ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস রচিত জ্ঞানগর্ভ পুস্তিকা কমিউনিজমের নীতিমালা

প্রশ্ন-১৩: নিয়মিতভাবে পুনরাবৃত্ত এইসব বাণিজ্যিক সংকট থেকে কোন কোন সিদ্ধান্তে পৌছনো যেতে পারে?

উ: প্রথমত, সিদ্ধান্ত হলো, বিকাশের প্রারম্ভিক পর্বগুলিতে বৃহদায়তনের শিল্প আপনিই অবাধ প্রতিযোগিতা পয়দা করলেও এই শিল্পের বৃদ্ধি এখন অবাধ প্রতিযোগিতার পরিধি ছাপিয়ে গেছে; প্রতিযোগিতা এবং সাধারণভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা শিল্পোৎপাদন চালানোটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃহদায়তনের শিল্পের পায়ে বেড়ির মতো, সেটাকে এই শিল্পের ভাঙা চাই এবং তা সে ভাঙবে; যতকাল সেটা চালানো হবে এখনকার ভিত্তিতে, তাতে বৃহদায়তনের শিল্প টিকে থাকতে পারে শুধু সাত বছর অন্তর-অন্তর পুনরাবৃত্ত সাধারণ তালগোল পাকানো অবস্থার ভিতর দিয়ে, সেটা প্রত্যেক বার প্রলেতারিয়ানদের ফেলে দেয় দুর্দশার গোড়ায় শুধু, তাই নয়, তেমনি আবার সর্বনাশ করে বহুসংখ্যক বুর্জোয়ার, এইভাবে সেটা প্রত্যেক বার বিপন্ন করে সমগ্র সভ্যতাকে; তার থেকে আসে এই অবস্থাটা: হয় বৃহদায়তনের শিল্প ছাড়তে হবে, যা একেবারেই অসম্ভব, নইলে এটা সম্পূর্ণভাবেই অপরিহার্য করে তোলে সমাজের একেবারে নতুন একটা সংগঠন, যেখানে কল-কারখানার পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তি-মালিকেরা আর নয়, সমগ্ৰ সমাজ শিল্পোৎপাদন চালায় একটা নির্দিষ্ট পরিকলপনা অনুসারে এবং সবার চাহিদা অনুসারে।

দ্বিতীয়ত, সিদ্ধান্ত হলো, বৃহদায়তনের শিল্প, এবং সেটা যে অঢেল উৎপাদনবৃদ্ধি সম্ভব করেছে, এই দুইয়ে মিলে এমন একটা সমাজব্যবস্থার উদ্ভব ঘটাতে পারে যেখানে জীবনীয়সমূহ এমন বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হবে যাতে সমাজের প্রত্যেকটি সদস্য পূর্ণতম মাত্রায় স্বাধীনভাবে তার অন্তর্নিহিত শক্তি বিকশিত করতে এবং সমস্ত ক্ষমতা আমার সামর্থ প্রয়োগ করতে পারবে। এইভাবে, বৃহদায়তনের শিল্পের ঠিক যে প্রকৃতিটা এখনকার দিনের সমাজে পয়দা করছে যাবতীয় দুর্দশা আর যাবতীয় বাণিজ্যিক সংকট, ঠিক সেটাই ভিন্ন সামাজিক সংগঠনের অবস্থায় ঠিক সেই দুর্দশা এবং এইসব বিপর্যয়কর ওঠা-পড়া খতম করবে।

এইভাবে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে:

১) যে সমাজব্যবস্থা আর বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নয়, সম্পূর্ণভাবে সেটারই ক্রিয়া বলে এখন থেকে গণ্য করা যেতে পারে এই সমস্ত অমঙ্গলকে;

২) একটা নতুন সমাজব্যবস্থা স্থাপন করে এইসব অমঙ্গল পুরোপুরি লোপ করার উপায়-উপকরণ হাতের কাছে প্রস্তুত রয়েছে।

আরো পড়ুন:  ৫৬,০০০ বর্গমাইল
প্রশ্ন-১৪: সেটাকে হতে হবে কোন রকমের নতুন সমাজব্যবস্থা?

উ: সর্ব প্রথমে, নিজেদের মধ্যে প্ৰতিযোগিতারত বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের হাত থেকে শিল্প এবং উৎপাদনের সমস্ত শাখার পরিচালনা সমগ্রভাবে নিজ হাতে নিয়ে নতুন সমাজবাবস্থা তার বদলে উৎপাদনের এই সমস্ত শাখা চালাবে সমগ্র সমাজের তরফে, অর্থাৎ একটা সামাজিক পরিকলপনা অনুসারে, তাতে অংশগ্রহণ করবে। সমাজের সমস্ত সদস্য এইভাবে, সেটা প্রতিযোগিতার অবসান ঘটিয়ে তার জায়গায় আনবে সম্মিলনী। যেহেতু ব্যক্তিরা শিল্প পরিচালনা করলে ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভব অবশ্যম্ভাবী, আর যেহেতু প্রতিযোগিতা হলো ব্যক্তি-মালিকদের শিল্প চালাবার ধরন ছাড়া কিছু নয়, তাই শিল্পের ব্যক্তিগত পরিচালনা এবং প্রতিযোগিতা থেকে ব্যক্তিগত মালিকানা অবিচ্ছেদ্য। কাজেই বাক্তিগত মালিকানাও খতম করতে হবে, আর তার বদলে আসবে উৎপাদনের সমস্ত সামগ্রীর সাধারণ প্রয়োগ এবং সবার সম্মতি অনুসারে সমস্ত উৎপাদের বণ্টন, বা যাকে বলা যায় পণ্যদ্রব্যসমূহের সমবায়। শিল্পের সম্প্রসারণ থেকে সমগ্র সমাজব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী রূপান্তর সবচেয়ে চাঁছাছোলা এবং সবচেয়ে বিশেষক চুম্বকের অভিব্যক্তি হলো ব্যক্তিগত মালিকানার লুপ্তি, কাজেই এটা যে কমিউনিস্টদের তোলা প্রধান দাবি সেটা সঠিক।

প্রশ্ন-১৫: কাজে কাজেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি লোপ করা আগে অসম্ভব ছিলো?
‘সমাজব্যবস্থার প্রত্যেকটা পরিবর্তন হলো নতুন নতুন উৎপাদন-শক্তি পয়দা হবার অপরিহার্য ফল।’– এঙ্গেলস

উ: ঠিক। সমাজব্যবস্থার প্রত্যেকটা পরিবর্তন, মালিকানা সম্পর্কের প্রত্যেকটা আমূল পরিবর্তন হলো নতুন নতুন উৎপাদন-শক্তি পয়দা হবার অপরিহার্য ফল, এইসব উৎপাদন-শক্তি পুরনো মালিকানা সম্পর্কের সঙ্গে আর মানানসই নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি আপনিই দেখা দিয়েছিলো এইভাবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি তো বরাবর ছিল না, কিন্তু মধ্যযুগের শেষের দিকে চালু হয়েছিল একটা নতুন উৎপাদন-প্রণালী সেটা হলো ম্যানুফ্যাকচার, সেটা ছিলো তখন বিদ্যমান সামন্ততান্ত্রিক আর গিল্ডের সম্পত্তির সঙ্গে বেমানান, সেটা পুরনো মালিকানা সম্পর্কের পরিধি ছাপিয়ে গিয়েছিল, সেই ম্যানুফ্যাকচার পয়দা করলো নতুন ধরনের মালিকানা — ব্যক্তিগত মালিকানা। ম্যানুফ্যাকচারের কালপর্যায়ে এবং বৃহদায়তনের শিল্প গড়ে ওঠার প্রথম পর্বে ব্যক্তিগত মালিকানা ছাড়া কোনো রূপের মালিকানা সম্ভব ছিলো না, ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক ব্যবস্থা ছাড়া সমাজের অন্য কোনো ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না।

আরো পড়ুন:  কর্তৃত্ব প্রসঙ্গে

সবার চাহিদা অনুসারে যোগান দেবার জন্যে: পর্যাপ্ত সেই পরিমাণ উৎপাদই শুধু নয়, অধিকন্তু সামাজিক পুঁজি বাড়াবার এবং উৎপাদন-শক্তিসমূহের আরও সম্প্রসারের জন্যে আবশ্যক উদ্ধৃত্তি উৎপাদ যতক্ষণ না হয়, ততক্ষণ সবসময়ে থাকেই একটা প্রাধান্যশালী শ্রেণী, যেটা সমাজের উৎপাদনশক্তিসমূহের পরিচালক, আর একটা গরিব উৎপীড়িত শ্রেণি। উৎপাদন বিকাশের পর্বের উপর নির্ভর করে শ্রেণী-দুটোর গড়নের ধরন।

মধ্যযুগে ছিলো কৃষির মুখাপেক্ষী, তখন ছিলো ভূস্বামী আর ভূমি দাস; মধ্যযুগের শেষ ভাগের শহরগুলিতে আমরা দেখতে পাই গিল্ড-কর্তা এবং তার শিক্ষানবিস আর দিনমজুরদের; সতের শতকে — ম্যানুফ্যাকচারাররা এবং ম্যানুফ্যাক্টরি শ্রমিকেরা; উনিশ শতকে —— বৃহৎ কারখানা মালিক আর প্রলেতারিয়ান। স্পষ্টই দেখা যায়, যাতে সবার জন্যে যা পর্যাপ্ত এমন পরিমাণে উৎপাদন হতে পারে, আর যাতে ব্যক্তিগত মালিকানা হয়ে ওঠে উৎপাদন-শক্তিসমূহের পক্ষে বেড়ির মতো প্রতিবন্ধক, তদবধি উৎপাদন-শক্তিসমূহ তত ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয় নি। কিন্তু বৃহদায়তনের শিল্পের সম্প্রসারের ফলে এখন, প্রথমত, পুঁজি আর উৎপাদন-শক্তি এমন পরিসরে পয়দা হয়েছে যেমনটা এযাবত শোনা যায় নি, আর এইসব উৎপাদন-শক্তিকে অল্পকালের মধ্যে অশেষ মাত্রায় বাড়াবার উপায়-উপকরণ রয়েছে; দ্বিতীয়ত, এইসব উৎপাদনশক্তি জড়ো হয়েছে মুষ্টিমেয় বুর্জোয়াদের হাতে, পক্ষান্তরে বিপুল জনরাশি ক্ৰমাগত বেশি পরিমাণে পড়ে যাচ্ছে প্রলেতারিয়েতের কাতারে, আর যে পরিমাণে বুর্জোয়াদের ধনদৌলত বহুলীকৃত হচ্ছে সেই পরিমাণেই বিপুল জনরাশির অবস্থা হয়ে পড়ছে আরও দুর্দশাগ্রস্ত এবং দুর্বহ; তৃতীয়ত, এইসব উৎপাদন-শক্তি মহাশক্তিশালী, এগুলিকে বহুলীকৃত করা যায় সহজেই, এগুলির বৃদ্ধি ব্যক্তিগত মালিকানা এবং বুর্জোয়াদের পরিধি এতখানি ছাড়িয়ে গেছে যাতে সমাজব্যবস্থায় অবিরাম প্রচন্ড গোলযোগ ঘটছে। — শুধু এখনই ব্যক্তিগত সম্পত্তি লোপ করা সম্ভব হয়ে উঠেছে শুধু তাই নয়, সেটা হয়ে উঠেছে এমনকি একেবারেই অপরিহার্য।

প্রশ্ন-১৬: শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি লোপ করা সম্ভব হবে কি?

উ: যদি সেটা ঘটে, তাইই কাম্য, তাতে কমিউনিস্টরা নিশ্চয়ই বাধা দেবে না। কমিউনিস্টরা খুব ভালভাবেই জানে, সমস্ত ষড়যন্ত্ৰই অকার্যকরই শুধু নয়, অধিকন্তু হানিকর। তারা খুব ভালোভাবেই জানে, পরিকল্পনা অনুসারে এবং মর্জি মাফিক বিপ্লব ঘটান হয় না, সর্বত্র এবং সর্বকালে বিপ্লবগুলি ছিল পরিস্থিতির অনিবাৰ্য পরিণতি, সেটা বিশেষ বিশেষ পার্টি এবং গোটা গোটা শ্রেণির ইচ্ছা আর নেতৃত্বের সাপেক্ষ নয় একেবারেই! কিন্তু তারা তেমনি লক্ষ্য করছে, প্রায় প্রত্যেকটা সভ্য দেশে প্রলেতারিয়েতের বিকাশ বলপূর্বক দমন করা হচ্ছে, সেইভাবে কমিউনিস্টদের প্রতিপক্ষীয়রা বিপ্লব এগিয়ে আনছে। উৎপীড়িত প্রলেতারিয়েতকে শেষপর্যন্ত বিপ্লবের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলে আমরা কমিউনিস্টরা তখন প্রলেতারিয়ানদের কর্মব্ৰতটাকে সমর্থনা করব কাজ দিয়ে, ঠিক যেমনটা এখন আমরা করছি কথা দিয়ে।

আরো পড়ুন:  রাজনৈতিক দল কী, কাকে বলে ও কেন প্রয়োজন
প্রশ্ন-১৭: ব্যক্তিগত মালিকানা কি এক-ঘায়ে খতম করা সম্ভব হবে?

উ: না, সম্প্রদায় সৃষ্টি করার জন্যে আবশ্যক মাত্রায় বিদ্যমান উৎপাদনশক্তিসমহের বহলীকরণ এক-ঘায়ে যেমন অসম্ভব, সেটাও তেমনিই এক ঘায়ে অসম্ভব। কাজেই, যে-প্রলেতারিয়েত বিপ্লব খুব সম্ভবত কাছিয়ে আসছে সেটা বিদ্যমান সমাজটাকে রপান্তরিত করতে সক্ষম হবে শুধু ক্ৰমে ক্রমে, আর সেটা ব্যক্তিগত মালকানা লোপ করবে শুধু যখন আবশ্যক পরিমাণ উৎপাদনের উপকরণ পয়দা হবে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!