সমাজ গণতন্ত্র হচ্ছে একটি সংস্কারবাদী বিপ্লববিরোধী মতবাদ

সমাজ গণতন্ত্র (ইংরেজি: Social democracy) হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক মতবাদ যা সংস্কারবাদী এবং ধারাবাহিকতাবাদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রীতিমাফিক কাজ করে।[১] আলাদাভাবে বললে সমাজ-গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হচ্ছে এমন এক নীতির প্রশাসনপদ্ধতি যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির কাঠামোর ভেতরে একটি বৈশ্বিক কল্যাণ রাষ্ট্র এবং যৌথ দরকষাকষির বিন্যাস। এটাকে প্রায় ব্যবহার করা হয় সেই ঢঙকে নির্দেশ করার জন্য যা বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের সামাজিক মডেল এবং অর্থনৈতিক নীতিকে নির্দেশ করে।[২]   

সমাজ গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে আবির্ভূত হয় যা পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকে বিবর্তনমূলক ও শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের মাধ্যমে সম্ভব বলে মনে করে। সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সমাজ গণতান্ত্রিক মতবাদ মার্কসবাদের সাথে যুক্ত বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গিকে বর্জনের ওকালতি করে।[৩] পশ্চিমা ইউরোপে প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধোত্তর যুগের প্রথম দিকে, সমাজ গণতান্ত্রিক দলগুলি তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে স্ট্যালিনবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিরাজমান মডেলটি প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা তখন নিজেরাই নিজেদের জন্য সমাজতন্ত্রের বিকল্প পথ বা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে একটি আপোস করার পথ তৈরি করে।[৪]

এই সময়ের মধ্যে, সমাজ গণতান্ত্রিকরা ব্যক্তিগত মালিকানার প্রাধান্যকারী একটি মিশ্র অর্থনীতিকে আলিঙ্গন করে। এই মিশ্র অর্থনীতিকে সমর্থন করতে গিয়ে তারা কতিপয় কেবলমাত্র সংখ্যালঘু সরকারী মালিকানার অপরিহার্য উপযোগিসমূহ এবং জনসাধারণের সেবাসমূহকে সমর্থন করে। এর ফলস্বরূপ, সমাজ গণতন্ত্রীরা মার্কসবাদের বিপ্লবী নীতিগুলোকে পরিত্যাগ করে। তারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদান বাজার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং মজুরি শ্রম উৎখাতের বিপ্লবী নীতিকে বাদ দিয়ে  কেনসিয়ান অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার সাথে যুক্ত হয়ে যায়।[৫]  

সমাজ-গণতন্ত্র কমিউনিস্ট পার্টিকে সমাজ-বিপ্লবের পার্টি থেকে রূপান্তরিত করে এটিকে বানিয়ে ফেলে সামাজিক সংস্কারের গণতান্ত্রিক পার্টিতে; বৈপ্লবিক সাম্যবাদ থেকে বুর্জোয়া সমাজ-সংস্কারবাদে পল্টি মারার পার্টিতে। তারা কমিউনিস্ট পার্টিকে বামপন্থী পার্টিতে পরিণত করে, পার্টিতে সুবিধাবাদী মতধারার স্বাধীনতা ঢোকায়, সংস্কারের গণতান্ত্রিক পার্টিতে পরিণত করে এবং সমাজতন্ত্রের ভেতরে বুর্জোয়া ভাব-ধারনা আর বিভিন্ন বুর্জোয়া উপাদান চালু করে। সমাজ গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে গেয়ে এদুয়ার্দ বের্নস্তাইন বলেছেন,

“সমাজ গণতন্ত্রের প্রত্যাশা বা আশা করা উচিত নয় বিরাজমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আসন্ন পতন… যা সমাজ গণতন্ত্রের হওয়া উচিত, এবং আগামির দীর্ঘ সময় ধরে করা উচিত, শ্রমিক শ্রেণিকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করা, তাদেরকে গণতন্ত্রের জন্য প্রশিক্ষিত করা, এবং রাষ্ট্রের সব বা যে কোনো সংস্কারের জন্য লড়াই করা যা মূলত শ্রমিক শ্রেণির উত্থানে পরিকল্পনা করে এবং রাষ্ট্রকে অধিক গণতান্ত্রিক করে।”[৬]

আরো পড়ুন:  জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে লেনিনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে জাতিসমূহের সমতাভিত্তিক বিকাশ

সমাজ গণতন্ত্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে একটি সুবিধাবাদী মার্কসবাদবিরোধী মতবাদ। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস মারা যাবার পরে বের্নস্তাইন মার্কসের বৈপ্লবিক শিক্ষাগুলোকে বুর্জোয়া উদারনীতিবাদী ভাব অনুসারে সংশোধন করতে লেগেছিলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে সামাজিক-সংস্কারকামী ক্ষুদে বুর্জোয়া পার্টিতে পরিণত করতে চেষ্টা করেছিলেন।[৭]  

বের্নস্তাইন সমালোচনা করেছিলেন মার্কসবাদের “শত্রুভাবাপন্ন শ্রেণিসংগ্রাম” এবং উদারতাবাদের প্রতি বৈরিতার। তিনি মার্কসের মতবাদের উপর আপত্তি এনে দাবি করেন যে উদার গণতন্ত্রী এবং সমাজ গণতন্ত্রীরা একই সাধারণ দাবির ভিত্তিতে “সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র”  তৈরি করতে পারেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণির মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো ধীরে ধীরে আইনী সংস্কার ও অর্থনৈতিক পুনঃবিতরণ কর্মসূচির মাধ্যমে বিলুপ্ত হবে।[৮]

আধুনিক সমাজ গণতন্ত্র বৈষম্য, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিপীড়ন এবং দারিদ্র্য হ্রাসের লক্ষ্যে নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়।[৯]  এই উদ্দেশ্যে তারা সর্বজনীন প্রদানযোগ্য সরকারি সেবাগুলো যেমন বয়স্ক ও শিশুদের যত্ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। সমাজ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে শ্রম আন্দোলন ও ট্রেড ইউনিয়নগুলির দৃঢ় সংযোগ রয়েছে এবং কর্মীদের জন্য যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে অধিকার আদায়ের সমর্থন করে। সমাজ গণতন্ত্রীরা শ্রমিকদের এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে অংশীদারদের জন্য সহ-নিয়ন্ত্রণ [co-determination] হিসেবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনীতি বহির্ভূতভাবে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা সমর্থন করে। [১০]

সমাজ গণতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে ইউরোপে ঊনিশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের একটি রাজনৈতিক ধারা হিসেবে। গোড়ার দিকে সমাজ গণতন্ত্রীরা সবাই বিপ্লবী কর্মসূচির ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রচার এবং শ্রমিকশ্রেণির গণসংগঠন তৈরির কাজে অগ্রণী হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত সমস্ত দলই সমাজ গণতন্ত্রী নামে পরিচিত ছিল। আধুনিক অর্থে নামটির প্রচলন ঘটে ১৯০৫ খ্রি., যে সময়ে রাশিয়ান সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি বলশেভিক ও মেনশেভিক নামে দুটি স্বতন্ত্র ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। শান্তিপূর্ণ, জনপ্রিয় ও ক্রমান্বয়িক সামাজিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী মেনশেভিকরা সোশাল ডেমোক্র্যাট নামে নিজেদের পরিচয় দেন। ১৯১৭ সালের অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর লেনিনের অনুগামী সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ বলশেভিক সদস্যরা ওই দল ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক থেকেও পৃথক হয়ে গিয়ে তৃতীয় (কমিউনিস্ট) আন্তর্জাতিকে (১৯১৯-৪৩) ওই পার্টি যোগদান করে। সোশাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের বিরোধ দীর্ঘকাল চলেছিল।[১১]

আরো পড়ুন:  সরকার হলো ব্যবস্থা বা গোষ্ঠী যা সংগঠিত সম্প্রদায়, প্রায়শই একটি রাষ্ট্রকে পরিচালনা করে

আধুনিক অর্থে সমাজ গণতন্ত্রীরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, কিন্তু বিপ্লবের পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক উপায় অনুসরণের পক্ষপাতী। গণতান্ত্রিক বহুদলীয় নির্বাচনেও তাঁরা বিশ্বাস করেন। তাঁদের দৃষ্টিতে গণতন্ত্রী পার্টি জনগণের নামেই শুধু নয় জনগণের দ্বারা শাসন চালায়। স্বভাবতই সে ব্যবস্থায় বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকবে, যারা কোনও সময়ে ক্ষমতাতেও আসতে পারে। বেশির ভাগ দেশে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলি মার্কসবাদে বিশ্বাস করত। জামানিতে শাসক সোশাল ডেমোক্রেটিক দল সর্বপ্রথম মার্কসবাদ থেকে ১৯৫৯ সালে সরে আসে ।[১২]

সমাজ-গণতন্ত্রীরা প্রায়ই মার্কসবাদের নাম মুখে নিয়ে মার্কসবাদের অভ্যন্তরের বিপ্লবী সত্ত্বাকে ধ্বংস করে; পার্টির নেতৃত্বে সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েমের বিরোধিতা করে; নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলে সংসদের ভেতরে লড়াই চালানোর ওকালতি করে, কিন্তু সংসদে একবার ঢুকলে ওখান থেকে আর বেরোয় না; নির্বাচনের মাধ্যমে একবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে গণতন্ত্রকে টুঁটি চেপে মারতে চেষ্টা করে, যার ফলে সমাজ-গণতন্ত্র থেকেই ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি ঘটে।

সমাজ-গণতন্ত্রীদের ফাঁকা বিপ্লবী বুলি ও মিষ্টি কথা দ্বারা বিভ্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। সমাজগণতন্ত্রী ব্যক্তিরা মুখে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের কথা বলেন, কিন্তু নির্বাচন ও ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে অন্য কোনো ধরনের লড়াইয়ের পথে যান না। সমাজগণতন্ত্রী সান্ধ্যকালিন বিপ্লবীরা এবং অলস আমলাতন্ত্রীরা মূলত  শ্রেণিসংগ্রামকে চুলায় ঢুকিয়ে অফিসে থাকতে পছন্দ করে। এক কথায় সমাজ-গণতন্ত্রীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ এবং সমাজ-বিপ্লব বিরোধী এক প্রতিক্রিয়াশীল এবং কতিপয় ক্ষেত্রে এক সংশোধনবাদী ধারার নাম।

তথ্যসূত্র:

১. Busky, Donald F. (2000), Democratic Socialism: A Global Survey, Westport, Connecticut, USA: Greenwood Publishing Group, Inc., p. 8, “The Frankfurt Declaration of the Socialist International, which almost all social democratic parties are members of, declares the goal of the development of democratic socialism”

২. Foundations of social democracy, 2004. Friedrich-Ebert-Stiftung, p. 8, November 2009

৩. Miller, David (1998). “Social Democracy”. In Craig, Edward. Routledge Encyclopedia of Philosophy. 8. Routledge. p. 827. ISBN 978-0-415-18713-8.

৪. Jones, R. J. Barry, ed. (2001). Routledge Encyclopedia of International Political Economy. 3. London: Routledge. p. 1410. ISBN 978-0-415-14532-9.

৫. Heywood, Andrew (2012). Political Ideologies: An Introduction (5th ed.). Basingstoke, England: Palgrave Macmillan. pp. 125–128. ISBN 978-0-230-36725-8.

আরো পড়ুন:  লেনিনবাদী দৃষ্টিতে সুবিধাবাদ কী এবং কেন বর্জনীয়

৬. Bernstein, Eduard উদ্ধৃত Steger, The Quest for Evolutionary Socialism, Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-58200-1. p. 80. ইংরেজি বাক্যগুলো এইরকম: “Social democracy should neither expect nor desire the imminent collapse of the existing economic system … What social democracy should be doing, and doing for a long time to come, is organize the working class politically, train it for democracy, and fight for any and all reforms in the state which are designed to raise the working class and make the state more democratic.”

৭. টীকা, ভ. ই. লেনিন, অনুবাদ বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়; নির্বাচিত রচনাবলি ১ম খণ্ড,  (১২ খণ্ডে);  প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭৯;  পৃষ্ঠা ৩৪৩।

৮. Steger, Manfred B. (1997). The Quest for Evolutionary Socialism: Eduard Bernstein and Social Democracy. Cambridge University Press. p. 141. ISBN 978-0-521-58200-1.

৯. Hoefer, Richard (2013). “Social Welfare Policy and Politics”. In Colby, Ira C.; Dolmus, Catherine N.; Sowers, Karen M. Connecting Social Welfare Policy to Fields of Practice. Hoboken, New Jersey: John Wiley & Sons. p. 29. ISBN 978-1-118-17700-6.

১০. Meyer, Thomas; Hinchman, Lewis P. (2007). The Theory of Social Democracy. Cambridge, England: Polity Press. p. 137.  ISBN 978-0-7456-4113-3.

১১. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩১৫

১২. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!