদী বিশ্বের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির উৎস। অত্যধিক সুসংগঠিত উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানার বদৌলতে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি এবং সর্বোপরি প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ পুঁজিবাদী দুনিয়ার ৮৫ শতাংশের বেশি শিল্পপণ্য এবং প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষিফসল উৎপাদন করে।

উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির শিল্পসামর্থ্যের সূচকস্বরুপ উল্লেখ্য তথ্যটি হলো: এদের মোট জাতীয় উৎপাদের পরিমাণ সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়ার মোট উৎপাদের ৮০ শতাংশের বেশি। জাতীয় আয়ের নিরঙ্কুশ পরিমাণ ও মাথাপিছু, বণ্টনের হিসাবে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে। মোট ৫৬.৫ কোটি জনসংখ্যা সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পশ্চিম জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির জাতীয় আয়ের পরিমাণ এই জনসংখ্যার ২০ গুণ বেশি। পক্ষান্তরে এই সময় প্রায় ৯০ কোটির জনসংখ্যা সহ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, তানজানিয়া ও জাইয়ার অর্জন করেছিল ৮০০০ কোটি ডলার। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, পুঁজিবাদী দেশগুলিতে জাতীয় আয়ের বিরাট অংশ জনসংখ্যার অতি নগণ্য অংশ বুর্জোয়ারা ও অন্যান্য শোষক শ্রেণী কুক্ষিগত করে।

প্রধানত উন্নয়নশীল দেশগুলি সোনার উৎস হলেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির কোষাগারই তার শেষ লক্ষ্যস্থল। তাদের স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ উন্নয়নশীল দেশগুলির মজুদের দশ গুণেরও বেশি।

সাম্রাজ্যবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধান প্রধান পুঁজিবাদী দেশগুলি বহু জাতিকে শোষণ করছে এবং আজও তারা শান্তি ও প্রগতির লক্ষ্যের সামনে হুমকি হয়ে আছে। যেকোনো মূল্যে সমাজতন্ত্রের অবস্থান দুর্বল করার জন্য, জনগণের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এবং পুঁজিবাদী দেশে মেহনতিদের সংগ্রাম অবদমনের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের উদ্যোগ সংহত করার সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণাত্মক সামরিক-রাজনৈতিক করেছে। প্রধান সামরিক জোট  ন্যাটোকে জোরদার করা তাদের অন্যতম মুখ্য লক্ষ্য।

কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ তার হারানো ঐতিহাসিক ভূমিকা ফিরে পাবে না কিংবা দুনিয়ার অগ্রগতিকেও প্রহত করতে পারবে না। সমাজতন্ত্রের অনুকূলে শক্তিস্থিতি বদলানোর পরিবেশে, বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী প্রাধান্যের এলাকা সঙ্কোচন, পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলির বর্ধমান অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতির পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী নীতির, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণাত্মক প্রবণতা দ্রত বদ্ধি পেয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২৬তম কংগ্রেসে বলা হয়েছে: ‘সংকীর্ণ ও স্বার্থপর লক্ষ্যে মানবজাতির স্বার্থ নিয়ে জুয়াখেলার হঠকারিতা ও প্রস্তুতি – এটাই হল অতিকতর আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্যবাদী চক্রের অনসত নীতির একটি বিশেষ নির্লজ্জ ধরন।’

আরো পড়ুন:  প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রসঙ্গে

প্রধান প্রধান পুঁজিবাদী দেশগুলি আজ গভীরতম অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতিতে আক্রান্ত। এই অসঙ্গতি জাতীয় অসাম্য, নির্যাতন ও হিংস্রতার সমাজব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদীকে ধবংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শ্রম ও পুঁজির অসঙ্গতিই এখানে প্রধান এবং তা অন্যান্য অসঙ্গতিগুলির তুলনায় দ্রুত গভীরতা লাভ করছে। সমাজতন্ত্রের সাফল্য এবং শ্রেণী-সংগ্রামের ফলে পুঁজিবাদীরা মেহনতিদের কিছু কিছু সামাজিক সুবিধা দিতে বাধ্য হলেও সমাজব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদী দারিদ্র্যশূন্য ও বেকারীহীন সমাজ এবং মেহনতিদের যুদ্ধের ভয় ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তামুক্ত জীবনের নিশ্চয়ত দিতে অক্ষম।

দেশে পর্যায়িক অর্থনৈতিক মন্দা এবং ব্যাপক বেকারীর উদ্ভবের মধ্যে পুঁজিবাদী দেশগুলির অন্তলীন ক্রনিক সংকট প্রকটিত হতে থাকে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে নথিভুক্ত বেকারের গড়পড়তা বার্ষিক সংখ্যাটি ১ কোটি ৬০ লক্ষ। সাময়িকভাবে কর্মরত এবং আংশিক কর্মরত লোকের সংখ্যা আরও বহুগুণ বেশি। প্রধান পুঁজিবাদী দেশগুলির জালানি ও মুদ্রাব্যবস্থার সংকট, ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি, দরবৃদ্ধি এদেশগুলির মেহনতি মানুষের উপর বোঝা চাপিয়ে যাচ্ছে।

লেনিন কতৃক সূত্রবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির অসম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের নিয়ম পুঁজিবাদী বিশ্বে এখন প্রকটতরভাবে আত্মপ্রকাশ করছে।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির নিজ নিজ বিকাশের বর্ধমান অসমতার দরুন আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে তীব্রতা দেখা দেয়। পুঁজিবাদী বিশ্বের বর্তমান ঘটনাবলী থেকে দেখা যায় যে, প্রভাবাধীন অঞ্চল, বিক্রয়-বাজার ও কাঁচামালের উৎসগুলি ভাগ-বাটোয়ারার ফলে অধিক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ দেশগুলি বড় বড় হিসসা পেলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান ঘটে নি। পক্ষান্তরে এতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে এবং একচেটিয়া সংস্থাগুলির মধ্যে সংঘাত আরও তীব্রতর হয়েছে। বাজার ‘একত্রীকরণ এবং বাজারের সমস্যা সমাধানের শ্লোগানের ভিত্তিতে গঠিত আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয়-একচেটিয়া সংস্থাগুলি বস্তুত বিশ্বের পুঁজিবাদী বাজার ভাগ-বাটোয়ারার অন্যতর নতুন রূপে মাত্র।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে পুঁজিবাদের দুর্বলতা উপরোক্ত তথ্যগুলিতে স্পষ্টতই প্রকটিত। ল. ই. ব্রেজনেভ বলেছেন : ‘পুঁজিবাদীকে “সুস্থ” করার ও তার আওতায় “সাধারণের কল্যাণমুখী রাষ্ট্র” গঠনের প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন সহজলক্ষ্য। পুঁজিবাদ এক ভবিষ্যহীন সমাজব্যবস্থা।

আরো পড়ুন:  পুঁজিবাদী দেশগুলিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বর্ধমান উত্তেজনা

অভিন্ন চারিত্র্য সত্ত্বেও প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সুচিহ্নিত। এটিই আমাদের পরবর্তী আলোচ্য বিষয়।

তথ্যসূত্রঃ

১. কনস্তানতিন স্পিদচেঙ্কো, অনুবাদ: দ্বিজেন শর্মা: বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূগোল, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, বাংলা অনুবাদ ১৯৮২, পৃ: ১৬৭-১৬৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!