মতিন ভাই ও একটি সন্ধ্যা

তখনও শীত শেষ হয় নি। বাইরে হালকা কুয়াশা ছিল। সন্ধ্যায় লোকজন শীতের পোশাক গায়ে শহরের অন্য সব ব্যস্ত রাস্তার মত মালগুদামের রাস্তাটিকেও ব্যস্ত করে তুলতো। চায়ের দোকানের পাশাপাশি কয়েকটা পিঠার দোকানে লোকে জমে ওঠে সন্ধ্যা থেকেই। উষ্ণ চায়ের কাপে হাতে রাজনৈতিক, সাংসারিক, ব্যক্তিগত নানা কথা চলতে থাকে রাত ১০ টা পর্যন্ত। প্রতিদিন নানা বামপন্থী রাজনৈতিক দলের, মতের লোক আসা যাওয়া ছিলও মালগুদামে। এছাড়াও মালগুদাম এলাকায় থাকত শ্রমিক, হকার, ঝি, দর্জি বিভিন্ন ধরণের খেটে খাওয়া মানুষ। দিনশেষে সবাই ঘরে ফিরত আর বেশ সরাগম হতো এ এলাকা। তবে মানুষের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বাজত দর্জির সেলাই মেশিনের সুইয়ের খট খট আর কাপ ও চামুচের টুং টুং।

এমনি এক সন্ধ্যায়, বাসদ অফিসে বসে ছিলাম। সন্ধ্যা ৭টা ৩০মি হবে। তিনি এসেছিলেন, গাল ভর্তি চাপদাড়ি, পাতলা কাচের ফ্রেমের ভেতর সুপ্ত স্বপ্ন লুকানো চোখ, হাসি মাখা মুখে মাঝারি উচ্চতার আমার একজন প্রিয় ব্যক্তি, তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাতে বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর মাঝে লুকিয়ে আছে দৃঢ়ভাবে টিকে থাকার সংগ্রামের কাহিনী। তাঁকে ডাকতাম ভাই বলে, মতিন ভাই। অনেকের কাছে প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন আবার অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন অবহেলিত, ঝামেলা। মালগুদামে বিভিন্ন রাজনৈতিক অফিসের মধ্যে বাসদ অফিসে এসে তিনি আড্ডা দিতেন বেশি। এত বেশি জীবনশক্তি তাঁর মুখে খেলা করত যে বয়সের ভারে শারীরিক অসুস্থা কখনো উঁকি দিতে পারতো না।

সহজ সরল জীবন কিন্তু বিচিত্রময় ও অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে চলা ব্যক্তিটির জীবন আমার কাছে কৌতূহল সৃষ্টি করতে থাকে। সেই সন্ধ্যায় মতিন ভাইয়ের সাথে তাঁর বিচিত্রময় সংগ্রামী জীবন নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাই। মতিন ভাই বলতে শুরু করেন, তখন আমি হাই স্কুলে পড়তাম। সেই সময় থেকেই দলের সাথে যুক্ত। ক্লাসের মধ্যে ছাত্র হিসাবে খারাপ ছিলাম না। আমার রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ততার কথা বন্ধুদের প্রথম অবস্থায় জানতে দেই নি তবে আমার খুব ঘনিষ্ঠ দু-একজন বন্ধু আমার কথা শুনে বুঝেছিল আমি একটু অন্য রকম। আমার মুখ থেকে শুনার পরে তারা ভয় পায় কিন্তু কাজটাকে সমর্থন করেছিল। তাদের খুব সাবধান থাকতে বলেছিলাম যেন কেউ জানতে না পারে। আমার রাজনৈতিক কাজগুলো স্বাভাবিক চলতে থাকে। এর মাঝেই হঠাৎ একদিন আমরা কয়েক জন সহযোদ্ধা ধরা পড়ে যায় পুলিশের হাতে। আমিও নিজের ও পরিবারের কিছু বোকামির কারনেই ধরা পড়ে গেলাম। আমার কাছে একটা বন্ধুক ছিল কিন্তু তার ব্যবহার তখনও আমি জানতাম না। পরিবারের কেউ আমার এই ব্যাপারটা জানতো না। পুলিশ আমাদের দলের লোকদের খুঁজছিল। আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ি। বন্ধুকটা লুকানোর চেষ্টা করতে থাকি। এর মধ্যে মা দেখে ফেলেন। মা ভয় পায়। আমি বলি, ‘চুপ, কেউ যেন না জানে।’ কিছু বিষয় মাকে বলি। কিন্তু মায়ের ভয় কমে না। বারবার বলতে থাকে ‘বন্ধুকটা ফেরত দিয়ে আয়।’ মায়ের এসব কথায় পাশের বাড়ির লোক শুনে ফেলে। একমুখ-দুইমুখ করে পাড়ার লোক জেনে ফেলে। তারপরে যা হবার তাই হলো।

আরো পড়ুন:  বিপ্লবী বীরত্ব

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। তখন জেলে। হতাশ হয়ে পড়ে ছিলাম। কিন্তু কিছু দিন পরে আরও কয়েক জনকে দেখতে পাই আমারই মতো। অনেক চেষ্টা করে জেলের মধ্যে থেকে লেখাপড়াটা চালিয়ে যায়। তবে এর জন্য আমরা জেলবন্দি কিছু ছাত্ররা আন্দোলন করেছিলাম। মা ও পরিবারের অনেকেই দেখা করতে আসতেন। কিন্তু এরপরে মা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাই আসা বন্ধ করেছিলেন কিন্তু খাবার পাঠাতেন। জেলে বসেই আমার এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি জীবন পার হয়। অনেক দিন পড়ে এক নতুন পুলিশ অফিসার আমাদের আবিষ্কার করেন। আমরা ৭ জন ছিলাম। আমাদের মামলা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। পুলিশ অফিসার  আমাদের কাছে অনেক দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু ততদিনে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় চলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে রাজনীতি। জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে অনেক কিছু। জেল থেকে বেরিয়ে বাড়িতে যায়। কিন্তু মাকে কাছে দেখতে পাই না। কেউ কোন কথা বলে না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে মাকে খুজছি। সবার চোখে একটা অন্য দৃষ্টি ছিলও। মনের মধ্যে সন্দেহ হতে থাকে। একে ওকে বলার পড়ে জানতে পাই মা নেই, তখন মনে পরে সেই অসুস্থাতার কথা যা থেকে মা আর সুস্থ হতে পারেন নি। মারা গিয়েছেন বিশ্বাস করতে কিছুদিন জেলের জীবনের চেয়েও বেশি কষ্ট অনুভব করেছিলাম।

আমি নিজে যেনো মতিন ভাইয়ের কথার সাথে সেই মুহুর্তগুলোতে, সেইসব দিনগুলোতে ঘুরে দেখছিলাম আর অনুভব করছিলাম। ভাবছিলাম স্বপ্ন কতটা গভীর হলে জীবনের রঙিন দিন নষ্ট করে জেল খাটার পড়ো আবার স্বপন দেখতে শুরু করা যায়। মতিন ভাই বলেছিলেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়েছে জেলে থেকে তবে এনিয়ে দুঃখ নেই জীবন সাজানোর কথা তো ভাবিনি, আমি দেখেছি দেশ সাজানোর স্বপ্ন, বিপ্লবের স্বপ্ন। অবশ্য স্বপ্নটি দেখিয়েছি রাজনৈতিক নেতাদের আলোচনাতে। তাই জেল খেটে বের হবার পড়ও দুঃখ ছিলনা। কারণ আমার মনে হচ্ছিলো বিশাল স্বপ্ন নিয়ে জেলে খাটছি। এখনো স্বপ্ন দেখছি সাম্যের।  

আরো পড়ুন:  নিপীড়িত মানুষের সাথে ছিলেন কমরেড এম. এ. মতিন --- শোকসভায় বক্তারা

অর্থের যোগান কীভাবে হতো প্রশ্ন করতেই তিনি বলেছিলেন, গ্রামবাসী তো আমাদের ভালবাসতো। তারা আমাদের অনেক সহযোগিতা করত। এ বিষয়ে আমি প্রশ্ন দীর্ঘ না করে বললাম, অনেক সময় আত্নগোপন করতে হতো তখন কি করতেন। মতিন ভাই বলেন, অনেকবার তো এমন করতে হয়েছিল সবটা বলা তো অনেক কঠিন, একটি ঘটনা বলি। একবার আমাদের কয়েকজন সহকর্মীকে লুকিয়ে থাকতে হবে। তবে তা পরিচিত বাড়ি ছাড়া থাকা সম্ভব না, আবার সেই বাড়ির মানুষরা যাতে বিরক্ত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। বাড়ি থেকে চলে যাবার আগে সে বাড়ির যেকোনো কাজ করে দিতে হবে এটা নির্দেশ ছিল। আমি ও সহকর্মীরা মিলে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অনেক পথ হেঁটে এক সহকর্মীর পরিচিত বাড়িতে এসেছিলাম। তখন দুদিনে ক্ষুধা পেটে ছিল কিন্তু বাড়ির গিন্নীকে বিরক্ত না করেই আমরা নিজেরাই ভাত রান্না করে খাই। বাড়িতে একটি মেয়ে ছিল তার বিয়েও হয়েছে, তবে তার স্বামী সাথে সম্পর্ক ভাল ছিলনা। কিছুদিন যাওয়ার পরে আমাদের উপর বাড়ির গিন্নির আস্থা আসার পরে নিজে থেকে আমাদের কাছে একটা সহযোগিতা চেয়েছিলেন, তাঁর মেয়ের স্বামীকে একটু ভয় দেখাতে হবে, আমরা করেছিলাম তবে ভয় দেখিয়ে নয়, বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা ভাল হয় নি এর ফলে পুলিশ জেনেছিল। তার সাথে পাড়ার লোক। বাড়ি থেকে যাবার আগে আমরা বন্ধুক থেকে গুলি ছুঁড়েছিলাম। এতে বাড়ির আশেপাশের মানুষেরা ভয় পেয়েছিল।

মতিন ভাইয়ের সংগ্রামী জীবনের ব্যাপ্তি অনেক। যা এক দু ঘণ্টায় শেষ হবে না। মানুষটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায় সেই সন্ধ্যার আলোচনার করে। এরপরে কত সময় হেঁটেছি মিছিলে পিচঢালা পথে, মিলিত হয়েছি আমরা জনসভায়, তারপরও মনে হয় সংগ্রামী ব্যক্তিটির কাছ থেকে অনেক কিছু জানার ছিল, শেখার ছিল কিন্তু আর কখনো সময় হয় নি, আর কখনো হবেও না। মতিন ভাই সবসময় সামনে সাম্রাজ্যবাদকে শত্রু চিহ্নিত করে প্রচার চালিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। 

এখনও শীত আসেনি। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। জানতে পেলাম আমাদের অনেকেরই প্রিয় এবং সংগ্রামী ব্যক্তিটি আর নেই (২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)। চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। মনে মাঝে খেলতে থাকে অনেক স্মৃতি, এক জনসভায় পিছন থেকে এসে পাশে দাঁড়ালেন মতিন ভাই, ভাল আছেন, দোলন আপা?

হ্যাঁ, আপনি কেমন আছেন?

ভাল। হাতে ছিল বিভিন্ন রং লিফলেট। একটি হাতে দিয়েই বললেন চলি, পড়বেন। বাড়িতে এসে ভেবেছিলাম ক্ষয়ে যাওয়া দলের সদস্য হিসেবে ছিলেন মতিন ভাই ময়মনসিংহ শহরে তাই বলে তিনি হাল ছাড়েন নি লড়েছেন গণশত্রুদের বিরুদ্ধে।

আরো পড়ুন:  গিওর্গি ভালেন্তিনোভিচ প্লেখানভ ছিলেন প্রখ্যাত রুশ চিন্তাবিদ এবং মার্কসবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা

মতিন ভাইয়ের শোকসভা করা হবে আলোচনা চলছে। ময়মনসিংহের মাঝে এমন একজন সংগ্রামী মানুষ ছিলেন তিনি; মৃত্যুর পড়ে মতিন ভাই-এর জীবনের সংগ্রামের আর খণ্ড খণ্ড কাহিনী প্রকাশ পায়। সিরাজ সিকদারের অনুরাগী, গেরিলাযোদ্ধা ছিলেন। তিনি টাকার বিরোধী ছিলেন। নিজের বাবার কাছ থেকে যে সম্পত্তি পেয়েছিলেন তা ছেড়ে বস্তির শ্রমিকদের সাথে বসবাস শুরু করেছিলেন। ব্রহ্মপুত্রের পাশে চর কালীবাড়ি আছে যা গড়ে তুলেছিলেন মতিন ভাই, বিকাশ ভৌমিক ও তাঁরই অনেক সহকর্মীরা মিলে। এমনি অনেক চর দখন করেছিলেন তাঁরা এবং সেখানে বাস করত নির্যাতিত, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষেরা। চর কালীবাড়িতে যারা আশ্রয় নেয় তাঁরা ছিল গৃহহীন শ্রমিক, মতিন ভাই তাঁদেরই সাথে থাকতেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক জটিলতার কারণে মতিন ভাই অন্যত্রে চলে যান। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন পার্টির সাথে একনিষ্ঠ ছিলেন, কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখেন নি। খুব সাধারণ জীবন যাপন করেছিলেন, একজন শ্রমিকের জীবন যেমন ঠিক তেমন। তিনি জন্মস্থানে মাঝে মাঝে যেতেন কারণটা আমরা জানতে পারি মৃত্যুর পরে; সেখানে কিছু কৃষক ছিল যাদের বস্তি নিয়ে নানা সমস্যা হত তা মেটানোর জন্য।

দলের কর্মী হিসাবে যেসব সংগ্রাম করা দরকার ছিল তিনি তাই করেছিলেন কিন্তু পার্টির নেতৃত্বের যা করা দরকার ছিল তার কমতি ছিল সেই কারণে মতিন ভাইয়ের সেই অসমাপ্ত স্বপ্ন যা আজও পূরণ হয় নি। তিনি অনেক সাধারণ ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর সংগ্রাম মোটেও সাধারণ নয়। চিন্তার জায়গা থেকে অনেক ক্ষেত্রে মতিন ভাই ও আমাদের অনেকের সাথে দ্বন্দ্ব ছিল কিন্তু আমার দেখা তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের জন্য না শ্রমিকের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।    

Leave a Comment

error: Content is protected !!