বস্তুবাদ হচ্ছে দর্শনের ধারণা, যাতে বোঝায় জাগতিক যাবতীয় অস্তিত্বের আধার বস্তু

বস্তুবাদ বা জড়বাদ (ইংরেজি: Materialism) হচ্ছে দর্শন শাস্ত্রের অন্তর্গত একটি ধারণা, যা বলতে বোঝায় জাগতিক যাবতীয় অস্তিত্বের আধার হলো বস্তু (matter)। বস্তুময় জগৎ হলো চিরন্তন এবং স্থান ও কালের নিরিখে অসীম। বিবর্তনের ধারায় উদ্ভূত মানুষের ভাব ও চেতনা বস্তুভিত্তিক ও বস্তুরই প্রতিফলন। বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত মস্তিষ্কের ক্রিয়া হলো চিন্তন ও চেতনা।

বস্তুবাদের মূলকথা হলো বস্তুসত্তা, প্রকৃতি, নৈর্বক্তিক বাস্তবতাই আদি এবং চেতনা বস্তুসত্তারই গুণ।[১] বস্তুবাদী দর্শনে বস্তুকেই সব কিছুর অগ্রবর্তী বলে মনে করা হয়। বিশ্বতত্ত্ব (cosmology) বিচারপ্রসঙ্গে বস্তুবাদীরা দু’শ্রেণিতে বিভক্ত। এক শ্রেণির বিশ্লেষণ পদ্ধতি যান্ত্রিক (mechanistic) এবং অপর শ্রেণির পদ্ধতি দ্বান্দ্বিক (dialectical)। মার্কসীয় দর্শনে বস্তুবাদ দ্বিবিধ ধারায় বিবেচিত হয়েছে : এক. ইতিহাস, সমাজ ও অর্থনীতির ভিত্তিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও দুই. হেগেলের প্রভাবে গঠিত প্রত্যয় নয়, প্রতিনয় ও সমম্বয় প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ।

বিশ্বজগতকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দুটি অভিমত মৌলিক এবং প্রধান; একটি বস্তুবাদ অপরটি ভাববাদ। মানুষের চেতনার বিকাশের আদিকাল থেকে এই দুই মতবাদের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। দর্শনের সমগ্র ইতিহাস – বস্তুবাদ ও ভাববাদের দ্বন্দ্বের ইতিহাস।

বস্তুবাদ এবং তার প্রকারভেদ

বস্তুবাদকে দুইভাগে ভাগ করে বিবেচনা করা যায়। সাধারণ বস্তুবাদ, এবং দার্শনিক বস্তুবাদ। সাধারণ বস্তুবাদ বলতে জগত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতবাদ বুঝায়। চারিপাশের জগৎ সত্য না মিথ্যা, মায়া না যথার্থ, এ সম্পর্কে মানুষের মনে আদিকাল থেকেই প্রশ্ন জেগেছে। সাধারণ মানুষ গভীর যুক্তি-তর্ক ব্যতিরিকেই জীবন যাপনের বাস্তব প্রয়োজনে জগৎ এবং বাস্তবকে সত্য বলে মনে করেছে। কিন্তু জগতের বৈচিত্র্য এবং প্রতিমুহুর্তের পরিবর্তনের ব্যাখ্যার জন্য সাধারণ বস্তুবাদ যথেষ্ট নয়। এই সাধারণ বা স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক এবং পূর্ণতার বিশ্লেষণ ঘটেছে দার্শনিক বস্তুবাদে।

জগৎ সম্পর্কে দার্শনিক বস্তুবাদের অভিমত হচ্ছে: বস্তু এবং মন বা ভাবের মধ্যে বস্তু হচ্চে প্রধান। মন, চেতনা এবং ভাব অপ্রধান। এরই অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছেঃ বিশ্বজগত অবিনশ্বর এবং শাশ্বত। ঈশ্বর বা অপর কোনো বহিঃশক্তি বিশ্বের স্রষ্টা নয়। স্থান এবং কাল উভয়তই বিশ্ব অসীম। কোনো বিশেষ সময় বা কালে যেমন বিশ্বকে অপর কেউ সৃষ্টি করে নি, তেমনি স্থানিক সীমা বলেও বিশ্বের কোনো সীমা নেই। বিশ্ব হচ্ছে বস্তু। চেতনা বিশ্বের বিবর্তনের সৃষ্টি। চেতনা বিশ্বের প্রতিচ্ছায়া। চেতনা যখন বিশ্বের সৃষ্টি তখন বিশ্ব চেতনার অজ্ঞেয় নয়।[২]  

বস্তুবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ

বস্তুবাদ গ্রিস, ভারত প্রভৃতি দেশে প্রাচীনকালেই দেখা দেয়। আঠারো শতকে ইউরোপের আলোকায়নের আন্দোলনকালে (Enlightenment) মনে করা হতো যে বস্তুর বাইরে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। যে সব বিষয় মানসিক বা ভাবগত বলে মনে করা হয় সেগুলি প্রকৃতপক্ষে বস্তুগত প্রক্রিয়া, দেখার ভঙ্গিতে ভাবগত বলে অনুভূত হয়।[৩]

বস্তুবাদের বিকাশের ইতিহাস দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত – প্রাক-মার্কসীয় বস্তুবাদ (স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদ, রেনেসাঁসের যুগের বস্তুবাদ) এবং মার্কসীয় বস্তুবাদ। দর্শনের ইতিহাসে দেখা যায় যে, বস্তুবাদ প্রত্যেক যুগের প্রগতিশীল ব্যক্তি এবং শ্রেণির দর্শন হিসেবে অনুসৃত হয়েছে। যে ব্যক্তি বা শ্রেণি জগতকে সঠিকভাবে জানতে চেয়েছে এবং সেই জ্ঞানের সাহায্যে প্রকৃতির উপর মানুষের শক্তিকে বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেছে তারাই বস্তুবাদকে তাদের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছে। বস্তুবাদ কোনো কাল্পনিক অভিমত নয়। যে-কোনো যুগের বৈজ্ঞানিক বিকাশের সূত্রকার বিবরণই বস্তুবাদ। বিজ্ঞানের বিবরণ যেমন বস্তুবাদ, তেমনি বস্তুবাদ আবার বিজ্ঞানের অগ্রগতিরও হাতিয়ার। বিজ্ঞান ও বস্তুবাদ তাই পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত। এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও বস্তুবাদ উভয়ই নিরন্তর বিকাশ লাভ করেছে।

বস্তুবাদের জন্ম এবং বিকাশ কোনো বিশেষ দেশে সীমাবদ্ধ থাকে নি। প্রাচীন ভারত, চীন এবং গ্রিসের দাসভিত্তিক সমাজে জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং মানুষের অভিজ্ঞতাভিত্তিক অন্যান্য জ্ঞানসূত্র বিকাশলাভ করার ফলে বস্তুবাদ প্রথম জন্মলাভ করে। প্রাচীনকালের এই বস্তুবাদ জগৎ সংসারের সমস্যাদির ব্যাখ্যায় স্বাভাবিকভাবেই অতি সহজ বা প্রাথমিক চরিত্রের ছিল। বস্তুজগৎ মন নিরপেক্ষভাবেই অস্তিত্বসম্পন্ন, এই ছিল প্রাচীন বস্তুবাদের ধারণা। জগতের বৈচিত্র্যের মূলে কোনো একক নিশ্চয়ই আছে। এবং সে একক অবশ্যই বস্তু। প্রাচীন বস্তুবাদীদের মধ্যে চীনের লাওজু, ওয়াং চু, ভারতের চার্বাকমত, গ্রিসের হিরাক্লিটাস, এ্যানাক্সাগোরাস, এমপিডোকলিস, এপিক্যুরাস নামক দার্শনিকের নাম সুপরিচিত। লউসিপাস, ডিমোক্রিটাস প্রমুখ প্রাচীন বস্তুবাদী দার্শনিকগণ বিচিত্র বস্তুর মূল হিসেবে একক কিংবা একাধিক অণুর অস্তিত্বের কথাও কল্পনা করেছিলেন।

প্রাচীন বস্তুবাদের একটি অসম্পূর্ণতা এই ছিল যে, প্রাচীন বস্তুবাদের পক্ষে বস্তু এবং মনের পার্থক্য এবং সম্পর্কের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় নি। মন বা চেতনার সকল বৈশিষ্ট্যকেই প্রাচীন বস্তুবাদ বস্তুর প্রকারভেদ বলে ব্যাখ্যা করতে চাইত। কিন্তু মন এবং চেতনা একটি জটিল সত্তা। তাকে কেবল বস্তুর প্রকারভেদ বললে তার সম্যক জ্ঞান লাভ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রাচীন বস্তুবাদের মধ্যে প্রাচীন ধর্মীয় অলীক বিশ্বাসেরও আভাস পাওয়া যায়।

ইউরোপের মধ্যযুগে বস্তুবাদ ধর্মীয় প্রকৃতিবাদের রূপ গ্রহণ করে। সর্ববস্তুতে ঈশ্বর প্রকাশিত এবং প্রকৃতি ও ঈশ্বর উভয়ই নিত্যসত্য, এই অভিমতের মাধ্যমে বস্তুবাদ এই যুগে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেছে। ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে বস্তুবাদের পরবর্তী পর্যায়ের বিকাশ ঘটে। আর্থনীতিক উৎপাদন, বিজ্ঞান এবং কারিগরি কৌশলের নতুনতর উন্নতির পরিবেশে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে বস্তুবাদ মধ্যযুগের চেয়ে অধিকতর সুস্পষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে। এই পর্যায়ের বস্তুবাদী দার্শনিকদের মধ্যে বেকন, গেলিলিও, টমাস হবস, গাসেন্দী, স্পিনোজা এবং লকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পর্যায়ে বস্তুবাদী দার্শনিকগণ অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানের উৎস এবং প্রকৃতিকে মূল সত্তা ধরে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা এবং যাজক প্রাধান্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন।[৪]  

বস্তুবাদ হতে পুঁজিবাদী অন্যান্য শাখার উৎপত্তি

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে প্রধান বিকাশ ঘটে গণিত এবং বলবিদ্যায়। বিজ্ঞানের এই দুই শাখার উপর নির্ভর করাতে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের বস্তুবাদী দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দেয় যান্ত্রিকতা। চেতনাসহ বস্তুর বিভিন্ন প্রকাশের মধ্যকার অন্তর্নিহিত সংযোগ সূত্র প্রকাশে এই বস্তুবাদ ব্যর্থ হয়। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বস্তুবাদী দার্শনিক ডিডেরট, হেলভিটিয়াস, হলবাক এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার প্রয়াস পান। এর পরবর্তী পর্যায়ে জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাকের মধ্যে আমরা নৃতাত্ত্বিক বস্তুবাদের বিকাশ দেখি।

বস্তু সম্পর্কে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ায় আঠারো শতকে নিউটনের ধ্রুপদী mechanistic প্রত্যয় ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। বৈজ্ঞানিকদের অভিমতের ভিত্তিতে মানবেন্দ্রনাথ রায় মনে করেন যে বস্তু বা জড় এখন নিছক একটা স্পর্শনীয় সত্তা (hard lump of reality) নয়। আইনস্টাইন, প্ল্যাঙ্ক প্রমুখ।পদার্থবিদদের বক্তব্য বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে পদার্থবিদ্যার সাম্প্রতিক চিন্তাভাবনা বস্তু সম্পর্কে পূর্বতন সংকীর্ণ ধারণা ভেঙে দিয়েছে। সেজন্য তাঁর মতে বস্তুবাদকে physical realism নামে অভিহিত করাই সঙ্গত।

মনোজগৎ বস্তুর অন্তর্গত। মানুষও প্রাকৃতিক জগতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মানুষের আচরণ মনোবিদ্যা নিয়ন্ত্রণ করে, যার ভিত্তি হলো শারীরবিদ্যা ও রসায়ন। পদার্থবিদ্যা ও মনোবিদ্যার মধ্যে এক সেতুবন্ধ রচিত হয়েছে। সর্বতোভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব না হলেও physic-chemical subslance-এ গঠিত দেহের বিকারেই তিনি প্রাণের উৎস দর্শিয়েছেন। জৈব বিবর্তনের ধারায় প্রাণ ও মস্তিষ্কের পরিণত অবস্থায় চিন্তন এক বস্তুনিরপেক্ষ সত্তা অর্জন করেছে। চিন্তন মস্তিষ্কের ক্রিয়া; কিন্তু তা স্বাধীন গতিতে অগ্রসর হয়। বস্তুবাদে চিন্তন একটি “objective reality” হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে । পরিবেশ তাকে প্রভাবিত করে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করে না। উভয়ের যুগপৎ ও সমান্তরাল গতি ইতিহাসের জৈবপ্রক্রিয়ার (organic process) বিচার-পদ্ধতি সৃজন করেছে ; বস্তু ও চেতনাকে মানবেন্দ্রনাথ অদ্বয় (monistic) সত্তায় সমন্বিত করেছেন। পক্ষান্তরে পূর্বোক্ত যান্ত্রিক ও দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিতে বস্তু ও চেতনা দ্বৈতরূপে বিশ্লেষিত হয়েছে।

উল্লিখিত যান্ত্রিক প্রত্যয়কে তিনি প্রত্যক্ষপূর্ব জ্ঞানপদ্ধতি (a-priori) হিসাবে দেখেছেন, যাতে জগৎপ্রকৃতি যেন একটা ঘড়ির মতো পূর্বনিধারিত এক পরিণামবাদী (tcleological) নিয়মে ক্রিয়াশীল, তাঁর মতে প্রকৃতিবিজ্ঞান এখনকার দৃষ্টিতে অবরোহী (deluctive) প্রণালীতে চলে না; আরোহী (inductive) পদ্ধতিই বিজ্ঞানসম্মত। প্রকৃতি বিজ্ঞান কোনও দিওয়াল লিখন নয়। কতকগুলি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বারে বারে ঘটে, যার অপরিবর্তনীয় (invariant) সম্পর্ক গবেষণার মাধ্যমে গাণিতিক সূত্রে পরিমাপ করা সম্ভব। এবং প্রকৃতির বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যেও একটি যোগসূত্র থাকে । সেইসব ঘটনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে মানবেন্দ্রনাথ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে বস্তুবাদের পশ্চাতে এক নিয়ম নিয়ন্ত্রিত জগৎ (law-governed universe) প্রত্যয় কাজ করে। জগতের বিভিন্ন নিয়ম নিয়ন্ত্রিত অংশের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা (order) লক্ষিত হয়। সেটি পরিণামবাদী নয়। তদনুযায়ী প্রকৃতির অংশ হিসাবে বস্তু ও প্রাণের মধ্যে কোনও ফাঁক নেই। জৈব বিবর্তন ধারায় সঞ্জাত মানুষের যুক্তিবোধ সেই নিয়ম নিয়ন্ত্রিত জগতের অংশ। তাতে মানুষের সব আচরণই ব্যাখ্যা করা যায়।[৫]

মার্কসীয় বস্তুবাদ

বস্তুবাদের পূর্ণতর বৈজ্ঞানিক বিকাশ ঘটেছে ঊনবিংশ শতকের কার্ল মার্কস, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এবং লেনিনের দার্শনিক চিন্তাধারায়। বস্তুবাদের প্রকৃত বৈজ্ঞানিক রূপ হল মার্কসীয় বস্তুবাদ, যা বস্তুবাদকে জ্ঞানের সার্বিক পদ্ধতি – দ্বন্দ্বতত্ত্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। যেখানে প্রাক-মার্কসীয় বস্তুবাদে প্রকৃতি প্রধানত কতগুলো জিনিসের সমষ্টি, মার্কসবাদ সেখানে একে প্রক্রিয়াসমূহের একটি সমাহার হিসাবে দেখে, যেগুলো গুণগতভাবে পৃথক হলেও পরম্পরযুক্ত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সামাজিক জীবনের বস্তুবাদী উপলব্ধির সঙ্গে জড়িত।

প্রাচীন বস্তুবাদের প্রকৃতিগত স্বাধীনতা, হেগেলের দ্বন্দ্বের তত্ত্ব এবং মনুষ্য সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের বাস্তব বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। মার্কসীয় বস্তুবাদ কেবল বিশ্বসংসারের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। মার্কসীয় বস্তুবাদ বর্তমান বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের হাতে নতুনতর সঙ্গতিপূর্ণ মনুষ্য সমাজ তৈরির প্রধান হাতিয়ার। বস্তুত, দর্শনের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত যেখানে ভাববাদের প্রাধান্য ছিল, সেখানে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বন্দ্বমূলক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে।

মানুষের তথা সমাজের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সারমর্ম হলো যে সর্ববিধ সামাজিক বিধিব্যবস্থার মূলে অর্থনৈতিক উৎপাদনের চালিকা শক্তি ও উৎপাদনের অন্তর্গত শ্রেণী সম্পর্কের অন্তর্বিরোধ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে যুগপৎ গতিশীল করে তোলে। রাজনৈতিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কিত তত্ত্ব কিংবা লোকের মূল্যবোধ, চিন্তাভাবনা ও নৈতিক মনোভঙ্গি অনুযায়ী নানান সামাজিক তত্ত্ব বস্তুবাদী কিংবা ভাববাদী আখ্যায় অভিহিত হয়। অন্যদিকে মার্কসীয় দৃষ্টিতে বস্তুবাদের দ্বান্দ্বিক ধারায় বস্তুর গতিপ্রকৃতি বিরোধ, সমন্বয় ও পুনর্বিরোধের মধ্যে দিয়ে উর্ধ্বমুখী ঘূর্ণায়মান (spiral) অগ্রগমনের ধারায় নিয়ন্ত্রিত।[৬]

তথ্যসূত্র:

১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১০৮-১০৯
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৭৭-২৭৯।
৩. অনুপ সাদি, ৩০ জুন ২০১৯, “বস্তুবাদ প্রসঙ্গে” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/encyclopedia/marxist-glossary/on-materialism/
৪. সরদার ফজলুল করিম; পূর্বোক্ত
৫. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ১৯৭-১৯৯।
৬. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত।

রচনাকাল ৩০ জুন ২০১৯, কুরপাড় নেত্রকোনা

Leave a Comment

error: Content is protected !!