ক্ষমতা হচ্ছে বাধা বা বিনা বাধায় ঈপ্সিত কোনো কিছু অর্জনের সামর্থ্য

ঈপ্সিত যে কোনও কিছু বিনা বাধায় অথবা বাধার মধ্য দিয়ে অর্জনের সামর্থ্য হলো ক্ষমতা (ইংরেজি: Power)। ক্ষমতার তারতম্য থাকে। খেতাব হিসেবে কিংবা প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ক্ষমতা প্রদত্ত হয়; সীমিতভাবে অথবা ভাগাভাগি করে কিংবা সম্মতিক্রমে অথবা বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জন সম্ভব। প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার প্রয়ােগ ঘটে।

কর্তৃত্ব, বৈধতা, অধিকার ইত্যাদি সমার্থক শব্দ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্ষমতা প্রত্যয়টি হলো রাজনীতির যথার্থ সারবস্তু; এ বিষয়ে অনেক তত্ত্ব আছে, তার মুখ্য উপজীব্য হলো ক্ষমতার রূপান্তর, সীমিতকরণ ও লােকের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য করে তােলা।

ক্ষমতার প্রকারভেদ আছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করা যায়; ক্ষমতা যদি রাজনৈতিক হয়, তা হলে তার সাহায্যে আইন প্রস্তুতির কাজকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব; ক্ষমতা ব্যক্তিগত হলে সব কাজেই লােককে লাগানাে চলে। কারও কারও বিশেষ করে মার্কসীয় দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক ক্ষমতাই হলো প্রধান। অনেকের মতে সব ক্ষমতাই কার্যত একই ক্ষমতার রূপভেদ মাত্র।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ক্ষমতার সঙ্গে কর্তৃত্বের অধিকার হলো বড় প্রশ্ন। সাধারণত ক্ষমতার সঙ্গে অধিকারের প্রত্যয়কে মিশিয়ে ফেলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাজ হলো জনজীবন থেকে সেইসব ক্ষমতা অপসারণের ইঙ্গিত দেওয়া যার পিছনে জনসমর্থনপুষ্ট অধিকার থাকে না। জনগণ নগ্ন ক্ষমতালিপ্সাকে প্রশ্রয় দেয় না। যদি মনে হয় যে কর্তৃত্বের অধিকার অর্জনই আসলে প্রয়ােজন, তা হলে সেটাও ক্ষমতালিপ্সার মত দেখাবে।

ক্ষমতা অর্পণ কাকে বলে

অধিকারভুক্ত ক্ষমতা ক্রমনিম্নবর্তী ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে ন্যস্ত করাকে ক্ষমতা অর্পণ (Delegation of Power) বলে। যিনি বা যাঁরা সেই ক্ষমতা লাভ করেন তাঁরা আদেশক্রমে প্রয়ােগ শুধু নয় উর্ধ্বতনের অর্পিত ক্ষমতা প্রয়ােগের অধিকারপ্রাপ্ত প্রতিভূ হিসেবে কার্যনিবাহ এবং তাঁর হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও ক্ষমতা অর্জন করেন। অর্পিত ক্ষমতা ও অধিকারপ্রাপ্ত যিনি হন তিনি ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ অথবা মতাদর্শ অনুযায়ী চলেন। অর্পিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং প্রতিনিধি সমার্থক নয়। ক্ষমতা অর্পণের ভাল নিদর্শন হলো সামরিক কিংবা পুলিশের প্রশাসনে ঊর্ধ্বস্থানীয় আধিকারিকের ক্ষমতা ক্রমনিম্ন স্তরে বিন্যস্ত হয়।

আরো পড়ুন:  ক্ষমতা দখল করতে হবে বলশেভিকদের

ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ কাকে বলে

সরকার তথা রাষ্ট্রের কার্যধারা বিধানিক (legislative), নির্বাহী (executive) এবং বিচারবিভাগের (judiciary) মধ্যে বিভক্ত রাখার নীতি রাষ্ট্রব্যবস্থার বিবর্তনক্রমে গৃহীত হয়েছে। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণের তত্ত্ব (ইংরেজি: Theory of Separation of Power) এরিস্টটলের চিন্তায় নিহিত ছিল; সেটিকে পৃথক আকারে স্পষ্ট করে তােলেন হ্যারিংটন ও লক; কিন্তু আধুনিক দৃষ্টিতে তত্ত্বগত বিষয় হিসেবে এটি দানা বাঁধে ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কুর লেখায়। তার আগে ব্রিটেনের জনগণের স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে সেখানে ক্ষমতাকে স্বতন্ত্রীকরণের নীতি স্বীকৃতি পেয়েছিল। অবশ্য লক পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক বিষয়ের জন্য স্বতন্ত্র একটি বিভাগের প্রস্তাবনা করেন; সেটাকে মন্টেস্কু নির্বাহী বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করেন।

মন্টেস্কু প্রত্যক্ষ করেন যে স্বেচ্ছাচারী রাজা বা শাসক যাবতীয় ক্ষমতাকে নিজের হাতে কুক্ষিগত করে রাখেন; বিশেষ করে স্বেচ্ছাচারী শাসক কোনও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে বরদাস্ত করে না, যে ব্যবস্থা তার প্রতিটি বিতর্কমূলক ক্রিয়াকলাপে বাধা সৃষ্টি করে। স্বৈরতন্ত্রী রাজত্বে ক্ষমতার কাঠামােয় এমন কোনও ব্যবস্থা থাকে না যা দিয়ে ক্ষমতার রাস টেনে ধরা যায়, স্বভাবতই তাতে স্বাধীনতার কোনও নিশ্চয়তা থাকে না।

ক্ষমতার সীমাবদ্ধ রাখার জন্য মন্টেস্কু উল্লিখিত তিন ভাগে ক্ষমতার পৃথকীকরণের মাধ্যমে সেগুলির মধ্যে পারস্পরিক ভারসাম্য বজায়ের প্রয়াসী হন। তদনুযায়ী বিধানসভার সদস্যরা নির্বাহী কাজে অংশ নিতে পারবেন না। অবশ্য রাজা থাকলে তিনি কেবল পারবেন, যদি বেআইনি কাজের দরুন তাঁর বিরুদ্ধে মহাভিযােগ (ইংরেজি: impeachment) দায়ের করা যায়। এই ব্যতিক্রম রাখা হয়েছিল সদ্যসৃষ্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে প্রেসিডেন্টের একচ্ছত্র ক্ষমতার দিকে তাকিয়ে।

ব্রিটেনে নির্বাহী ক্ষমতার ক্যাবিনেট অর্থাৎ মন্ত্রিসভার উপর ন্যস্ত থাকে, পার্লামেন্টের সদস্যদের মধ্য হতে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পার্লামেন্ট মন্ত্রিসভা নিয়ন্ত্রণ করে। ঠিক তেমনি বিচারব্যবস্থায় সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হাউস অব লর্ডস বিধানিক সংস্থার অঙ্গ; স্বভাবতই বিচারকেরা বিধানিক কাজে প্রভাব বিস্তার করেন। সেটা যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিষেধক ব্যবস্থা আছে। মন্টেস্কুর আদর্শের সঙ্গে ব্রিটেনের সাংবিধানিক ধারার পুরােপুরি সামঞ্জস্য নেই; স্বাধীনতার প্রশ্নও তাই অংশত সংকুচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ পূর্ণাঙ্গ নয়; তাতে অবশ্য সরকারের ত্রিবিধ কর্মক্ষেত্রের মধ্যে একটা ঐক্য আছে। ঐক্য না থাকলে সরকার চালানােও কঠিন হতো।

আরো পড়ুন:  কর্তৃত্ববাদ কাকে বলে

দ্রষ্টব্য. বিকেন্দ্রীকরণ

তথ্যসূত্র:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮৩-৮৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!