প্রলেতারিয়েত অষ্টাদশ শতক পরবর্তীকালের শ্রমশক্তি বিক্রিকারী শ্রমিক শ্রেণি

প্রলেতারিয়েত (ইংরেজিতে Proletariat) হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজের অন্যতম প্রধান শ্রেণি। প্রলেতারিয়েত হচ্ছে উৎপাদনের উপায় থেকে বঞ্চিত মজুরি শ্রমিকের শ্রেণি, যারা নিজ শ্রমশক্তি বিক্রয় করে জীবনধারণ করে এবং বুর্জোয়াদের দ্বারা শোষিত হয় সাম্যবাদী ও শ্রমিক শ্রেণির পার্টির নেতৃত্বে সামাজিক প্রগতি ও শান্তির লক্ষ্যে প্রলেতারিয়েত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সকল নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের সংগ্রাম পরিচালনা করে।[১] প্রলেতারিয়েত বা প্রলেতারিয়ানদের শ্রেণিকে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস বলেছেন উনিশ শতকের শ্রমিক শ্রেণি এবং সাম্যবাদকে বলেছেন প্রলেতারিয়েতের মুক্তির পদ্ধতি সংক্রান্ত মতবাদ। তিনি তাঁর ‘কমিউনিজমের নীতিমালা’ নামক লেখায় এ সম্পর্কে ১০টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। প্রলেতারিয়েত কী প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছেন,

“প্রলেতারিয়েত হলো সমাজের সেই শ্রেণি যে শ্রেণির সদস্যরা সম্পূর্ণ জীবিকার সংস্থান করে কেবল শ্রমশক্তি বিক্রি করে, কোনো রকমের পুঁজির মুনাফা দ্বারা নয়। প্রলেতারিয়েত তাঁদের নিয়েই গঠিত যাদের সুখ-দুঃখ, যাদের জীবন-মৃত্যু, যাদের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব নির্ভর করে শ্রমশক্তির চাহিদার উপর_অর্থাৎ ব্যবসায়ের উঠতি-পড়তির পালা বদলের দ্বারা সৃষ্ট অবস্থার উপর, নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিযোগিতার খেয়ালখুশির উপর।”[২]

এঙ্গেলস উল্লেখ করেন যে প্রলেতারিয়েত সব সময় ছিলো না। গরিব জনসাধারণ এবং শ্রমিক শ্রেণিসমূহ সব সময়ই ছিলো এবং শ্রমিক শ্রেণিসমূহ প্রায়শই ছিলো গরিব। কিন্তু শ্রমিক এবং গরিব জনসাধারণ সব সময় উপরে বর্ণিত অবস্থায় ছিলো না। অর্থাৎ অন্য কথায়, সকল সময় এ-রকম অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিযোগিতা যেমন ছিলো না তেমনি প্রলেতারিয়ানেরাও সব সময় ছিলো না। এঙ্গেলস প্রলেতারিয়েতের উদ্ভব প্রসঙ্গে লিখেছেন

“উত্তর গত শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডে উদ্ভূত হয়েছিলো শিল্প বিপ্লব, তার পর থেকে সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে পৃথিবীর সমস্ত দেশে — সেই শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রলেতারিয়েতের উদ্ভব। স্টিম ইঞ্জিন, বিভিন্ন সুতা-কাটার যন্ত্র, যান্ত্রিক তাঁত এবং বহুসংখ্যক অন্যান্য কল-কব্জা উদ্ভাবনের ফলে ঘটেছিল এই শিল্প-বিপ্লব। এইসব যন্ত্রপাতি ছিল খুবই ব্যয়বহল, কাজেই সেগুলো কিনতে পারত কেবল বড় বড় পুঁজিপতিরাই, সেগুলো তদবধি বর্তমান সমগ্র উৎপাদন-প্রণালীটোকে বদলে দিল এবং তদবধি বর্তমান শ্রমিকেরা যা করত তার চেয়ে সস্তা আর সরেস পণ্য উৎপন্ন হলো যন্ত্রে ! এইভাবে এইসব যন্ত্র প্রচলনের ফলে শিল্প পুরোপুরি চলে গেল বড় বড় পুঁজিপতিদের হাতে, শ্রমিকদের সামান্য সম্পত্তি (হাতিয়ার, হাতে চালান তাঁত, ইত্যাদি) হয়ে পড়ল অকেজো, এইভাবে অচিরেই পুঁজিপতিরা হয়ে গেল সবকিছুর মালিক, শ্রমিকদের হাতে থাকল না কিছু।” … …

কাজ ক্রমেই আরও বেশি বেশি করে ভাগ-ভাগ হয়ে পড়তে থাকল বহু শ্রমিকের মধ্যে, তাতে যে-শ্রমিক আগে তৈরি করত গোটা জিনিসটা সে পয়দা করতে থাকল জিনিসটার একটা অংশ। এই শ্রমবিভাগের ফলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত এবং কাজেই অপেক্ষাকৃত সস্তায় জাতদ্রবোর যোগান সম্ভব হয়ে উঠল। এর ফলে প্রত্যেকটি শ্রমিকের কাজ খুবই সরল, অনবরত পুনরাবৃত্ত যান্ত্রিক ক্রিয়াপ্রণালিতে পরিণত হলো, তাতে কাজটা যন্ত্র করতে পারে সমানই ভালোভাবেই শুধু নয়, ঢের বেশি ভালভাবেই! এইভাবে, ঠিক সুতা-কাটা আর ধাপড়-বোনা শিল্পেরই মতো শিল্পের ঐ সমস্ত শাখা একটার পরে একটা গড়ে গেল স্টীম-শক্তি, যন্ত্রপাতি আর কারখানা প্রণালীর দখলে।[৩]

প্রলেতারিয়েতগণের নিজেদের শ্রমশক্তি ছাড়া এর বিক্রি করবার কিছু থাকে না। তাঁদের সম্পর্কে মার্কস এঙ্গেলস বলেছেন,

“যে পরিমাণে বুর্জোয়া শ্রেণি অর্থাৎ পুঁজি বেড়ে চলে ঠিক সেই অনুপাতে বিকাশ পায় প্রলেতারিয়েত অর্থাৎ আধুনিক শ্রমিক শ্রেণি, মেহনতীদের এ শ্রেণিটি বাঁচতে পারে যতক্ষণ কাজ জোটে, আর কাজ জোটে শুধু ততক্ষণ যতক্ষণ তাদের পরিশ্রমে পুঁজি বাড়তে থাকে। এই মেহনতিদের নিজেদের টুকরো টুকরো করে বেচতে হয়। বাণিজ্যের অন্য পণ্য সামগ্রীর মতোই তারা পণ্যদ্রব্যের সামিল। আর সেই হেতু নিয়তই প্রতিযোগিতার সবকিছু ঝড় ঝাপটা, বাজারের সবরকম ওঠানামার অধীন তারা।”[৪]

প্রলেতারিয়েত সম্পর্কে কার্ল মার্কস লিখেছেন, “প্রলেতারিয়েত পায়ের নিচে পড়ে থাকতে রাজি নয়। তাদের রোজকার রুটি যতখানি দরকার তার চেয়েও বেশি দরকার সাহস, আত্মবিশ্বাস, অহংকার, স্বাধীনতা।”[৫] যা তাঁদেরকে মুক্ত করতে পারে এবং সাথে সাথে মুক্ত করতে পারে গোটা মানবজাতিকেই।

আরো পড়ুন:  পুঁজিবাদী দেশগুলিতে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বর্ধমান উত্তেজনা

তথ্যসূত্র:

১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১০০।

২. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস; কমিউনিজমের নীতিমালা, অক্টোবর, ১৮৪৭।

৩. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিজমের নীতিমালা, ১৮৪৭,

৪. কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত, ১৮৪৮।  

৫. কার্ল মার্কস, ব্রাসেলসের জার্মান সংবাদপত্রে লিখিত প্রবন্ধ।

রচনাকাল জুন ৩০, ২০১৪

Leave a Comment

error: Content is protected !!