নৈর্বক্তিক ভাববাদ বা বাস্তব ভাববাদ (ইংরেজি: Objective Idealism) ব্যক্তির মনের বাইরে একটি অতিব্যক্তিক এবং অতিপ্রাকৃতিক কোনো ভাবকে সব কিছুর মূল বলে মনে করা হয়। দর্শনে ভাববাদকে দুটি উপবিভাগে বিভক্ত করা হয়; (১) নৈর্বক্তিক ভাববাদ, (২) আত্মগত বা মন্ময় ভাববাদ। মন্ময় ভাববাদ মনের চেতনাকে অস্তিত্বের মূল বলে নির্দিষ্ট করা হয়। মন্ময় ভাববাদের প্রধান ব্যাখ্যাতা ছিলেন জর্জ বাকলে। বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বার্কলে বলেন, মনের ভাবের বাইরে কোনো বস্তুর অস্তিত্বের কথা ব্যক্তি জানতে পারে না। ব্যক্তির কাছের সকল অস্তিত্বই তার সচেতন মনের উপলব্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ। মন যা উপলব্ধি করে, ব্যক্তির কাছে শুধু তাই অস্তিত্বময়। বার্কলের মতে জগত আছে বলে মানুষ তা দেখে একথা ঠিক নয়, মানুষ দেখে বলে জগত আছে।
অবশ্য নৈর্বক্তিক ভাববাদ এবং মনময় ভাববাদ যে একেবারে পরস্পর বিরোধী তা নয়। বাস্তব ভাববাদ ব্যক্তির মনের ভাবকে অস্বীকার করে না। ব্যক্তির মনের ভাব অতিব্যক্তিক স্বাধীন ভাবের ছায়া বা প্রকাশ বলে বাস্তব ভাববাদীর অনেকে মনে করছেন। আবার মনময় ভাববাদ পাছে চূড়ান্তরূপে ব্যক্তিক মনময়তায় পর্য্যবসিত হয়, এ কারণে মনময় ভাববাদ ব্যক্তির মন নিরপেক্ষ ভগবান বা অনুরূপ কোনো সর্বময় মনের অস্তিত্ব স্বীকার করে প্রকারান্তরে বাস্তব ভাববাদকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
নৈর্বক্তিক ভাববাদের প্রকৃষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় প্রাচীনকালের দার্শনিক প্লেটোর দর্শনে এবং আধুনিক কালের জার্মান দার্শনিক হেগেলের চিন্তাধারায়। প্লেটোর ভাব কোনো ব্যক্তির মনের ভাব নয়। এ ভাব সবকিছুর উর্ধ্বে। এই ভাবের আংশিক প্রকাশ হচ্ছে ব্যক্তির মনের ভাব এবং জগতের সব বস্তু। হেগেলের দ্বান্দ্বিক ভাববাদের ব্যাখ্যায় জগতের কোনো কিছুই, সে ব্যক্তির মনের ভাব হোক কিংবা বহির্জগতের কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা ঘটনা হোক, পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। কোনো কিছুর তাৎপর্য্য বিচ্ছিন্নভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সবকিছু নিয়ে সমগ্র এবং সমগ্রের মধ্যে সবকিছু। কিন্তু এই সমগ্র ব্যক্তির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। এই সমগ্র ব্যক্তির কেবল বুদ্ধি, যুক্তি ও মন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে। এই সমগ্র কোনো বিশেষ বস্তু নয়। আবার কোনো বিশেষ বস্তু এই সমগ্রের বাইরে নয়। এই সমগ্র কোনো ব্যক্তির মনের কল্পনাও নয়। আবার ব্যক্তি মন ছাড়া এ সমগ্রের উপলব্ধি করতেও অক্ষম।
হেগেল সমগ্রের আভ্যন্তরীণ সম্পর্ককে দ্বান্দ্বিক বললেও সমগ্রকে যেহেতু তিনি বস্তু বলতেও অস্বীকার করেছেন এবং তাকে ব্যক্তিক মনের বাইরের অস্তিত্ব বলে বর্ণনা করেছেন-একারণে হেগেলের ভাববাদকে বাস্তব ভাববাদ বলে অভিহিত করা হয়। ভাববাদী দর্শনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে যে সমস্ত নতুনতর তত্ত্বের সাক্ষাত পাওয়া যায় তার মধ্যে পজিভিটিজম বা দৃষ্টসত্তাবাদ, নিওরিয়ালিজম বা নব্যবাস্তববাদ, এক্সিটেনশালিজম বা অস্তিত্ববাদ, ব্যক্তিত্ববাদ, জীবনের দর্শনবাদ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
তথ্যসূত্র:
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২০৯-২১০।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।