আকবরের শাসনামলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

আকবরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা:

আকবরের শাসনামলে প্রধান প্রশাসনিক বিভাগ ছিল রাজস্ব-সম্পর্কিত বিভাগ। এ-বিভাগের প্রধান ছিলেন ‘দিওয়ান’। রাজস্ব-আদায়কারী কর্মচারিরা বেশির ভাগই হিন্দু ছিলেন। সৈন্যবিভাগে সৈন্যদের খাদ্যবস্ত্র ইত্যাদির প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ও খাজাঞ্চি ‘মির-ই-বখশি’ ‘জায়গিরগুলির বিলিবণ্টন তত্ত্বাবধান করতেন এবং তিনিই ফৌজী কুচকাওয়াজের সময় পরিদর্শন করতেন সৈন্যদের ও তাদের সাজসরঞ্জামের। এছাড়া অন্যান্য ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেন বাহিনীগুলির সেনাধ্যক্ষরা। ধর্মীয় ব্যাপারের ভারপ্রাপ্ত বিভাগটি পরিচিত ছিল ‘সদারত’ নামে। এই বিভাগের প্রধান ‘সদর’ মুসলমানদের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা পরিচালনার জন্যে বিচারকদের নিযুক্ত করতেন এবং ‘সুয়ুরগাল’ বিতরণের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। বিভিন্ন অঞ্চলে ও জেলাগুলিতে পাশাপাশি কাজ করতেন বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষ, পরস্পরের কাজের ওপর নজর রাখতে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো লক্ষণ কোথাও প্রকাশ পেলে তা দমন করতে বাধ্য হতেন তাঁরা। কিছু-কিছু বড় মাপের অঞ্চলে স্থানীয়ভাবেও সদর’রা নিযুক্ত হতেন।

আকবরের রাজত্বে কৃষকদের অবস্থা

মোগল-সাম্রাজ্যে জনসাধারণ ছিলেন বহুবিধ উপজাতি ও জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং বহুবিচিত্র ভাষাভাষী, তাঁদের সামাজিক বিকাশের স্তরও ভিন্ন-ভিন্ন এবং বিভিন্ন ধর্মমতে ও জাতিগত পংক্তিতে বিভক্ত ছিলেন তাঁরা। জনসংখ্যার অধিকাংশই বাস করতেন তাঁদের গ্রামীণ সমাজের ছোট্ট সংকীর্ণ জগতে। কৃষকরা রাষ্ট্রকে খাজনা দিতেন ভূমি-রাজস্ব হিসেবে। এই রাজকর তথা খাজনা যাতে কৃষকরা নিয়মিতভাবে দেন তা দেখা ছিল রাষ্ট্রের স্বার্থসম্মত, তবে রাষ্ট্র কিংবা সামন্ত-ভূস্বামীরা কেউই কৃষকদের নিজস্ব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন না।

ফসলের এক-তৃতীয়াংশ ছিল রাজস্ব হিসেবে রাষ্ট্রের প্রাপ্য। রাজস্বের এই পরিমাণকে সাধারণভাবে ন্যায্য বলেই মনে করা হত, যদিও কখনও-কখনও কৃষকরা এই পরিমাণ রাজস্ব দিতেও অসমর্থ হতেন। এরকম ক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনীকে ডাকা হত রাজস্ব আদায়ে সাহায্য করার জন্যে। ইতিবৃত্তগুলিতে তথাকথিত ‘অবাধ্য দস্যু’দের গ্রামের এমন কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে কৃষকরা আকবরের সৈন্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। একবার আকবর স্বয়ং হাতির পিঠে চেপে হাতির ধাক্কায় মাটির দেয়াল ভেঙে এক গ্রামের মধ্যে ঢুকেছিলেন তাঁর পিটুনি-বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে।

জমি আবাদ করা রাষ্ট্রের প্রতি প্রজাসাধারণের কর্তব্য বলে তখন ঘোষিত হয়েছিল এবং খাজনা-আদায়কারী কর্মচারিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যাতে সকল আবাদযোগ্য জমিতে ফসল বোনা হয় সেদিকে কড়া নজর রাখতে। খাজনা আদায়ের ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রিত করার উদ্দেশ্যে আকবর এই ফরমান জারি করেন যে তাঁর রাজ্যের অংশে সকল জমি জরিপ করতে হবে দড়ি দিয়ে নয় (কারণ দড়ি ইচ্ছেমতো ঢিলে কিংবা টানটান করে মাপের হেরফের করা সম্ভব), বাঁশের খুঁটি দিয়ে।

মোগল-সাম্রাজ্যে গ্রামীণ সমাজগুলি ছিল জটিল ধরনের সব সংস্থা। যৌথ ভূস্বামী হিসেবে সমাজের নিয়ন্ত্রণাধিকার ছিল সাধারণত একেকটি গ্রামের চতুষ্পার্শ্বস্থ ছোট এক ভূখণ্ডের ওপর এবং সমাজের প্রধান বা মোড়লের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত থাকত ওই ভূখণ্ডের অন্তর্গত আবাদী জমির প্রতিটি টুকরোর ওপর খাজনা ধার্য করার ও তা আদায় করার। কিন্তু গ্রামীণ সমাজের কারিগর কারুশিল্পী ও ভূতাদের নিয়মিত খরিদ্দারেরা সাধারণত বাস করতেন একাধিক গ্রামে। ফলে, বলতে গেলে কার্যত, প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব ‘মুকরর’, অর্থাৎ খেতখামারের পাহারাদার ও জিম্মাদার থাকলেও গ্রামের কর্মকারের খরিদ্দার হতে পারত একাধিক গ্রাম ও গ্রামের স্বর্ণকারের খরিন্দার এমন কি পাঁচটি গ্রাম পর্যন্ত, ইত্যাদি। নানা ধরনের এইরকম কারিগর, যাঁরা নাকি পুরো একটি গ্রামাঞ্চলের চাহিদা মেটাতেন, তাঁদের সংখ্যা গড়পড়তা সাত থেকে বারোজনের মতো হতে বাধা ছিল না। আর এই সমস্ত কারিগরের তৈরি প্রতিটি বস্তুর জন্যে সাধারণত তাঁরা অর্থ মূল্যে দাম পেতেন না, তাঁদের প্রাপ্য দাম মেটানো হোত ফসলের একটা অংশ দিয়ে কিংবা নিষ্কর একটুকরো জমির বিনিময়ে। প্রসঙ্গত এটাও লক্ষণীয় যে কোনো-একটি গ্রামীণ সমাজের সদস্যের পক্ষে কাছাকাছির মধ্যে অপর কোনো বসতির এলাকায় বাড়তি আরেক খণ্ড জমি সংগ্রহ করার পথে কোনো বাধা ছিল না (যদিও এই দ্বিতীয় বসতিতে তিনি সববিষয়ে পূর্ণ অধিকার ভোগ করতে পারতেন না, তবু)। এর ফলে কোনো-একটি গ্রামীণ সমাজের প্রভাবাধীনে ঠিক কতখানি ভূখণ্ড থাকত তা হিসাব করা বর্তমানে বেশ দুরূহ। তবে এটা ঠিক যে বেশ কয়েকখানি গ্রামের বাসিন্দা কৃষকরা হাটে বা বাজারে না-গিয়েও কারিগরদের তৈরি তাঁদের প্রযোজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে পারতেন।

গ্রামীণ সমাজের মোড়ল ও পুথি-লেখক যেমন একদিকে ছিলেন সমাজের দুই প্রধান প্রতিনিধি তেমনই অপরদিকে তাঁরা ছিলেন রাজকর্মচারিও। মোড়ল তাঁর পরিচালনাধীন গ্রাম থেকে দেয় রাজস্বের পুরো অংশ আদায় করে দিতে পারলে তাঁর সমাজের স্বত্বাধীন সকল আবাদী জমির চল্লিশ ভাগের এক ভাগ জমি নিজস্ব হিসেবে পাওয়ার অধিকারী ছিলেন। এই জমি হত নিষ্কর।

আকবর তাঁর সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলিতে দুব্যসামগ্রীতে খাজনার পরিবর্তে অর্থমূল্যে খাজনা দেয়ার রীতি প্রবর্তন করায় কৃষকদের পক্ষে তা মস্ত এক বোঝার সামিল হয়ে দাঁড়ায়। এই অর্থ সংগ্রহের জন্যে ভারতীয় কৃষক অতঃপর বাধ্য হলেন নিজে থেকেই কিংবা গ্রামীণ সমাজের মোড়লের সাহায্যে তাঁর খেতের ফসল হাটে বিক্রি করতে এবং এর ফলে তিনি অত্যন্ত বেশিরকম নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন ব্যবসায়ী ও কুসীদজীবী মহাজনদের ওপর। যদিও আকবর কৃষকদের ওপর ধার্য করা বেশকিছু ধরনের ছোটখাট খাজনা মকুব করে দিয়েছিলেন, তবু সামন্ত-ভূস্বামীরা যথারীতি সে-সমস্ত আদায় করে নিতেন কৃষকদের কাছ থেকে এবং নিজেদের প্রয়োজনে তা আত্মসাৎ করতেন।

খাজনা দেয়া ছাড়াও কৃষকরা কখনও-কখনও বাধ্য হতেন বিনা মজুরিতে রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করতে। এগুলি ছিল প্রধানত দুর্গ, শহর, ইত্যাদি নির্মাণের কাজ। বিনা পারিশ্রমিকের এই শ্রমকে বলা হত ‘বেগার খাটা’। এই শ্রম বিশেষ করে কঠিন হয়ে দাঁড়াত যখন গ্রামগুলির কাছাকাছি কোনো দুগে নির্মিত হতো, কারণ আকবর তখন সরাসরি হুকুম জারি করতেন যে আশপাশের সকল গ্রামের মানুষকে এই নির্মাণকার্যে হাত লাগাতে হবে।

আরো পড়ুন:  খিলাফত আন্দোলন ছিলো ভারতে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন

আকবরের রাজত্বকালীন জমিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত মালিকানা

সামন্ততান্ত্রিক ভারতে প্রতিটি বড় আকারের রাজ্যই ভূ-সম্পত্তিতে তাদের অধিকার কায়েম করতে সচেষ্ট হতো। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমিজমার অস্তিত্ব রাজকোষ পূর্ণ করার জন্যে খাজনা আদায় সম্ভব করে তুলত এবং এর ফলে রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হতো রাজসেবার বিনিময়ে সামন্ত-ভূস্বামীদের মধ্যে শর্তাধীনে জমি বিলি করা। এই সমস্ত জমির স্বত্বভোগীরা আবার বাধ্য হতেন ছোট-বড় সৈন্যবাহিনী পুষতে আর সেগুলি হতো রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর অংশ; আর রাষ্ট্রের অধীনে শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকলে তবেই সম্ভব হতো অভ্যন্তরীণ বিদোহ, ইত্যাদি দমন করা, প্রতিবেশী রাজ্যগুলির আক্রমণ থেকে রাজ্য রক্ষা করা এবং জয় করা নিত্য নতুন ভূখণ্ড। অবশ্য নতুন-বনে-যাওয়া-ভূস্বামীরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর রাষ্ট্রের কাছ থেকে শর্তাধীনে-পাওয়া জমিজমাকে তাঁদের ব্যক্তিগত ভূ-সম্পত্তিতে পরিণত করার চেষ্টাও করতেন। এইভাবে জমিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েমের লড়াই চলছিল ভারতের গোটা সামন্ততান্ত্রিক যুগ ধরেই।

মোগল-সাম্রাজ্যের দু’ধরনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমি ছিল যথা, ‘খালিসা’ ও ‘জায়গির। সকল বিজিত ভূখণ্ড রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমি-তহবিল বা খালিসা’র অংশভুক্ত হতো। এই জমি থেকেই সম্রাট জায়গির’ ভূ-সম্পত্তি বিলি-বাটোয়ারা করতেন এবং এ-থেকেই তিনি জমি দান করতেন ধর্মীয় উপাসনা ইত্যাদির পরিচালনার ভারপ্রাপ্তদের এবং ধর্মগুরুদের। এই ‘খালিসা’ জমির পরিমাণের অনবরত হেরফের ঘটতে থাকায় এ-জমির মোট পরিমাণ হিসাব করা অসম্ভব ছিল। ‘খালিস’ জমি ছিল পুরোপরি রাষ্ট্রের সম্পত্তি।  

‘জায়গির’ ভূ-সম্পত্তি বলতে বোঝাত শর্তাধীনে বিলি করা জমি। এইসব ভূ-সম্পত্তির স্বত্বভোগীরা বাধ্য থাকতেন স্বত্বাধীন জমির পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বড় বা ছোট আকারের সেনাবাহিনী পোষণ করতে। এই সেনাবাহিনীগুলি হতো সম্রাটের সেনাবাহিনীর প্রধান অংশ। ‘জায়গির’ হিসেবে বিলি-করা জমিও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হতো। ‘জায়গির’এর ওপর দেয় ভূমি-রাজস্বের পরিমাণ ও তার ধরন নির্ধারণ করতেন ‘জায়গিরদার’ নয়, রাষ্ট্র স্বয়ং এবং রাষ্ট্রের তরফ থেকেই ঠিক করে দেয়া হতো কীভাবে এই রাজস্ব আদায় করা হবে। নিয়ম হিসেবেই ‘জায়গিরদার’এর জমির স্বত্ব তাঁর পরিবারে বা বংশানুক্রমে অর্শাত না, বরং তাঁর মৃত্যুর পর তা ফের রাষ্ট্রের সম্পত্তিতে পরিণত হতো। এমন কি কখনও কখনও ‘জায়গিরদার’এর কাছ থেকে তাঁর তালুক রাষ্ট্রের তরফ থেকে নিয়ে নেয়া হতো ও তার পরিবর্তে দেয়া হতো অপর কোনো তালুক। পরিবর্ত হিসেবে দেয়া এই দ্বিতীয় তালুকটি দেশের সম্পূর্ণ ভিন্ন অপর এক অঞ্চলে হওয়াও বিচিত্র ছিল না। আকবরের রাজত্বকালে সামন্ত-ভূস্বামীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করার জন্যে এধরনের তালুকের পরিবর্তন রীতিমতো ঘনঘনই ঘটত। এর অর্থ, ‘জায়গিরদার’র সে সময়ে সাধারণত একই জমির মালিকানা একসঙ্গে বছর-দশেকের বেশি ভোগ করতে পারতেন না।

‘জায়গির’ ভূ-সম্পত্তির মালিকানার সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক ব্যক্তিগত মালিকানার ধরনধারণের অবশ্য বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায় বড়-বড় ‘জায়গিরদার’রা জমি থেকে তাঁদের আদায়ীকৃত রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশের মতো মাত্র ব্যয় করতেন তাদের সেনাবাহিনীগুলির ভরণপোষণের জন্যে, আর অপেক্ষাকৃত ছোট ‘জায়গির’ পেতেন যাঁরা এ-কাজে ব্যয় করতেন আদায়ীকৃত রাজস্বের অর্ধেকেরও কম। আকবরের রাজত্বকালের অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই, যে-সমস্ত হিন্দু রাজা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতেন তাঁদের আগেকার ভূ-সম্পত্তি সাধারণত ‘জায়গির’ হিসেবে তাঁদেরই দান করা হতো আর এই সমস্ত জমি উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগদখল করা চলত। সপ্তদশ শতক নাগাদ অবশ্য পাকাপোক্তভাবে শিকড় গেড়েছিল ‘বংশগত জায়গির’ কথাটি।

সাধারণভাবে ‘জায়গির’গুলি হতো ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বিঘা কি তার চেয়েও বেশি জমি নিয়ে গঠিত প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড ভূ-সম্পত্তি। আকবরের রাজত্বকালে ‘জায়গির’দাররা তাঁদের স্বত্বস্বামিত্বের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। ষোড়শ শতকের সপ্তম দশকের শেষ ও অষ্টম দশকের গোড়ার দিকে আকবর যখন চেষ্টা করলেন ‘জায়গির’-প্রথার বিলোপ ঘটিয়ে পরিবর্তে অর্থমূলে বেতনদান ব্যবস্থা প্রবর্তনের, তখন পাঞ্জাবের ‘জায়গিরদাররা খেপে উঠে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। পাঞ্জাবে মোগল-বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ শাহবাজ খাঁ তখন সম্রাটের নামে ওই অঞ্চলের সকল ‘খালিসা’ ভূ-সম্পত্তি ‘জায়গির’ হিসেবে বিলি করতে বাধ্য হলেন। ‘পাতশাহ’ বা চলতি কথায় বাদশাহকে লিখলেন তিনি: “এইভাবে যদি আমি যোদ্ধৃবৃন্দের অশান্ত হৃদয়কে শান্ত না করতাম তাহলে তাঁরা সরাসরি বিদ্রোহ করে বসতেন। এখন গোটা রাজ্য ও সেনাবাহিনী জাঁহাপনার হকুম-বরদারি করবে’। আকবরের রাজত্বকালে মোগল-সাম্রাজ্য সবেমাত্র পাকাপোক্তভাবে গঠিত হয়ে উঠছিল, তাই তখন ‘জায়গিরদার’দের মোট সংখ্যা ছিল মাত্র দু’হাজারের মতো (এই হিসাব বড় এবং ছোট ‘জায়গিরদার’দের ধরেই)।

মোগল-সাম্রাজ্যের আমলে ব্যক্তিগত জমির মালিকরাও ছিলেন, যাঁদের বলা হোত ‘জমিদার’। আকবরের শাসনামলে যে-সমস্ত শক্তিশালী ছোট রাজন্যদের তিনি পদানত করেছিলেন তাঁরা মোগল-সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার পর ও আকবরকে কর বা সেলামি দিতে রাজি হওয়ায় এই ‘জমিদার’ খেতাব পেয়েছিলেন। এই সেলামির পরিমাণ নির্ভর করত রাজন্যরা বশ্যতাস্বীকার করার সময় শক্তির সত্যিকার ভারসাম্য কী রকম হতো তার ওপর। মোগল-সাম্রাজ্যের রাজস্ববিভাগ ‘জমিদার’ ও তাঁর প্রজা বা কৃষকদের মধ্যেকার সম্পর্কের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত না। বলা বাহুল্য, এই জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে ভূমি-রাজস্ব বলতে যা বোঝায় তা আদায় করতেন না, তাঁরা আদায় করতেন জমির ভাড়া বা খাজনা। এই খাজনার পরিমাণ ও তা আদায়ের পদ্ধতি নির্ধারিত হতো স্থানীয় রীতি-প্রথা অনুযায়ী। রাজপুত-অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে, ওড়িষ্যায়, বিহারে ও অন্য কোনো কোনো জায়গায় কিছু কিছু জমিদার’ তাঁদের ভূ-সম্পত্তিগুলি পরিচালনা করতেন খাস মৌজায় বেগার খাটানোর অনুরূপ পদ্ধতিতে, কিন্তু মোগল-সাম্রাজ্যের আমলে ভারতে প্রধানত কৃষক-শোষণের এই পদ্ধতি ক্রমে-ক্রমে লোপ পাচ্ছিল। ‘জমিদারদের ভূ-সম্পত্তিগুলি সরকারিভাবেই বংশানুক্রমিক বলে ঘোষিত ছিল, যদিও প্রতিবার এই সম্পত্তির নতুন উত্তরাধিকারীকে মালিকানাস্বত্ব ভোগ করার আগে তাঁর উর্ধ্বতন শাসকের কাছ থেকে বিশেষ সনদ সংগ্রহ করতে হতো। তবে ওই জমিতে যদি একাধিক দাবিদার থাকতেন তাহলেই এই সনদ একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াত। এছাড়া ছোট-ছোট ভূস্বামীদেরও অনেক সময় বলা হতো ‘জমিদার’, তবে ইতিবৃতগুলিতে উল্লেখ করা হয়েছে একমাত্র জমিদার রাজন্যদেরই।

আরো পড়ুন:  খাকসার ছিলো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ ও প্রাণীর সেবাকারী আন্দোলন

মোগল সাম্রাজ্যে ‘সুয়ুরগাল’-তালুকগুলিকেও ‘মুলক’, ‘ওয়াকফ’ বা ‘ইনাম’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালুকগুলি ছিল সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভূ-সম্পত্তি। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই ‘সুয়ুরগাল’-তালুকগুলি দান করা হতো সুফী শেখ ও মুসলিম ধর্মগুরুদের এবং সামান্য দু-চারটে ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষভাবে অন্যান্যদের। আকবরের রাজত্বকালে তাঁর ধমীয় সহনশীলতার নীতি অনুসরণের ফলে কিছু-কিছু ‘সুয়ুরগাল’-জমি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী পুরোহিতদেরও দেয়া হয়। সাধারণত সুয়ুরগাল’-জমিগুলি ছিল ছোট আকারের ও বংশানুক্রমিক; জমির মালিকদেরও বিশেষ কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না, একমাত্র সম্রাটের মঙ্গলকামনায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানানো ছাড়া। এই ‘সুয়ুরগাল’-তালুকগুলির মোট আয়তন রাষ্ট্রীয় ভূ-সম্পত্তির তিন শতাংশের মতো ছিল। তবে ‘জমিদার’দের ভূ-সম্পত্তির মধ্যে মন্দিরগুলির জন্যে প্রদত্ত বা দেবত্র জমির পরিমাণ কতখানি ছিল তা অনুমান করা অসম্ভব।

কারিগরি শিল্প

গ্রামীণ সমাজে কারুশিল্পী প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবহার-দ্রব্য তৈরি করলে তার বিনিময়ে সমাজের কাছ থেকে তিনি পেতেন ফসলের একটা ভাগ কিংবা নিষ্কর ছোট্ট একটুকরো জমি। তবে কারুশিল্পীদের একটি বড় অংশই তখন বাস করতেন শহরে কিংবা কারুশিল্পীদের বসতিতে এবং তাঁরা সামন্ত-ভূস্বামীদের ফরমায়েশ অনুযায়ী তাঁদের জন্যে নানা ব্যবহার সামগ্রী নির্মাণ করতেন আর নয়তো জিনিপত্র তৈরি করে হাটে বা বাজারে বিক্রি করতেন।

ওই সময়ে ভারতে সবচেয়ে উন্নত কুটিরশিল্প ছিল বস্ত্রবয়নের। সুতী ও রেশমের বস্ত্র, এমব্রয়ডারিকরা ও ছাপা কাপড়, স্বাভাবিক ও রংকরা কাপড় এ-সবই উৎপন্ন হতো বিপুল পরিমাণে। সম্রাট আকবরের পোশাক-পরিচ্ছদের ভাণ্ডারের যে-তালিকা পাওয়া যায় তাতে প্রায় একশো বিভিন্ন রকমের ভারতীয় বস্ত্রের উল্লেখ আছে।

আগ্রায় তখন নানা ধরনের সংশ্লিষ্ট পেশায় বিশেষজ্ঞ গৃহ-নির্মাণ-কমীদের বিপুল একটি সংখ্যার বাস ছিল, গুজরাটে বাস করতেন মর্মর-পাথরের কাজে দক্ষ শিল্পীরা এবং বাংলায় দক্ষ জাহাজ নির্মাতারা। এছাড়া অন্যান্য ধরনের কারিগরি পেশায়ও দক্ষ ছিলেন ভারতের মানুষ: লোহ ও অলৌহ নানা ধাতু তোলা হতো খনি থেকে তোলা হতো লবণ ও শোরা, গৃহ ইত্যাদি নির্মাণের জন্যে খনি থেকে পাথর কাটা হতো, তৈরি হতো কাগজ ও মণি মুক্তাখচিত অলঙ্কার, উদ্ভিজ্জ তেল উৎপন্ন হতো ও তৈরি হতো নানা ধরনের মিষ্টান্ন, ইত্যাদি। ভারতীয় কারুশিল্পীদের হাতের কাজে শিল্পরুচিবোধ ও সক্ষম কারিগরির জন্যে এর বহু, আগে থেকেই দেশে-বিদেশে তা সমাদৃত হয়ে আসছিল। তবে ভারতীয় কার শিল্পীরা কাজ করতেন খুব ধীর গতিতে, কারণ তাঁরা কাজ করতেন নিতান্ত শাদাসিধে যন্ত্রপাতির সাহায্যে আর সেগুলির বেশির ভাগই ওই শিল্পীরা নিজেরাই বানিয়ে নিতেন। আবার ওই একই সঙ্গে এটাও জান ব্যাপার যে তাঁতের দণ্ডও (পাকখোলা পড়েনের সততাকে সমান ফাঁক রেখে বোনার কাজে তাঁতযন্ত্রে ব্যবহৃত সবচেয়ে জটিল একটি অংশ। তখন বিক্রির জন্যে তৈরি করা হতো। এ-থেকেই বোঝা যায় ভারতে কারিগরি শিল্প তখন কোনো স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিল।

কারুশিল্পীদের জাতিগুলি তখন নিভরশীল ছিলেন সামন্ততান্ত্রিক কতৃপক্ষের ওপর এবং এইসব কতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা জাতিগুলির প্রধানদের (মকম’দের) মনোনীত করতেন আর নিযুক্ত করতেন তাঁদের (দালালদের) যাঁরা এই হাতের কাজগুলি বিক্রি করতেন বাজারে। যে-সমস্ত কারুশিল্পী নিযুক্ত হতেন রাষ্ট্রীয় কর্মশালাগুলিতে, তাঁরা হয়ে পড়তেন আরও বেশি নির্ভরশীল। তাঁদের তৈরি করতে হতো সেনাবাহিনীর জন্যে অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম এবং সম্রাটের ব্যবহারযোগ্য নানা দ্রব্যসামগ্রী। এইসব দ্রব্যসামগ্রীর কিছু অংশ সম্রাট বিলি করতেন তাঁর অনুগহীত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে।

আগে থেকে টাকা দাদন দেয়া ও তারপর পাইকারি হারে উৎপন্ন দ্রব্যাদি কিনে নেয়ার প্রথা ছিল কারুশিল্পীদের শোষণ করার পক্ষে ব্যবসায়ী বণিকদের সবচেয়ে ব্যাপক প্রচলিত পদ্ধতি। বণিকরা আগাম টাকা দাদন দিতেন যাতে কারুশিল্পীরা খেতে-পরতে ও দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের উপযোগী কাঁচা মাল কিনতে পারেন। এর ফলে উৎপাদনকারী কারিগর তাঁর পৃষ্ঠোপোষক সেই বিশেষ বণিককে তাঁর উৎপন্ন দ্রব্যাদি দিতে বাধ্য হতেন এবং তা তাঁকে দিতে হতো এমন একটা মুল্যে যা হতো প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে (অর্থাৎ ওই কারিগর নিজে এই জিনিসগুলি বাজারে বিক্রি করলে যে-দাম পেতেন তার চেয়ে) কম। ভারতের পশ্চিম উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে প্রধান-প্রধান ধরনের কারিগরি দ্রব্যসামগ্রী ও সেগুলি-সম্পর্কিত বাণিজ্য ছিল রাজকরের অধীন। এই কর ধার্য করার অধিকার আবার পেতেন নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কয়েকজন পত্তনদার। এই মর্ধ্যবতী পত্তনদারদের একচেটিয়া অধিকার থাকত বিশেষ একেকটি ধরনের পণ্যসামগ্রী উৎপাদনের বা উৎপাদন-তদারকির (এইসব পণ্যের মধ্যে থাকত সুতীবস্ত্র, পান, আছাঁটা চাল, হাতির দাঁতের দ্রব্যসম্ভার, ইত্যাদি)। যতদূর মনে হয়, উপরোক্ত এই সমস্ত ধরনের পণ্যদ্রব্য কর-পত্তনদারের লিখিত অনুমতি ব্যতীত অপর কেউ বিক্রি করতে পারতেন না। সাধারণত এই পত্তনদাররা হতেন ধনী ভারতীয় বণিক কিংবা বিশেষ ধরনের কারিগরি উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত জাতির কারুশিল্পীদের প্রধান বা মুকন্দম।

আকবরের রাজত্বকালীন ব্যবসা-বাণিজ্য ও কুসীদজীবিকা

আকবরের শাসনামলে গুজরাট এবং বাংলা জয় করার ফলে সমুদ্র বন্দরগুলির ওপর আধিপত্য পেল মোগল-সাম্রাজ্য, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হলো পর্তুগিজদের। এমন কি যখন হজযাত্রীরা সমুদ্রপথে মক্কায় যেতে চাইতেন তখনও পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুমতিপত্র নেয়ার প্রয়োজন পড়ত। গুজরাটের দুটি সুরক্ষিত দুর্গ সমন্বিত বন্দর দমন ও দিউ থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করার ব্যাপারে মোগলদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। বঙ্গদেশেও সপ্তগ্রাম (সাতগাঁ) ও হুগলির বন্দরটিতে পর্তুগিজদের আধিপত্য মেনে নিতে হয়েছিল মোগলদের। মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর ছিল গুজরাটের সরোটে। তখন ক্যাম্বে-বন্দরের স্থান গ্রহণ করেছিল সুরাট এবং ক্যাম্বে পরিণত হয়েছিল তার পূর্ব-গৌরবের ছায়া শরীরে, কারণ এই শেষোক্ত বন্দরের প্রবেশপথটি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ক্যম্বে-উপসাগরের উভয় তীর বরাবর অনেকগুলি গিজ দুর্গের অবস্থানের দরুন।

আরো পড়ুন:  মোগল সাম্রাজ্য দক্ষিণ এশিয়ার সামন্তবাদী জনবিরোধী প্রাচীন সাম্রাজ্য

মোগলদের বেশকিছু, বাণিজ্য-জাহাজ ছিল, কিন্তু কোনো নিজস্ব নৌবহর ছিল না। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে ভারতীয় বণিকদের ব্যবসায়গত অভিজ্ঞতা ও বাইরের বহু দেশের সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘকালের বাণিজ্য-সম্পর্ককে নিজেদের কাজে লাগাবার মানসে পর্তুগিজরা সেই ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ভারতীয় বণিকদের নিজেদের ব্যবসায়ের অংশীদার হিসেবে নিয়োগ করে আসছিলেন। এর অর্থ, সমুদ্রপথে ভারতীয় বণিকদের ব্যবসায়গত ক্রিয়াকলাপ ইতিমধ্যে একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি, তবে তা বহুপরিমাণে-যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। গুজরাট আগের মতোই পারস্য-উপসাগরের দেশসমূহ, আফ্রিকা ও আরবের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছিল, ওদিকে বাঙালিরা সমুদ্রপথে বাণিজ্য করছিলেন প্রধানত প্রাচ্যের পেগু ও মক্কা-প্রণালীর দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে বাঙালির সিংহল এবং মালাবার ও করমণ্ডলের সমুদ্র তীরবর্তী বন্দরগুলির সঙ্গেও বাণিজ্যিক লেনদেন রাখছিলেন। মোগল-সাম্রাজ্য বাণিজ্য-শুল্ক আদায়ের দৌলতে এই সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে লাভবান হচ্ছিল আর সেকারণে ইউরোপীয় বণিকদের ভারতে অনুপ্রবেশ-বিষয়ে গ্রহণ করেছিল এক অনিশ্চিত, দ্ব্যর্থব্যঞ্জক মনোভাব। একদিকে তা বিদেশীদের প্রভাব সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করছিল যেমন, তেমনই অপরদিকে তাদের বাণিজ্য-সংক্রান্ত নানা সুযোগ-সুবিধাও দিয়ে চলছিল।

ভারতীয় তাঁতবস্ত্র তখন গোটা প্রাচী পৃথিবীতে অত্যন্ত সমাদর পেত এবং ভারত মহাসাগরীয় ও দক্ষিণ সমুদ্রগুলির উপকূলবর্তী সকল দেশের কাছেই তা ছিল এক সর্বগ্রাহ্য পণ্য। অন্যান্য দেশ থেকে বণিকরা ভারতে আসতেন এই সমস্তু তাঁতবস্ত্র ও নানা ধরনের মশলা কিনতে, ভারতের দোরগোড়ায়’ সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন তাঁরা বিদেশী নানা পণ্য। ভারতীয় বণিকদের অধিকাংশই নিযুক্ত ছিলেন তখন দেশের অভ্যন্তরীণ নানা হাট-বাজার থেকে দেশে-উৎপন্ন নানা পণ্যসামগ্রী পাইকারি হারে কিনতে আর তারপর সে-সমস্ত চালান দিতে ভারতীয় বন্দরগুলিতে। আবার বিদেশী পণ্যসামগ্রী বন্দরগুলি থেকে ভারতীয় রাজাবাদশাদের দরবারগুলিতে চালান দেয়ার কাজও করতেন তাঁরা। যে সমস্ত ভারতীয় বণিক সমুদ্রপথে বিদেশে যেতেন তাঁরা সেই সমস্ত বসতিস্থাপনকারী ভারতীয়দের সঙ্গে তাঁদের জাতিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে যোগাযোগ রাখতেন। এই সমস্ত বণিকজাতিগুলি বলতে গেলে একেকটি বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানের মতোই কাজ করত । বাণিজ্যের ব্যাপারে তারা নিজ-নিজ জাতির মধ্যে নানা ধরনের সহযোগিতা ও সাহায্য যোগাত, ঋণ দিত, ইত্যাদি। যেমন, উদাহরণস্বরপ, গুজরাটে সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়ী জাতি ছিল বোহরা ও খাজা জাতি দুটি, তারা ছিল শিয়া-সম্প্রদায়ের মুসলিমদের ইসমাইলী-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

আকবরের রৌপ্য মুদ্রা

ভারতীয় বণিকদের সমুদ্রপথে বাণিজ্য করার ব্যাপারে পর্তুগিজরা বাধার সৃষ্টি করায় পারস্যের সঙ্গে উটের ক্যারাভানের পিঠে পণ্যদ্রব্য চাপিয়ে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। এই ক্যারাভান-পথগুলি তখন দেশের মধ্যেই বিস্তৃত ছিল বাংলা থেকে লাহোর ও গুজরাট থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই পথগুলি সহায়ক হয়েছিল।  অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছিল দু’ধরনের সম্প্রদায়ের হাতে। একদিকে ছিলেন প্রতিপত্তিশালী ধনী বণিক-সম্প্রদায়, যাঁরা নদীপথে ও ক্যারাভানের পথে বাণিজ্যের খরচ-খরচা যোগাতেন, আর ছিলেন গ্রাম থেকে গ্রামে ফেরি-করে-বেড়ানো ছোট ছোট ফেরিওয়ালারা। গ্রামগুলিতে বাজার বা হাট বসত নিয়মিত। এই সমস্ত হাট থেকে কৃষকরা প্রধানত কিনতেন লবণ কিংবা নারকেল, লোহার ডাণ্ডা ও প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য। সেনাবাহিনীকে খাদ্যের সরবরাহ যোগাত বিশেষ একধরনের উপজাতি তথা জাতি, যাদের বলা হতো “বিরিঞ্জারা (বাবঞ্জারা)। সৈন্যদলের পিছু-পিছু, এই ‘বঞ্জারা’রা যেতেন তাঁদের ভারবাহী জন্তু বলদ ও উটের সারির পিঠে চাল, লবণ, ইতাদি চাপিয়ে। সারা দক্ষিণ-ভারত জুড়েও এই ‘বঞ্জারা’দের দেখতে পাওয়া যেত।

মোগল-সাম্রাজ্যের আমলে সমুদ্রোপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে যত বেশি সংখ্যায় ধনী বণিকরা বাস করতেন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রাঞ্চলে তাঁদের সংখ্যা মোটেই তত বেশি ছিল না। তবে ওই কেন্দ্রাঞ্চলে কুসীদজীবীদের মহাজনী কারবারের ছিল খুব বাড়বাড়ন্ত। এই কুসীদজীবীরা পদস্থ সামরিক কর্মচারি, দরবারের ওমরাহ ও কৃষককুল-নির্বিশেষে সবাইকে টাকা ধার দিতেন, বিশেষ করে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রাঞ্চলে টাকায় খাজনা দেয়ার প্রথা কড়াকড়িভাবে চালু থাকায় সকলের পক্ষেই এই ঋণগ্রহণের প্রয়োজন পড়ত। আকবরের রাজত্বকালে কুসীদজীবীরা টাকা ধার দিতেন দৈনিক ২৫ শতাংশ সুদের হারে (অর্থাৎ বাৎসরিক ৯০০ শতাংশ সুদে)। এতে বোঝা যায় গ্রামগুলিতে টাকা-লেনদেনের সম্পর্ক কতখানি দুর্বল ও অনুন্নত ছিল।

ভারতে পণ্য-বনাম-টাকার সম্পর্কের যথেষ্ট বিকাশ ঘটলেও দেশে সকল ধরনের সত্যিকার ক্ষমতা পুঞ্জীভূত ছিল সামন্ততান্ত্রিক ভূস্বামীদের হাতে।

বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলগুলির—যথা, বণিক ও কুসীদজীবী-সম্প্রদায়গুলির (কারুশিল্পী ও কারিগরদের কথা তো বাদই দিলাম)- দেশের রাজনৈতিক জীবনে সত্যিকার কোনো ভূমিকা ছিল না, তবে এদের স্বার্থ হয়তো কিছু পরিমাণে রক্ষা করার চেষ্টা হতো এইমাত্র। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, বাণিজ্যের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টায় আকবর স্বয়ং কিছু-কিছু ব্যবস্থা নেন; যথা, শহরের তোরণদ্বারে ও নদীর খেয়া ঘাটগুলিতে মাথাপিছু, শুল্কের হার হ্রাস করে ১৫ শতাংশ করা হয় এবং বিপুল মোগল-সাম্রাজ্যের গোটা এলাকা জুড়ে প্রবর্তন করা হয় সাধারণ মাপজোকের ও মুদ্রার ইউনিটের।

তথ্যসূত্র:

১. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা, ৩১৭-৩২৭।  

Leave a Comment

error: Content is protected !!