সমাজ হচ্ছে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের উৎপাদন

মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব

মার্কসবাদকে কেন্দ্র করে মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব বিকশিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে এখন পর্যন্ত বহু মার্কসীয় তাত্ত্বিক মার্কসবাদকে একটি স্বতন্ত্র সমাজতাত্ত্বিক ধারা বলে আখ্যায়িত করেছেন। মার্কস তাঁর জার্মান ভাবাদর্শ গ্রন্থে উৎপাদনের পদ্ধতি বা ধরন (ইংরেজি Mode of Production) এবং ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস গ্রন্থে ‘the creation of man by human labour’ তত্ত্বের মধ্য দিয়ে সমাজ বিকাশের বিকল্প রূপরেখা উপস্থিত করেছেন। পরবর্তীতে সমাজতত্ত্বের প্রায় সকল পথিকৃৎ সমাজতত্ত্বে মার্কসের অবদানকে স্বীকার করেছেন। বস্তুত মার্কসই প্রথম তাত্ত্বিক যিনি সর্বপ্রথম সমাজের ব্যাপক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দান করেন। মার্কসীয় সমাজতত্ত্বের মূল অবদানগুলো হচ্ছে সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিক রূপরেখা, সমাজ কাঠামোর ধারণা, সমাজ কাঠামোর উপাদান, সমাজের দ্বান্দ্বিক বিকাশ, সমাজব্যবস্থা, শ্রেণি, সামাজিক স্তরবিন্যাস, বিচ্ছিন্নতাবোধ, বিপ্লব, বিকাশ ও প্রগতি, মতাদর্শ ও সংস্কৃতি এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের রূপরেখা সম্পর্কে।[১] আমরা আগের অধ্যায়গুলোতে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এখানে আরো কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো।

সমাজ কী

প্রতিটি মানুষ অবশ্যই নরবর্গের এক একটি একক। ঠিক যেমন কোষ হলও প্রাণীদেহের একটি একক। কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোষ প্রাণ হলেও প্রাণী নয়। সমাজ বিচ্ছিন্ন একক মানুষও প্রকৃত অর্থে, মানুষ নয়, হোমো সেপিয়েন্সের একক। মানবীয় গুণসম্পন্ন মানুষ হোমো সেপিয়েন্সের একক নয়, সে সমাজের সৃষ্টি।

সুদূর অতীতে মানুষ ব্যক্তি ও সমাজে বিভক্ত হয় নি। উভয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্বও ছিলো না। মানুষ প্রাকৃতিক বিশ্বের অংশ। উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন হলো প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পর্কের ফল। এই অর্থে সমাজ কোনো সার্বভৌম গঠন নয়। মার্কসীয় ধারনায় সমাজতত্ত্ব, সামজবিজ্ঞান কোনো পৃথক অর্থ বহন করে না। সবটাই রাজনৈতিক অর্থনীতি। সমাজ অনেকগুলি উৎপাদন সম্পর্কের সমষ্টিগত প্রকাশ। উৎপাদন ক্ষমতার উন্নতির স্তরই সমাজকে চিহ্নিত করে।

ব্যাপক অর্থে সমাজ হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে উদ্ভূত মানুষের যৌথ ক্রিয়াকলাপের আকারগুলির সমষ্টি এবং সংকীর্ণ অর্থে সামাজিক ব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ধরন এবং সামাজিক সম্পর্কসমূহের সুনির্দিষ্ট আকার। মার্কসবাদীরা বলেন সমাজবিকাশের প্রতিটি স্তর উৎপাদনের পদ্ধতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। সেই হিসেবে সমাজের উদাহরণ হচ্ছে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ ইত্যাদি।[২] কার্ল মার্কস লিখেছেন,

“সমাজ কী? এটির রূপ যাই হোক, মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের উৎপাদনই সমাজ।”[৩]

সমাজপ্রগতির সাথে অর্থনীতির জটিল সর্ম্পক মার্কসবাদের প্রধান অংশ। সামাজিক ইতিহাসের ব্যাখ্যায় মার্কস দেখিয়েছেন, যে কোনো ঐতিহাসিক যুগ সমকালীন পণ্য-উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উৎপাদন ব্যবস্থা বলতে মার্কস সাধারণভাবে উৎপাদন প্রসঙ্গ তোলেননি। মার্কস জোর দিয়েছেন উৎপাদন সর্ম্পকের উপর, যার অর্থ হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে সামাজিক মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যে সর্ম্পক গড়ে তোলে।

মার্কসবাদীরা বলেন উৎপাদনের উপাদানসমূহ উৎপাদন সম্পর্ক স্থির করে দেয়। অপরদিকে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা অর্থনৈতিক কাঠামো নির্ধারিত হয়। অর্থনৈতিক কাঠামো আবার সামাজিক উপরিকাঠামো স্থির করে। অর্থনৈতিক কাঠামোকে মার্কস ‘ভিত্তি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই ভিত্তির উপরে সামাজিক উপরিকাঠামো নির্ভরশীল। অর্থাৎ শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি-ধর্ম সমস্ত কিছুই অর্থনীতির উপর মূলত নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তন ঘটলে সামাজিক উপরিকাঠামোর পরিবর্তন ঘটবে। সামন্তবাদী অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তন ঘটায় পুঁজিবাদী অর্থ কাঠামো রূপায়িত হয়েছে, ফলে সামন্তবাদী সমাজ কাঠামোর বদল ঘটেছে।[৪]

মানুষকে সমাজে কাজ করতে হয় পরস্পরের সাহায্য নিয়ে, যন্ত্রপাতির সাহায্য নিয়ে। এসব যন্ত্রপাতি আবার অন্যদের শ্রমের ফলেই তৈরি হয়। মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং প্রকৃতিকে বাস্তব প্রয়োজনে কাজে লাগায়, কিন্তু এই সংগ্রাম মানুষ একা করে না, ব্যক্তিগতভাবে করে না, করে দলবদ্ধভাবে, সমাজবদ্ধভাবে। সুতরাং, সর্বকালে সর্ব অবস্থায় উৎপাদন বলতে সামাজিক উৎপাদন বোঝায়। মানুষের কার্যক্রম ও ভোগ, দুইই সামাজিক চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হয়। কার্ল মার্কস লিখেছেন,

“ক্রিয়া এবং উপভোগ উভয়েই তাদের আধেয় এবং অস্তিত্বের ধরনে সামাজিক; সামাজিক ক্রিয়া এবং সামাজিক উপভোগ। প্রকৃতির মানবপ্রেক্ষিত কেবল সামাজিক মানুষের জন্যই অস্তিত্ববান; কারণ কেবল তখনই প্রকৃতি তার জন্য মানুষের সঙ্গে বন্ধন হিসেবে_ তার অস্তিত্ব অন্যের জন্য এবং অন্যদের অস্তিত্ব তার জন্য বহাল থাকে আর মানব বাস্তবতার জীবন উপাদান হিসেবে কেবল তখনই তার নিজের মানব অস্তিত্বের ভিত্তি হিসেবে প্রকৃতি অস্তিত্বশীল থাকে। কেবল এখানেই যা তার কাছে স্বাভাবিক অস্তিত্ব তা হয় মানব অস্তিত্ব, আর প্রকৃতি তার কাছে মানুষ হয়ে যায়।”[৫]

উৎপাদন কার্যক্রমের মধ্যে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠে ব্যবহারযোগ্য বস্তুর উৎপাদনে মানুষকে পারস্পরিক কোনো না কোনো সম্পর্কের বন্ধনে, কোনো না কোনো উৎপাদন সম্পর্কে আবদ্ধ হতে হয়। মানুষের নিজের প্রয়োজনে যে উৎপাদন তা যেমন প্রকৃতির উপর তেমনি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর ন্যস্ত হয়। কার্ল মার্কস লিখেছেন,

“উৎপাদনে মানুষ শুধু প্রকৃতির ওপরই ক্রিয়া করে না, তারা পরস্পরের ওপরেও ক্রিয়া করে। এক বিশেষ ধরনে সহযোগিতা করে এবং পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়া করে তবেই তারা উৎপাদন করে। উৎপাদনের জন্য তারা পরস্পরের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সংযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন করে এবং কেবলমাত্র এই সব সামাজিক সংযোগ ও সম্পর্কের অভ্যন্তরেই ঘটে প্রকৃতির উপর তাদের ক্রিয়া, উৎপাদন।”[৬]

মার্কস ও এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, মানবজাতির ইতিহাস হচ্ছে এক অগ্রগামি বিকাশ। তাঁরা সমাজ বিকাশে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ দেখিয়েছেন। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সামাজিক বিকাশ হচ্ছে পুরনো থেকে গুণগত নতুন অবস্থায়, সরল থেকে অধিকতর জটিল এবং নিম্নতম কম উন্নত ধরন থেকে সুউচ্চ অধিকতর অগ্রণী ও শ্রেষ্ঠ আকারের সামাজিক গঠন ব্যবস্থায় সমাজের নিরন্তর অগ্রগতি। সমাজের ইতিহাস কখনোই মানবজাতির কোনো এক আদর্শ অবস্থা চূড়ান্তভাবে লাভ করতে পারে না। বরং উলটোভাবে সমাজ অনবরত বিকাশশীল। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস লিখেছেন,

“ইতিহাসের গতিপথে পারস্পরিক বদলকারী সব সামাজিক গঠন-ব্যবস্থা হলও নিম্নতম ধাপ থেকে উচ্চতম ধাপে মানবসমাজের সীমাহীন বিকাশের নানা উত্তরণ ধাপ মাত্র। প্রতিটি ধাপই আবশ্যিক আর, এইভাবেই সেই সময়ের পক্ষে ও সেইসব পরিস্থিতির পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করে, যেগুলির কল্যাণে তার উদ্ভব ঘটে। তবে তা নতুন নতুন, আরো বেশি উঁচু পরিস্থিতির_ যেগুলি ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে তার নিজস্ব গর্ভে_ সামনে ঠুনকো হয়ে উঠছে ও অনুপযুক্ত হয়ে আসছে। তা আরো বেশি উঁচু ধাপের কাছে স্থানত্যাগে বাধ্য, কালক্রমে যারও আবার পতন ও বিনাশ ঘটবে।”[৭]

মানুষের এবং প্রকৃতির ইতিহাস পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষের ইতিহাস থেকে প্রকৃতির ইতিহাসকে বা প্রকৃতির ইতিহাস থেকে সামাজিক মানুষের বিকাশের ইতিহাসকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হয়। ফয়েরবাখ মানুষ ও সমাজের ইতিহাসকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার কারণে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যে মানুষের সমাজের বিকাশ সাধান হয়েছে তা অস্বীকার করেছিলেন। ফয়েরবাখের তাত্ত্বিক ভ্রান্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কার্ল মার্কস এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধীতা করে বললেন,

“আমরা কেবল একটি বিজ্ঞানের কথাই জানি, তা হলো ইতিহাসের বিজ্ঞান। ইতিহাসকে অন্য কেউ দুইভাবে দেখতে পারে, অর্থাৎ তারা ইতিহাসকে প্রকৃতির ইতিহাস ও মানুষের ইতিহাস এই দুইভাগে ভাগ করতে পারে। কিন্তু তারা আদতেই অবিচ্ছিন্ন বা একাঙ্গিভূত। যতদিন মানুষের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন প্রকৃতি ও মানুষের ইতিহাস পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে।”[৮]

সমাজ বদলের ভেতর দিয়ে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং এই পরিবর্তনের পথ প্রস্তুত হয় অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। নতুন উৎপাদিকা শক্তি ও পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে, সমাজের নতুন অর্থনৈতিক দাবির মধ্য দিয়ে নতুন সামাজিক চিন্তাধারা জেগে উঠে। এই সব পরিবর্তন বাস্তব ক্ষেত্রে কার্যকর করা হয় রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সংগ্রাম যে রূপই গ্রহণ করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত মানুষই অর্থনৈতিক বিরোধ ও শ্রেণি বিরোধ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে এবং সংগ্রাম করে এই বিরোধের অবসান ঘটায়।[৯]

তথ্যসূত্র:

১. টম বটোমোর, হিমাংশু ঘোষ অনূদিত, মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, প্রথম অনুবাদ সংস্করণ, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা xlvii-xlix
২. খারিস সাবিরভ, কমিউনিজম কী; প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৮৮; পৃষ্ঠা- ৩৩৮।
৩. কার্ল মার্কস, মার্কস এঙ্গেলস পত্রাবলিসংগ্রহ, ইংরেজি বাক্যটি এরূপ: What is society? Whatever its form may be, the products of mens reciprocal action.
৪. টম বটোমোর, হিমাংশু ঘোষ অনূদিত, মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, প্রথম অনুবাদ সংস্করণ, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা l
৫. কার্ল মার্কস, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি; জাভেদ হুসেন অনূদিত, বাঙলায়ন, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা-৯০; ইংরেজি বাক্যগুলো এরকমঃ Activity and consumption, both in their content and in their mode of existence, are social activity and social consumption. The human essence of nature exists only for social man; for only here does nature exist for him as a bond with other men, as his existence for others and their existence for him, as the vital element of human reality; only here does it exist as the basis of his own human existence. Only here has his natural existence become his human existence and nature become man for him. Society is therefore the perfected unity in essence of man with nature, the true resurrection of nature, the realized naturalism of man and the realized humanism of nature.
৬. কার্ল মার্কস, মজুরি শ্রম পুঁজি; ডিসেম্বর ১৮৪৭; মার্কস এঙ্গেলস রচনাবলী, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২; পৃষ্ঠা-৮২।
৭. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস; Ludwig Feuerbach and the End of Classical German Philosophy, in: Karl Marx & Frederick Engels, Selected Works in three volumes, Vol-3, p. 339.
৮. কার্ল মার্কস, জার্মান ভাবাদর্শ; ইংরেজি বাক্যগুলো এরকমঃ We know only a single science, the science of history. One can look at history from two sides and divide it into the history of nature and the history of men. The two sides are, however, inseparable; the history of nature and the history of men are dependent on each other so long as men exist.
৯. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] লিখিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ৭৬-৮১ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরে ডট কমে ১২ আগস্ট ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত। সেখান থেকে লেখাটি ১২ জুলাই ২০২২ তারিখে ফুলকিবাজ ডট কমে পুনরায় প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ২২ আগস্ট ২০১৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!