পুঁজিবাদের বিকাশের বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থের নাম ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’

পুঁজিবাদের ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকের বিকাশের বিশ্লেষণমূলক যে গ্রন্থ ভ্লাদিমির লেনিন ১৯১৬ সনে রচনা করেন, সেই গ্রন্থের নাম ‘ইম্পেরিয়ালিজম, দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ বা ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’। ১৯১৭ সনের রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে বিপ্লবী আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতৃত্ব দানের জন্য লেনিন তাঁর এই গ্রন্থে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক আন্দোলনসমূহের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের পরবর্তীকালে পুঁজিবাদের বিকাশের বৈশিষ্ট্য এবং তার বিদ্যমান দ্বন্দ্বসমূহের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেন।

আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ ও প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদ এক নয়। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভুত্ব বিস্তারের প্রয়াস, তার প্রভুত্ব রাখার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি পররাজ্য গ্রাসের কারণ প্রাচীন কালের তুলনায় ভিন্নতর ও জটিল। আধুনিককালের সাম্রাজ্যবাদের যথাযথ সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণ পেশ করেছেন রুশ বিপ্লবের নেতা ভি.আই.লেনিন। তিনি তার ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের চরম স্তর’ গ্রন্থে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা দিয়ে তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (১) আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের বিকাশের একটা বিশেষ স্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত; (২) পুঁজিবাদের জাতীয় ভিত্তিক বিকাশ নিঃশেষ হলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পুঁজিবাদে সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র ইংল্যান্ড সাম্রাজ্যবাদী শাসকের রূপ গ্রহণ করে; (৩) সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ও পুঁজি কেন্দ্রীভুত হতে হতে গুটি-কয় একচেটিয়া অর্থনৈতিক পরিবার বা গোষ্ঠীর সৃষ্টি করে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে এই সমস্ত একচেটিয়া পুঁজিপতিদের করায়ত্ত হয়ে পড়ে; (৪) কালক্রমে একচেটিয়া ব্যান্কপুঁজি একচেটিয়া শিল্পপুঁজির সঙ্গে মিলিত হয়ে অর্থনৈতিক স্বৈরতান্ত্রিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটায়; (৫) অধীনস্থ দেশে উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানির স্থলে পুঁজি রপ্তানি ক্রমাণ্বয়ে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়; (৬) বিভিন্ন সাম্রাজ্যের একচেটিয়া পুঁজিপতিগণ সম্মিলিত হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে এবং বিশ্বের সমস্ত দুর্বল জাতিকে শাসন ও শোষনের জন্য নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেবার চেষ্টা করে।

আরো পড়ুন:  প্রুধোঁ প্রসঙ্গে

সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় গ্রন্থে লেনিন পুঁজিবাদের একটা বিশেষ পর্যায়রূপে সাম্রাজ্যবাদকে চিহ্নিত করেন। লেনিনের মতে,

“সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের বিকাশের সেই পর্যায়, যেখানে একচেটিয়া কারবার ও ফিনান্স পুঁজির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত, পুঁজির রপ্তানি যেখানে একটা অতি বিশিষ্ট ভূমিকা নিয়েছে, শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাস্টগুলোর মধ্যে বিশ্বের বাটোয়ারা এবং বৃহত্তম পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে ভূগোলকের সমস্ত অঞ্চলের বাটোয়ারা সমাপ্ত হয়েছে।”[৩]

লেনিন মনে করতেন যে, পুঁজিবাদের এরূপ বিকাশ তার অর্থনৈতিক আভ্যন্তরীণ সংকটের পরিচায়ক। যে পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক বিকাশের ইতিহাসে একসময় সম্ভাবনাময় অগ্রসর শক্তির কাজ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদের স্তরে সে পুঁজিবাদের বিকাশ-সম্ভাবনা নিঃশেষিত। সাম্রাজ্যবাদের স্তরে পুঁজিবাদের সংকট আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে অধিকতর তীব্র আকার ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদকারী বিপ্লবী অবস্থার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আধুনিককালের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের অস্তিত্ব আজো Iবিলুপ্ত হয় নি। তাদের প্রভুত্ব বজায় রাখার নতুন নতুন কৌশল তারা উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছে।

তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২১৩-২১৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!