সাম্যবাদী আন্তর্জাতিক বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের কার্যক্রম ও ভূমিকা

১৯১৮ সালে পেত্রোগ্রাদে আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি প্রস্তুতি সভা হয়। অংশ নেয় বলশেভিক পার্টি, বাম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী, বিভিন্ন দেশের সমাজ গণতন্ত্রী দল প্রভৃতি। এতে সভাপতিত্ব করেন ম্যাক্সিম গোর্কি। সম্মেলনে ৮২ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। মূল বক্তা ছিলেন জিনভিয়েভ। মূল কমিটির সভাপতি হন ভ্লাদিমির লেনিন (রাশিয়া), হিউগো এবারলিন (জার্মানী) প্ল্যাটেন (সুইজারল্যান্ড)। নিয়মতান্ত্রিক, নরমপন্থী ও বিপ্লববিরােধী দল ও শ্রমিক গােষ্ঠীসমূহের সঙ্গে একত্র কাজ করা সম্ভব নয় বুঝে লেনিনের নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠা হয়। লক্ষ্য ও পথ সুচিহ্নিত ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক থেকে পৃথকীকরণের সুবিধার্থে সেটির নামের সঙ্গে কমিউনিস্ট শব্দটি যুক্ত হয়।[১]

আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয় ১৯১৯ সনের মার্চ মাসের মস্কো সম্মেলনে। এই সংগঠনই সংক্ষেপে কমিন্টার্ন, Communist International বা সংক্ষেপে Comintern, নামে পরিচিত হয়। মোট ৩৫টি দল এতে অংশ নেয়। তার ভেতর ১৪টি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশের দল। সভাপতি নির্বাচিত হন জিনভিয়েভ। সম্পাদক হন কার্ল রাদেক। জার্মান প্রতিনিধি হিউগো এবারলিন এই প্রক্রিয়ায় আপত্তি জানিয়ে ভোট-দানে বিরত থাকেন। সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধি, পার্টির বিনা অনুমতিতে সম্মেলনে যোগদানের জন্য বহিষ্কৃত হন পার্টি থেকে।

কমিন্টার্ন পরিণত হয়েছিল প্রথম আন্তর্জাতিকের উত্তরসূরিতে ও কাজকর্মের অনুসরণকারী, যা প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিক সংগ্রামের এবং পরবর্তীকালের শ্রমিক আন্দোলনের সর্বোত্তম ঐতিহ্যসমূহের মতাদর্শগত বুনিয়াদ তৈরি করেছিল। কমিন্টার্ন কার্যকর ছিল ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে তার মোট ৭টি কংগ্রেস বসে।

কমিন্টার্নের দ্বিতীয় সম্মেলন হয় ১৯২০ সনে। পেত্রোগ্রাদে ১৬৯ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। ৬৪ জন রুশ, ২৮ জন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য অঞ্চলের, ৭৭ জন নানা দেশের, অর্থাৎ ইউরোপের। রাদেক দীর্ঘ প্রতিবেদন পেশ করেন।

১৯২১ সনে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় সম্মেলন। এতে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি দেশ ও ২৮টি যুবলীগ। রিপোর্ট রাখেন ত্রতস্কি। তিনি বলেন পুঁজিবাদ ভাঙনের মুখে। লেনিন বক্তৃতায় আহবান জানান জনগণের মধ্যে যাবার জন্য।

আরো পড়ুন:  শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সমিতির সাধারণ নিয়মাবলি

চতুর্থ সম্মেলন হয় ১৯২২ সনে। ৫৮টি দেশ অংশ নেয়। তৈরি হয় ২০টি কমিশন। তার ভেতর ১১টি তৈরি হয় সদস্য রাষ্ট্রের ভেতর কলহ নিরোধের জন্য। লেনিন এই সম্মেলনেই শেষ যোগ দেন। নেতৃত্বে আসেন স্তালিন, জিনভিয়েভ, কামেনেভ।

পঞ্চম সম্মেলন মস্কোতে ১৯২৪ সনে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই প্রথম আহবান জানানো হয় সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টিকে বলশেভিকরণ করবার জন্য। সম্মেলনে রাশিয়ার বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ছিলেন ১০৮ জন। বিভিন্ন দেশের পার্টি-নেতৃত্ব বদলের নির্দেশ এখান থেকে দেওয়ার প্রচলন হয়। ৫০৮ জন প্রতিনিধি, ৪৯টি কমিউনিস্ট পার্টি ও ১০টি আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে যোগ দেন। জিনভিয়েভ-এর পরিবর্তে বুখারিন প্রাধান্যে আসেন। পরে সভাপতি হন মলোটভ। স্তালিনের নেতৃত্বকে সমর্থন জানান তোগলিয়াত্তি, ব্রাউডার, থরো, ফস্টার, প্রভৃতি যাঁদের অনেকেই পরে কঠোর স্তালিন-বিরোধি হন।

ষষ্ঠ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৮ সনে। ৫৭টি পার্টি ও ৭টি সংগঠন থেকে ৫৩২ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। ত্রতস্কি, এক দেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব নয়, এই বক্তব্য পেশ করেন, যা গৃহীত হয় না। এই সম্মেলনে বলা হয়, এই সংগঠন হলও বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টির সম্মিলিত একটি বিশ্ব কমিউনিস্ট পার্টি।

সপ্তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সনে। ৭৬টি কমিউনিস্ট পার্টি এই সম্মেলনে যোগ দেয়, যার মধ্যে ২২টি ছিল বৈধ। ৫১৩ জন প্রতিনিধি আসেন ৬৫টি দেশ থেকে জর্জি দিমিত্রভের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের তত্ত্ব ঘোষিত হয় এখান থেকে।

যুদ্ধ দেখা দিলে স্বভাবতই যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচিই প্রাধান্য পায়। এর মধ্যে নাৎসি-বিরোধী ফ্রন্ট গড়ার লক্ষ্যে ১৯৪৩ সনে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভেঙে দেয়া হয়। শেষ সভাপতি ছিলেন দিমিত্রভ।

কমিন্টার্নের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবদান ছিল এই যে, তা বিভিন্ন দেশের মেহনতিদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন জোরদার করেছিল, প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের পর উদ্ভূত নতুন নতুন পরিস্থিতিতে শ্রমিক আন্দোলনের তাত্ত্বিক প্রশ্নসমূহ প্রণয়ন করেছিল, কমিউনিজমের প্রচার ও চালু করার সাধারণ নীতিগুলো স্থাপন করেছিল, সুবিধাবাদীদের দ্বারা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষাকে নোংরা ও বিকৃত করার হাত থেকে তাকে বাচিয়েছিল, কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালকদের গড়ে পিটে তৈরি করেছিল। তার ফলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল যাতে নবীন কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ব্যাপক শ্রমিক পার্টিতে পরিণত হতে পারে। কমিন্টার্নের কাজকর্মে মহান তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অবদান রেখেছিলেন লেনিন।

আরো পড়ুন:  তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের শতবর্ষ উদযাপন কমিটির আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক স্থাপনের ব্যাপারে লেনিনের প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য সংগঠিত বাহিনীতে সমস্ত বিচ্ছিন্ন দল ও গ্রুপকে মিলিত করা। কমিউনিস্ট আন্দোলনের মুখ্য কর্তব্যরূপে লেনিন মনে করতেন অধিকাংশ শ্রমিককে নিজের পক্ষে টানাকে, আর বিপ্লবী পার্টির কর্তব্যরূপে মনে করতেন সর্বাগ্রে শ্রমিকদের সংহতিসাধন, আর তা যেমন জাতীয় তেমনি আন্তর্জাতিক পরিসরে।

লেনিন এ ধারনা উত্থাপন করেন যে, বিশ্ব বিপ্লব প্রক্রিয়ায় উপনিবেশগুলোর নিপীড়িত জনগণের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সংগে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মিলন ঘটান হোক। ঠিক সে কারণেই তিনি কমিন্টার্ন উত্থাপিত এই শ্লোগানকে সঠিক ও নীতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, ‘সব দেশের মজদুর ও নিপীড়িত জনগণ এক হও!’।

লেনিনীয় ধারনার ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদউপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিপ্লবী শক্তিগুলোর সংহতিসাধনে কমিন্টার্ন প্রচণ্ড কাজ করেছিল। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক সাধারণ ফ্রন্টে বিপ্লবী শক্তিগুলোকে মিলিত করা, তাদের পারস্পরিক কার্যকলাপ ও বিকাশ জোরদার করার ধারনা হচ্ছে বিশ্ব বিপ্লব সংক্রান্ত লেনিনীয় প্রক্রিয়া। বিশ্ব বিপ্লব প্রক্রিয়ার ব্যাপারে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলন বিকাশের ব্যাপারে লেনিনীয় ধারনাগুলো আজো দুনিয়ার কমিউনিস্টদের, প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সেবা করছে, আর তা করছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জয়জয়কারের জন্য তাদের কঠিন সংগ্রামে নির্ভরযোগ্য দিক নির্ণায়ক রূপে। 

তথ্যসূত্র ও সহায়ক গ্রন্থ ও টিকা:

১. গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন্দ্রমোহন. রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৭৬।

২. সমীরণ মজুমদার, মার্ক্সবাদ বাস্তবে ও মননে, স্বপ্রকাশ, কলকাতা, ১ বৈশাখ, ১৪০২; পৃষ্ঠা ১০৫-৬।

৩. খারিস সাবিরভ, কমিউনিজম কী, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৯৩-৬।

৪. ইংরেজি উইকিপিডিয়া।  

৫. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ৯৭-১০০ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশ করা হলো। প্রবন্ধটির রচনাকাল ১২ জুলাই, ২০১৪।

আরো পড়ুন:  আন্তর্জাতিক-এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

Leave a Comment

error: Content is protected !!