ছড়া হচ্ছে বিশেষ ধরনের ছন্দের ক্ষুদ্রাকার কবিতা বা পদ্য

ছড়া (ইংরেজি: Rhyme) হচ্ছে বিশেষ ধরনের ছন্দের ক্ষুদ্রাকার কবিতা বা পদ্য। বাংলা কবিতার ঘরোয়া গ্রামীণ ব্যবহারে ছড়া প্রধান ধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে নতুন গদ্যভাষা আবির্ভাবের পূর্বে ছড়া বাংলা সাহিত্যের একটি শক্তিশালী ধরন হিসেবে বিবেচিত ছিল। সাধারণত স্বরবৃত্ত ছন্দে গ্রাম্য ছড়া বা লৌকিক কাব্য ধারা রচিত হয়েছে।[১]

ছড়াকে মানুষের আদিমতম সাহিত্য-প্রয়াসগুলির অন্যতম বলে মনে করা হয়। প্রায়ই স্মরণাতীত কাল থেকে এ অবধি সুরে-ছন্দে-লয়ে-তালে যখনি মানুষ কিছু ব্যক্ত করতে চেয়েছে, তখনি ছড়া জাতীয় সৃষ্টির একটা মৃদু উদ্ভাস ঘটেছে বলতে পারি। দেবতাদের উদ্দেশে স্তব, স্তুতি ইত্যাদি যা হতো ছন্দ-সুরের মাধ্যমে যেসব নিবেদন করতেন প্রাগৈতিহাসিক প্রপিতামহরা — তার থেকেই ছড়ারও আদি-উৎসরণের পথ খুলে যায়। কালক্রমে তার অন্তর্গত ধর্ম-দেবতা ইত্যাদির অনুষঙ্গটা মুছে যায়, লোকায়ত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে তার অভিব্যক্তি ঘটতে থাকে।

ছড়ার প্রকারভেদ

সর্বত্রই ছড়া মূলত দুধরনের : ১. সর্বজনীন ও ২. ছেলেভুলানো। সর্বজনীন ছড়ার যে গঠনকাঠামো রয়েছে সেটিকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে প্রবাদ-প্রবচন, ধাধা, ব্রত, খেলাধূলা এমনকী বিয়ের নাপিতের ছড়াও। এছাড়া বাঘ-তাড়ানো বা ভূত-তাড়ানোর মন্ত্র ও ছড়ার আকারেই তৈরি হয়।

ছেলেভুলানো ছড়ায় সামাজিক ও পরিচিত পারিবারিক জীবনের অভিভব সর্বাধিক তাই শিশুরাও ভালো করে কথা বলতে শেখার আগে ছড়ার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে। তবে এর আরেকটা বড় কারণ হলো ছড়ার অন্তর্লীন ছন্দোস্পন্দন। এই নিবেদন বৈশিষ্ট্যই সম্ভবত ছড়াকে সবচেয়ে জনপ্রিয় মৌখিকশিল্পের মর্যাদা দিয়েছে।[২]

প্রবাদ-প্রবচন-ধাধা­ ব্রতের ‘মন্তর’ ইত্যাদির মধ্যেও ছড়া বাকশিল্পটির প্রকাশ হামেশাই দেখা যায়। এমন কি, বিয়ের লোকাচার হিসেবেও ছড়ার প্রয়োগ অপ্রচলিত নয়। ভূত-বাঘ-সাপ ইত্যাদির ‘মোকাবিলা’ (!) করার জন্য ছড়ার আকারে মন্ত্র-তন্ত্র ব্যবহার করা হয়। তবে এগুলিকে যথা-অর্থে ছড়া বলে গণ্য না-করাই ভাল। তাহলে যথার্থ-‘ছড়া’ কোন্গুলিকে বলব? যেখানে ধর্ম-সংস্কার-লোকাচার-অলৌকিকে বিশ্বাস ইত্যাদি থাকে না— সেগুলিই হল ‘প্রকৃত’ ছড়া। পূর্বোক্ত দুটি বর্গ তাদের মধ্যেই প্রাপ্য।

আপাতভাবে ছড়ার মধ্যে পরিচিত জগতের নানা ধরনের চিত্রকল্প (অর্থাৎ ইমেজারি) টুকরো-টুকরোভাবে ছড়িয়ে থাকে এবং হর-হামেশাই এক ধরনের অসংলগ্নতাও তাদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় । ঐ অসংলগ্নতার ‘কোলাজ’-এই গড়ে ওঠে ছড়ার ভাব ও রূপগত কাঠামো। ছেলেভুলানো ছড়াগুলি এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। শিশুর ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নানারকমের অর্থবিহীন শব্দবিন্যাস হলো ছেলেভুলানো ছড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। সার্থক এবং অনর্থক বিভিন্ন শব্দের সমন্বয়ে যে আপাতভাবে অসংলগ্ন কোলাজের কথা এখনি বলেছি, সেখানে সবটা মিলিয়ে একটা ভাব-অনুভূতিময় রূপের অবিচ্ছিন্ন প্রতিভাস শ্রোতার মনে উপস্থিত হয়। দু-একটা উদাহরণ এখানে দেওয়াই যায়; যেমন: 

ক) ‘হাট্টিমা টিম টিম / তারা মাঠে পাড়ে ডিম / তাদের খাড়া দুটো শিং / তারা হাট্টিমা টিম টিম।/ তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা কোলা ব্যাঙের ছা/ খায়-দায় / তাইরে নাইরে না। / চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে । কদমতলায় কে? হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে/ সোনামণির বে’।

খ) ‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি। যদু মাস্টার শ্বশুর বাড়ি। রেল কম ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম।’

উদ্ধৃত এই ছড়া দুটিকে অন্বিষ্টভাবে বিচার করলেই ছড়ার প্রকৃত চরিত্র এবং রূপ সম্পর্কে একটা ধারণা করা যেতে পারবে। ‘ক’-এর মধ্যে কল্পিত-প্রাণী হাট্টিমা টিম টিম’-দের সম্পর্কে দু-চার কথা বলেই, তাঁতির বাড়িতে কোলাব্যাঙের ছানারা কী-কী করে, সে সবের খোঁজ দেওয়া হয়েছে। (হাট্টিমাদের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক তা বুঝা না গেলেও, একটা আপাত-অসংলগ্নতার মধ্যেই কিন্তু আবছায়া কোনো কিছু রূপকে যেন উপলব্ধি করা যায়!) পরের দুই গুচ্ছ পংক্তির মধ্যে চাঁদের আলোয়-ভরা ফুল বাগানের সঙ্গে সোনামণির বিবাহের উল্লেখ মানাসই হলেও হতে পারে, হয়ত সেই আনন্দে হাতি-ঘোড়াদের নাচও না-হয় মেনে নেওয়া গেল! কিন্তু হঠাৎ কদমতলার উল্লেখ করে রাধা কৃষ্ণলীলার সঙ্কেতটা যে কেন এল, কে তা বলবে! এই অনিরসিত প্রশ্নের মধ্যে নিহিত আছে ছড়ার প্রকৃত সৌন্দর্য।

‘খ’ উদাহরণে, আই কম বাই কম খুব সম্ভবত ‘come ভাই Come’: রেল কম’ (না-কি Rain come? ঝমাঝমের সূত্রে তো সেটাই মনে হয়!) এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই যদু মাস্টার মশাই (ছাত্রদের রাগ থাকাই স্বাভাবিক তাঁর সম্পর্কে!) পা পিছলে পড়ে কাদা মাখামাখি অবস্থায় ঝোলমাখা আলুর দমের উপমেয়রূপে প্রতীত হয়েছেন। এখানে চারটে চরণের মধ্যে চিত্রকল্পের সংলগ্নতা থাকলেও, গোটা বর্ণনাটুকুর মধ্যে যে এক ধরনের ননসেন্স-ইমেজ গড়ে উঠেছে, তাতে আর সন্দেহ কী? এটাও ছড়ার পরম বৈশিষ্ট্য।

ঘুমপাড়ানি ছড়া (বা, Iullaby), ছেলে ভুলানো, খেলাধুলোর ছড়া (যেমন ‘এলাটিং বেলাটিং তেলাটিং সই লো’), ঘর-গৃহস্থালির ছড়া, উৎসব-অনুষ্ঠানের ছড়া— এই রকম নানা বর্গে যথার্থ’ ছড়াগুলোকে ভাগ করা যায়। তবে, ছড়া যে-বর্গেরই হোক নাকেন— তার অন্তর্নিহিত আপাত-অসঙ্গতিটা থাকতেই হবে; বস্তুতপক্ষে, সেটাই হলো ছড়ার প্রাণসত্তা। বাংলা ছড়ার একটা নিজস্ব ছন্দও আছে— যা শ্বাসাঘাত প্রধান বা স্বরবৃত্ত ছন্দ হিসেবে পরিচিত। চার মাত্রার এক একটি দ্রুতলয় পর্ব সাজিয়ে ঐ ছন্দ গড়ে ওঠে। উচ্চারণের মধ্যে ‘হস্’ ধ্বনিরও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে সেখানে।[৩]

তথ্যসূত্র:

১. আবুল ফজল ও রেজাউল ইসলাম, সাহিত্য তত্ত্ব-কথা, দুরন্ত পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ ২০০৯, পৃষ্ঠা ৭৯,
২. চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৮১।
৩. পল্লব সেনগুপ্ত, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ২২৪-২২৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!