শ্লোগান প্রসঙ্গে

এমনটা খুব ঘন ঘনই ঘটেছে, যখন ইতিহাস অপ্রত্যাশিত-আপতিক মোড় ঘুরেছে, এমন কি বিভিন্ন প্রগতিশীল পার্টিও কিছুকালের জন্য নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অপারগ হয়েছে এবং আওড়ে চলেছে এমন সব শ্লোগান যা আগে সঠিক ছিল, কিন্তু এখন হয়ে গেছে একেবারেই অর্থবর্জিত – অর্থবর্জিত হয়েছে তেমনি ‘সহসা’, যেমন ‘সহসা’ অপ্রত্যাশিত, আপতিক ছিল ইতিহাসের মোড়ঘোরা।

সোভিয়েতগুলির কাছে সমস্ত রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরণের আহবান জানান স্লোগানটার প্রসঙ্গে তেমনি কিছু যেন আবার ঘটে থাকতে পারে। স্লোগানটা সঠিক ছিল আমাদের বিপ্লবের একটা কালপর্যায়ে – যথা, ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ জুলাই – যেটা কেটে গেছে, আর ফিরে আসার নয়। স্লোগানটা এখন আর সঠিক নয়, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান। এটা না বুঝলে এখনকার জরুরী প্রশ্নগুলোর কিছুই বুঝা সম্ভব নয়। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশেষত্বগুলির সাফল্য থেকে বের করতে হয় কোনো বিশেষ স্লোগান। রাশিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ৪ জুলাইয়ের মধ্যে যা ছিল, সেটা থেকে এখনকার ৪ জুলাইয়ের পরের পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা (৮০)।

বিপ্লবের সেই বিগত কালপর্যায়ে দেশে ছিল যেটাকে বলা হয় ‘দ্বৈত ক্ষমতা’, যাতে বাস্তব আকারে এবং যথাবিধি উভয়ত প্রকাশ পেয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতার অনির্দিষ্ট এবং উত্তরণকালীন অবস্থা। ক্ষমতা সংক্রান্ত প্রশ্নটা হলো যেকোন বিপ্লবের মূল বিবেচ্য প্রশ্ন, এটা আমরা যেন না ভুলি।

রাষ্ট্রক্ষমতা তখন ছিল অস্থিত। স্বেচ্ছাকৃত চুক্তিতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় শরিকানা ছিল সাময়িক সরকার আর সোভিয়েতগুলির। সোভিয়েতগুলিতে ছিল মুক্ত (অর্থাৎ বহিস্থ জবরদস্তির বশীভূত নয়) এবং সশস্ত্র শ্রমিক আর সৈনিক জনরাশির প্রতিনিধিত্ব। যা বাস্তবিক তাৎপর্য সম্পন্ন ছিল সেটা এই যে, অস্ত্রশস্ত্র ছিল জনগণের হাতে, আর বাইরে থেকে জনগণের উপর কোনো জবরদস্তি ছিল না। ফলত বিপ্লবের অগ্রগতির শান্তিপূর্ণ পথ খুলে গিয়েছিল এবং নিশ্চিত হয়েছিল। বিকাশের সেই শান্তিপূর্ণ পথে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য, আশু সম্ভাব্য পদক্ষেপের জন্য স্লোগান ছিল সোভিয়েতগুলির কাছে সমস্ত ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়া চাই। স্লোগানটি ছিল বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ বিকাশের জন্য, যা ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ৪ জুলাইয়ের মধ্যে ছিল সম্ভব এবং নিশ্চয়ই সবচেয়ে বাঞ্ছিত, কিন্তু এখন একেবারেই অসম্ভব।

স্পষ্টতই, ‘সোভিয়েতগুলির কাছে সমস্ত ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়া চাই’ স্লোগানটির সমস্ত সমর্থকই এটা যথেষ্ট পরিমাণে ভেবে দেখেন নি যে, এটা ছিল বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির শ্লোগান – শান্তিপূর্ণ শুধু এই অর্থে নয় যে, এতটুকু গুরত্বসম্পুর্ণ কেউ, কোনো শ্রেণী, কোনো শক্তি তখন (২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ জুলাই) সোভিয়েতগুলির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরণে বাধা দিতে, সেটা বন্ধ করতে পারত না। সেটাই সব নয়। শান্তিপূর্ণ বিকাশ তখন সম্ভব হত এমন কি এই অর্থেও যে, সোভিয়েতগুলির ভিতরে বিভিন্ন শ্রেণী আর পার্টির মধ্যে সংগ্রাম খুবই শান্তিপূর্ণ এবং যন্ত্রণাবর্জিত হতে পারত, পূর্ণক্ষমতা যদি সোভিয়েতগুলির হাতে চলে যেত সময় থাকতে।

বিষয়টার শেষোক্ত দিকেও তেমনি এখনো যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয় নি। শ্রেণিগত কাঠামোর দিক থেকে সোভিয়েতগুলি ছিল শ্রমিক এবং কৃষকদের আন্দোলনের যন্ত্র – তাদের একনায়কত্বের একটা তৈরি সংস্থা। সোভিয়েতগুলির হাতে পূর্ণ রাষ্ট্রক্ষমতা থাকলে, পেটি-বুর্জোয়া স্তরগুলোর প্রধান এটি, সেগুলোর মুখ্য দোষ – পুজিপতিদের প্রতি আস্থা বাস্তবিকই কাটিয়ে ওঠা হত, তা সমালোচিত হতো সেগুলির নিজেদেরই ব্যবস্থাবলী দিয়ে। ক্ষমতাসীন বিভিন্ন শ্রেণি আর পার্টির পরিবর্তন শান্তিপূর্ণ উপায়ে চলতে পারত সোভিয়েতগুলির ভিতরে;  যদি সোভিয়েতগুলি চালনা করত একক এবং অবিভক্ত ক্ষমতা। সোভিয়েতের সমস্ত পার্টি এবং জনগণের মধ্যে সংযোগ থেকে যেতে পারত সুস্থিত এবং অক্ষত। একথা কারও মুহূর্তের জন্যও ভালো চলে না যে, সোভিয়েতের পার্টিগুলি এবং জনগণের মধ্যে শুধু এমন ঘনিষ্ঠ সংযোগই যা পরিসরে আর গভীরতায় অবাধে বেড়ে উঠে বুর্জোয়াদের সঙ্গে পেটি-বুর্জোয়া আপসের মোহ থেকে রেহাইয়ের সহায়ক হতে পারত। সোভিয়েতগুলির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলে তাতেই বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যেকার অনুপাত বদলে যেত না, বদলাতে পারত না; কৃষকদের পেটিবুর্জোয়া চরিত্র তাতে কোনোমতেই বদলে যেত না। কিন্তু বুর্জোয়াদের থেকে কৃষকদের পৃথক করে ফেলার দিকে, তাদের শ্রমিকদের আরও কাছে আনা এবং তারপর শ্রমিকদের সঙ্গে সম্মিলিত করার দিকে সেটা হত একটা মস্ত এবং সময়োচিত পদক্ষেপ।

উপযুক্ত সময়ে সোভিয়েতগুলির হাতে ক্ষমতা চলে গেলে যা ঘটতে পারত সেটা তাইই। সেটা হতো জনগণের পক্ষে সবচেয়ে সহজ এবং সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ। এই পথ হতো সবচেয়ে কম যন্ত্রণাকর, কাজেই এটার জন্য সবচেয়ে সতেজ লড়াইয়ের প্রয়োজন ছিল। তবে এই সংগ্রাম, সোভিয়েতগুলির হাতে যথাসময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরণের জন্য সংগ্রাম এখন শেষ হয়ে গেছে। বিকাশের শান্তিপূর্ণ পথ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শুরু হয়েছে অ-শান্তিপূর্ণ এবং অতি যন্ত্রণাকর পথযাত্রা।

আরো পড়ুন:  মেহনতি ও শোষিত মানুষের অধিকার ঘোষণা

৪ জুলাইয়ের সন্ধিক্ষণটা হলো বিষয়গত পরিস্থিতিতে একটা প্রচণ্ড পরিবর্তনই বটে। রাষ্ট্রক্ষমতার অস্থির অবস্থাটা শেষ হয়ে গেছে। চূড়ান্ত স্থানে ক্ষমতা চলে গেছে প্রতিবিপ্লবের হাতে। পেটিবুর্জোয়া সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিক পার্টি দুটো এবং প্রতিবিপ্লবী কাদেতদের (৮১) মধ্যে সহযোগের ভিত্তিতে পার্টিগুলির বিকাশের ফলে এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে যাতে ওই উভয় পেটিবুর্জোয়া পার্টি প্রতিবিপ্লবী গণহত্যায় বস্তুত শরিক এবং সহকারী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিপতিদের প্রতি পেটি বুর্জোয়ারা যে নির্বিচার আস্থা স্থাপন করেছিল সেটা বিভিন্ন পার্টির মধ্যে সংগ্রাম এগোবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবিপ্লবীদের প্রতি তাদের ইচ্ছাকৃত সমর্থনে পরিণত হয়। পাটিগত সম্পর্ক বিকাশের চক্রটা পুরো হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি সমস্ত শ্রেণি ছিল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থানে। ৪ জুলাইয়ের পরে প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়ারা রাজতন্ত্রী আর কৃষ্ণশতকীদের (৮২) সঙ্গে গলাগলি করে কাজ চালিয়ে পেটিবুর্জোয়া সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিকদের সমর্থন আদায় করেছে, সেটা অংশত তাদের ভয় দেখিয়ে, আর আসল রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তরিত করেছে কাভেনিয়াকদের কাছে, সামরিক দঙ্গলের কাছে, যারা অবাধ্য সৈনিকদের গুলি করছে ফ্রন্টে, আর পেত্রগ্রাদে বলশেভিকদের উপর প্রচণ্ড আঘাত হানছে।

সোভিয়েতগুলির কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরণের জন্য দাবির স্লোগানটা এখন শোনাবে কুইক্সটিক কিংবা পরিহাসের মতো। বিষয়গতভাবে সেটা হবে জনগণের সঙ্গে ধোঁকাবাজি; তাতে জনগণের মধ্যে এই বিভ্রম জাগান হবে যে, এমন কি এখনো সোভিয়েতগুলি ক্ষমতা হাতে নিতে চাইলে কিংবা তেমনি একটা সিদ্ধান্ত নিলে তাতেই ক্ষমতা হয়ে যাবে তাদেরই, এখনো যেন সোভিয়েতগুলিতে এমন সব পার্টি রয়েছে যেগুলি ঘাতকদের দুষ্কর্মে সহযোগী বলে কলঙ্কিত নয়, কৃতকর্ম যেন উল্টে দেওয়া যায়।

বলশেভিকদের উপর প্রচণ্ড আঘাত হানায়, ফ্রন্টে সৈনিকদের উপর গুলি চালনায় এবং শ্রমিকদের নিরস্ত্র করায় সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারিরা আর মেনশেভিকরা যে সমর্থন যুগিয়েছে সেজন্য বলা যেতে পারে যেন ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন করতে ‘অসম্মত হতে’ পারে, এমনটা মনে করা নিরেট ভ্রান্তি। প্রথমত, এটা হবে প্রলেতারিয়েত প্রসঙ্গে নৈতিকতার কূপমণ্ডক ধারণার প্রযোগ (যেহেতু কর্মব্রতের মঙ্গলের জন্য প্রলেতারিয়েত সর্বদা সমর্থন করবে দোলায়মান পেটি বুর্জোয়াদেরই শুধু নয়, এমন কি বহৎ বুর্জোয়াদেরও); দ্বিতীয়ত – এটাই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস – সেটা হবে পরিস্থিতির রাজনৈতিক সারমর্মটাকে ‘নীতিকথা আওড়ে’ ঝাপসা করার কূপমণ্ডকী চেষ্টা।

সেই রাজনৈতিক সারমর্মটা হলো এই যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখল করা আর সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে যারা যথার্থই ক্ষমতাসীন তাদের বিরুদ্ধে নিষ্পত্তিকর সংগ্রামে জিতেই শুধু, সেটা লাভ করা যেতে পারে, তারা হলো সামরিক দঙ্গল, কাভেনিয়াকরা, যারা অবলম্বন হিসেবে নির্ভর করছে পেত্রগ্রাদে আনান প্রতিক্রিয়াশীল সৈনিকদের উপর এবং কাদেত আর রাজতন্ত্রীদের উপর।

পরিস্থিতির সারমর্ম এই যে, এই নতুন রাষ্ট্র ক্ষমতাধারীদের পরাস্ত করতে পারে শুধু, বিপ্লবী জনরাশি, তাদের সচল করার জন্য প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্ব শুধু নয়, অধিকন্তু তাদের পিঠ ফেরান চাই সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিক পার্টির দিকে, যে পার্টি দুটো বিপ্লবের কর্মব্রতের প্রতি বেইমানি করেছে। রাজনীতিতে যারা কূপমণ্ডকী নীতিকথা ঢোকায় তাদের যুক্তিধারা নিম্নরুপ: ধরে নেওয়া যাক, প্রলেতারিয়েত আর বিপ্লবী রেজিমেন্টগুলিকে যারা নিরস্ত্র করছে সেই কাভেনিয়াকদের সমর্থন করে সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিকরা ‘ভুল’ করেছে বটে; তবু ভুল সংশোধন করতে তাদের সুযোগ দিতে হবে; ‘ভুল’ সংশোধন করাটা তাদের পক্ষে ‘কঠিন’ করে তোলা ঠিক হবে না; শ্রমিকদের দিকে পেটি বুর্জোয়াদের চলে আসার ঝোঁকটাকে সহজ করে দেওয়া দরকার। এমন যুক্তিধারা শ্রমিকদের প্রতি নতুন ছলনা না হলে হতো বালসুলভ অতি সরলতা কিংবা স্রেফ বোকামি। কেননা পেটিবুর্জোয়া জনরাশির শ্রমিকদের দিকে চলে আসার ঝোঁকের অর্থ হলো, একমাত্র অর্থ হতে পারে এই জনরাশির পিঠ ফেরান সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিকদের দিকে। সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিক পার্টি এখন তাদের ভুল সংশোধন করতে পারে শুধু, ঘাতকদের সহকারী বলে সেরেতেলি, চেনোভ, দান আর রাকিৎনিকভকে প্রকাশ্যে ধিক্কার দিয়ে। এইভাবে তাদের ভুল সংশোধিত হবার সপক্ষে আমরা রয়েছি পুরোপুরি এবং নিঃশর্তভাবে…  আমরা বলেছি, বিপ্লবের মূল বিবেচ্য প্রশ্ন হলো ক্ষমতা সংক্রান্ত প্রশ্ন। সেটার সঙ্গে আমাদের আরও বলা চাই যে, বিপ্লবই আসলে প্রকৃত ক্ষমতা কোথায় রয়েছে তৎসংক্রান্ত প্রশ্নটাকে ঝাপসা করে দেওয়ার ধরন আমাদের প্রতিপদে দেখিয়ে দেয় এবং আনুষ্ঠানিক আর প্রকৃত ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্যটা খুলে ধরে। সেটাই হল প্রত্যেকটি বৈপ্লবিক কালপর্যায়ের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রকৃত ক্ষমতা ছিল সরকারের হাতে না সোভিয়েতের হাতে, সেটা ১৯১৭ সালে মার্চ আর এপ্রিল মাসে স্পষ্ট ছিল না।

আরো পড়ুন:  প্রেসনেয়া জেলার জনসভায় বক্তৃতা

কিন্তু, এই মুহর্তে রাষ্ট্র ক্ষমতাধারী কে, বিপ্লবের এই মূল বিবেচ্য বিষয়টার স্থিরচিত্তে মোকাবিলা করা শ্রেণী সচেতন শ্রমিকদের পক্ষে এখন বিশেষত গুরত্বপূর্ণ। সেটার বস্তুগত অভিব্যক্তিগুলি নিয়ে বিচার-বিবেচনা করুন, কথাকে কাজ বলে ধরার ভুলটা করবেন না, তাহলে প্রশ্নটার উত্তর বের করতে কোনো বেগ পেতে হবে না।

ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস একবার লিখেছিলেন, রাষ্ট্র হলো প্রধানত সশস্ত্র মানুষের সৈন্যদলসমূহ, যেগুলোর সঙ্গে থাকে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক বৈষয়িক উপাদান, যেমন জেলখানাগুলো। এখন সেটা হলো যুঙ্কারেরা আর বিশেষভাবে পেত্রগ্রাদে আনান প্রতিক্রিয়াশীল কসাকেরা (৮৩); যারা কামেনেভ এবং অন্যান্যকে জেলে আটক করে রেখেছে; যারা ‘প্রাভদা’ বন্ধ করে দিয়েছে; সৈনিকদের একটা বিশেষ অংশ এবং শ্রমিকদের যারা নিরস্ত্র করেছে; সৈনিকদের তেমনি একটা বিশেষ অংশকে যারা গুলি করে মারছে; ফৌজে সৈনিকদের তেমনিই একটা বিশেষ অংশকে যারা গুলি করে মারছে। এই জল্লাদরাই আসল রাষ্ট্রক্ষমতা। সেরেতেলিরা আর চেনোভরা ক্ষমতাহীন মন্ত্রী, পুতুল মন্ত্রী, ব্যাপক হত্যার সমর্থক পার্টিগুলির নেতা। এটাই প্রকৃত অবস্থা। সেরেতেলি আর চেনোভ নিজেরা হয়ত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ‘অনুমোদন করেন না বলে, কিংবা তাঁদের কাগজগুলো সেটা থেকে ভয়ে ভয়ে পৃথক হয়ে থাকে বলে ওই বাস্তব অবস্থাটা কিছু কম সত্য নয়। এমনসব রাজনৈতিক ভেক বদলে সারমর্মটা কিছুই বদলায় না।

পেত্রগ্রাদের ১,৫০,০০০ ভোটদাতার সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ছাপাখানা থেকে ‘লিস্তক ‘প্রাভদি’ (৮৪) নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে শ্রমিক ভেইনভকে মুঙ্কাররা খুন করেছে ৬ জুলাই। নৃশংস হত্যা নয় কি এটা? এটা কাভেনিয়াকদের কাজ নয় কি? কিন্তু তারা আমাদের বলতে পারে, সরকার কিংবা সোভিয়েতগুলি কোনোটাকে ‘দোষ দেওয়া যায় না’ এজন্য।

জবাবে আমরা বলি, সরকার আর সোভিয়েতগুলির পক্ষে সেটা আরও খারাপ অবস্থা; কেননা এর অর্থ হলো, তারা স্রেফ সাক্ষি গোপাল, নাচান পুতুল, আর আসল ক্ষমতা তাদের হাতে নয়।

জনগণকে জানতে হবে প্রথমত এবং সর্বোপরি সত্যটি তাদের জানা চাই রাষ্ট্রক্ষমতা যথার্থই পরিচালনা করছে কে। জনগণকে বলতে হবে সমগ্র সত্য, সেটা এই যে, ক্ষমতা রয়েছে কাভেনিয়াকদের (কেরেনস্কি, কিছু, কিছু, জেনারেল, অফিসার, ইত্যাদির) একটা সামরিক ঘোঁটের হাতে, তাদের সমর্থন করছে কাদেত পার্টির নেতৃত্বাধীন শ্রেণি হিসেবে বুর্জোয়া শ্রেণি এবং ‘নোভয়ে ভ্রেমিয়া’, ‘জিভয়ে স্লোভ’ (৮৫), ইত্যাদি, ইত্যাদি কৃষ্ণশতকী পত্রপত্রিকা মারফত যাবতীয় রাজতন্ত্রীরা।

সেই ক্ষমতাটাকে উচ্ছেদ করতে হবে। সেটা না করা হলে প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে লড়ার সমস্ত কথাই অঢেল বুলি কপচানি, ‘আত্মপ্রবঞ্চনা এবং জনগণের প্রতি প্রবঞ্চনায়’ পৌঁছয়।

মন্ত্রিসভায় সেরেতেলিরা আর চেনোভরা এবং তাদের নিজ নিজ পার্টি উভয়ের সমর্থন এখন রয়েছে সেই ক্ষমতার প্রতি। জনগণের কাছে আমাদের ব্যাখ্যা করে বলতে হবে তারা যে জল্লাদের ভূমিকায় রয়েছে সেই কথাটি, আর এই সত্যটি যে, এইসব পার্টির এমন ‘উপসংহার’ অনিবার্যই ছিল তাদের ২১ এপ্রিল, ৫ মে, ৯ জন এবং ৪ জুলাইয়ের ‘ভুলগুলোর’ পরে, আক্রমণের কর্মনীতি (৮৬) অনুমোদনের পরে, জুলাই মাসে কাভেনিয়াকদের জয় নয়দশমাংশই পূর্বনির্ধারণ করে দিয়েছিল যে কর্মনীতি।

জনগণের মধ্যে সমস্ত বিক্ষোভ সৃষ্টির কাজে বিবেচনায় থাকা চাই বর্তমান বিপ্লবের এবং বিশেষত জুলাইয়ের দিনগুলির বিশেষ অভিজ্ঞতা, অর্থাৎ তাতে স্পষ্ট নির্দেশ করা চাই জনগণের আসল শত্রুকে – সামরিক ঘোঁট, কাদেতরা আর কৃষ্ণশতকীরা, আর তাতে স্পষ্ট করে স্বরূপ প্রকাশ করা চাই পেটি বুর্জোয়া পার্টি দুটোর, সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিক পার্টির, যারা কসাইয়ের সহকারীর ভূমিকায় থেকেছে এবং এখনো রয়েছে, এটা যাতে নিশ্চিত হয় সেইভাবে কাজটাকে পুনঃসংগঠিত করতে হবে।

সামরিক ঘোঁটটার ক্ষমতা যতক্ষণ উচ্ছেদ করা হচ্ছে না, আর সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি এবং মেনশেভিক পার্টি দুটোর স্বরূপ খুলে ধরা এবং তাদের জনগণের আস্থাবিহিত করা যতক্ষণ হচ্ছে না, ততক্ষণ কৃষকদের ভূমি পাবার আশা করা একেবারেই বৃথা, এটা যাতে স্পষ্ট করে দেওয়া যায় সেইভাবে পুনঃসংগঠিত করতে হবে জনগণের মধ্যে সমস্ত বিক্ষোভ সৃষ্টির কাজ। পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের স্বাভাবিক সাধারণ পরিবেশে সেটা খুবই দীর্ঘ এবং দুঃসাধ্য প্রক্রিয়া, কিন্তু সেটাকে প্রচণ্ড মাত্রায় ত্বরিত করবে যুদ্ধ আর অর্থনৈতিক ভগ্নদশা উভয়ই। তা এমন ‘ত্বরক’ যা মাসকে, এমন কি সপ্তাহকেও করে ফেলতে পারে বছরের সমান।

উপরে যা বলা হলো সেটার বিরুদ্ধে হয়ত দুটো আপত্তি উঠতে পারে : এক, এখন নিষ্পত্তিকর সংগ্রামের কথা বলার মানে বিক্ষিপ্ত লড়াইয়ে উৎসাহ দান, যাতে লাভবান হতে পারে শুধু, প্রতিবিপ্লবীরাই; দুই, তাদের উচ্ছেদ করা হলে তখনো সূচিত হবে সোভিয়েতগুলির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরণ।

আরো পড়ুন:  আমাদের মতামত

প্রথম আপত্তির উত্তরে আমরা বলি: সময়টা যখন স্পষ্টতই রাশিয়ার শ্রমিকদের প্রতিকূল, সে মুহূর্তে প্ররোচনায় ফেসে না যাবার মতো যথেষ্ট শ্রেণিচেতনা তাদের ইতিমধ্যে রয়েছে। এই মুহুর্তে তাদের ব্যবস্থা নেওয়া, এবং প্রতিরোধ করার অর্থ হবে প্রতিবিপ্লবীদের আনুকূল্য করা, এটা অকাট্য। জনরাশির একেবারে গভীরেই নতুন বৈপ্লবিক জোয়ার এলে কেবল সেক্ষেত্রেই সম্ভব হবে নিষ্পত্তিকর সংগ্রাম, তাও তর্কাতীত। কিন্তু বৈপ্লবিক উচ্ছ্রয়, বিপ্লবের উঠতি জোয়ার, পশ্চিম ইউরোপীয় শ্রমিকদের আনুকূল্য, ইত্যাদি কথা সাধারণভাবে বলাই যথেষ্ট নয়; আমাদের অতীত থেকে, আমাদের যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে সেটা থেকে আমাদের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বের করতে হবে এবং তা থেকে ক্ষমতা হস্তগতকারী সেই প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে নিষ্পত্তিকর সংগ্রামের স্লোগানে আমরা পৌঁছই। সুনির্দিষ্ট বাস্তবতার বদলে বড় বেশি সাধারণ ধরনের যুক্তি বাতলানতে পর্যবসিত হয় দ্বিতীয় আপত্তিটাও। বৈপ্লবিক প্রলেতারিয়েত ছাড়া কেউ, কোনো শক্তি উচ্ছেদ করতে পারে না বুর্জোয়া প্রতিবিপ্লবীদের। এখন, ১৯১৭ সালে জুলাইয়ের অভিজ্ঞতার পরে রাষ্ট্র ক্ষমতা স্বাধীনভাবে হাতে তুলে নিতে হবে বৈপ্লবিক প্রলেতারিয়েতকেই। তাছাড়া বিপ্লবের বিজয় অসম্ভব। ক্ষমতা থাকবে প্রলেতারিয়েতের হাতে, আর প্রলেতারিয়েত হবে গরিব কৃষক বা আধা প্রলেতারিয়ানদের সমর্থনপুষ্ট এটাই একমাত্র মীমাংসা। এই মীমাংসাকে বিপুল মাত্রায় ত্বরণক্ষম উপাদানগুলি আমরা ইতিমধ্যেই নির্দেশ করেছি।

এই নতুন বিপ্লবে সোভিয়েতগুলি দেখা দিতে পারে, দেখা দেওয়াটাই অবধারিত, কিন্তু এখনকার সোভিয়েতগুলি নয়, বুর্জোয়াদের কুকর্মে সহযোগী সংস্থাগুলি নয়, সেগুলি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক সংগ্রামের সংস্থা। সোভিয়েতগুলির মডেল অনুসারে গোটা রাষ্ট্র গড়ে তোলার সপক্ষে আমরা থাকব তখনো, তা ঠিক। সাধারণভাবে সোভিয়েতগুলির প্রশ্ন এটা নয়, এটা হলো এখনকার প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে এবং এখনকার সোভিয়েতগুলির বেইমানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্ন।

নির্দিষ্ট কিছুর বদলি বিমূর্ত কিছু, দাঁড় করানটা হলো বিপ্লবে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক দোষ। এখনকার সোভিয়েতগুলি ব্যর্থ হয়েছে, সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়েছে, কেননা সেগুলিতে রয়েছে সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিক পার্টির আধিপত্য। এখন এইসব সোভিয়েত হলো যেন কসাইখানায় আনা ভেড়াগুলো করুণ স্বরে ব্যা-ব্যা করছে খাঁড়ার নিচে। বিজয়ী এবং জয়োন্মত্ত প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে সোভিয়েতগুলি বর্তমানে ক্ষমতাহীন, অসহায়। সোভিয়েতগুলির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরণ দাবির স্লোগানের ব্যাখ্যা হতে পারে এখনকার সোভিয়েতগুলির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরণের জন্য ‘সরল’ আহবান, কিন্তু সেটা বলা, সেজন্য আহবান জানাবার অর্থ এখন হবে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া। প্রতারণার চেয়ে বিপজ্জনক নয় আর কিছুই।

২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত রাশিয়ায় শ্রেণিগত আর পার্টিগত সংগ্রাম বিকাশের চক্রটা সম্পূর্ণ হয়েছে। শুরু হচ্ছে একটা নতুন চক্র, তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পুরনো শ্রেণিগুলি নয়, পুরনো পার্টিগুলি নয়, পুরনো সোভিয়েতগুলি নয়, সেগুলি হলো সংগ্রামের আগুনে নতুন হয়ে ওঠা, সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় মজবুত হয়ে ওঠা, তালিম পাওয়া, নতুন করে গড়া বিভিন্ন শ্রেণি, পার্টি আর সোভিয়েতগুলি। আমাদের নজর ফেলতে হবে সামনে, পিছনে নয়। পুরনো নয়, নতুন, জুলাই পরবর্তী শ্রেণিগত আর পার্টিগত নিরিখ অনুসারে আমাদের কাজ চালাতে হবে। নতুন চক্রের শুরুতে আমাদের এগোতে হবে বিজয়ী বুর্জোয়া প্রতিবিপ্লব থেকে, যেটা জয়যুক্ত হয়েছে সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশানারিরা আর মেনশেভিকরা সেটার সঙ্গে আপস করেছে বলে, তাকে পরাস্ত করতে পারে শুধু বৈপ্লবিক প্রলেতারিয়েত। প্রতিবিপ্লবের পূর্ণ বিজয় এবং সোশ্যালিস্ট রেভলিউশানারি আর মেনশেভিকদের পুরোদস্তুর পরাজয় (সংগ্রাম ছাড়া) দুইয়েরই আগে, আর নতুন বিপ্লবের নতুন জোয়ারের আগে এই নতুন চক্রে নিশ্চয়ই থাকবে বহু, এবং বিভিন্ন পর্ব। কিন্তু সে সম্বন্ধে বলা সম্ভব হবে শুধু, পরে তার এক-একটা পর্বে পৌঁছবার সময়ে…

১৯১৭ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি লিখিত

৩৪ খণ্ড, ১০-১৭ পৃ

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখাটির অনুবাদ নেয়া হয়েছে লেনিনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নামক সংকলন, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৬৮; ১৪২-১৫০ পৃষ্ঠা থেকে। এখানে সংখ্যায় উল্লেখিত ৮০-৮৬ টীকাসমূহ লেখা হয়নি।

Leave a Comment

error: Content is protected !!