চীনা দর্শন হচ্ছে চীন দেশে উল্লেখযোগ্য মনীষাগত ও সাংস্কৃতিক বিকাশ

চীনা দর্শন বা চীনের দর্শন (ইংরেজি: Chinese Philosophy) হচ্ছে চীন দেশে উল্লেখযোগ্য মনীষাগত ও সাংস্কৃতিক বিকাশ। চীনা দর্শনের ইতিহাস ভারতীয় ও গ্রীক দর্শনের ন্যায় সুপ্রাচীন। খ্রীষ্টাব্দের হাজার বছর পূর্বেও চীনে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের দার্শনিক আলোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সময়ে চীনে দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল বস্তুবাদী। কিছু সংখ্যক দার্শনিক সূত্র এই সময়ে প্রচলিত ছিল। এই দার্শনিক সূত্রগুলির বক্তব্য ছিল যে, বিশ্বপ্রকৃতির মূলে রয়েছে পঞ্চশক্তি যথা –পানি, আগুন, কাঠ, ধাতু এবং মাটি। সমস্ত সৃষ্টি এই পঞ্চশক্তির সম্মেলনেরই ফল।[১]

পরবর্তীকালে ইকিং বা পরিবর্তনের গ্রন্থে এই সূত্রগুলি গ্রথিত হয়। ইকিং-এ বিশ্বপ্রকৃতির মূল হিসাবে পাঁচটির বদলে আটটি বস্তুর উল্লেখ দেখা যা। ইকিং –এর বাইরে ইন এবং ইয়াং বলে আরও দুটি সূত্রের কথাও জানা যায়। ইন-এর অর্থ হচ্ছে স্থিতি এবং ইয়াং-এর অর্থ গতি। এদেরকে অনেক সময় যথাক্রমে প্রকৃতির অন্ধকার এবং আলো; অস্তি এবং নাস্তি; পুরুষ এবং স্ত্রী হিসাবে উল্লিখিত হতে দেখা যায়।[২]

তাওবাদ প্রসঙ্গে

খ্রিষ্টাব্দ শুরু হওয়ার পূর্বে পঞ্চম থেকে তৃতীয় শতাব্দীতে প্রাচীন চীনা দর্শন অধিকতর সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। এই সময়ে চীনা দর্শনের বিভিন্ন প্রাচীন মতবাদ বা শাখা বিকাশ লাভ করে। এদের মধ্যে তাও দর্শন এবং মোতি দর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তাও হচ্ছে প্রাচীন চীনের দর্শনের একটি মৌলিক সূত্র। লাওজ এবং চুংজুকে তাও দর্শনের প্রধান ব্যাখ্যাতা বলা হয়। এঁরা বস্তুর অস্তিত্ব এবং চরিত্র ইত্যাকার দার্শনিক সমস্যার আলোচনা করেন। তাও বলতে স্বভাব, প্রকৃতি এবং পরবর্তীকালে প্রাকৃতিক বিধান বুঝাত। একে নীতির সূত্র বা আদর্শ হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। চীনের দর্শনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘তাও’ সূত্রের অর্থেরও বিকাশ ঘটেছে। চীনের ভাববাদী দার্শনিকগণ ‘তাও’ কে একটি ভাববাদী সূত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, আবার লাওজু, সুনজু, ওয়াংচাং প্রমুখ বস্তুবাদী দার্শনিক তাওকে বস্তুর প্রকৃতি এবং বস্তুর পরিবর্তনের নিয়ম বা বিধান বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

অপরদিকে দার্শনিক মোতি এবং তাঁর অনুসারীগণ জ্ঞানের সমস্যা মীমাংসা করার চেষ্টা করেছেন। এ আলোচনায় ভাববাদী ব্যাখ্যারও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কুংসুঙলুন নামক দার্শনিক ভাবকে বস্তুনিরপেক্ষ সত্তা বলে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর এই ব্যাখ্যার সংগে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর বস্তুনিরপেক্ষ ভাবের মিল দেখা যায়।

নীতিগত এবং রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে কনফুসিয়াস এবং মেঙজুর মতের প্রসার ঘটে। প্রাচীন চীনা দর্শনের এ যুগকে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়। এই যুগের দার্শনিক আলোচনার বিষয় ছিল প্রধানত আকাশ ‘মনের ভাব’, ধর্মশক্তি, চরিত্র, বস্তুর মৌলিক গুণ ইত্যাদি। কনফুসিয়াস ও মেঙজুর মতামতের বৈশিষ্ট্য ছিল, একজন যেখানে মানুষকে স্বভাবগতভাবে ভালো মনে করেছেন, অপরজন সেখানে মানুষকে স্বভাবগতভাবে খারাপ মনে করেছেন।

ফাচিয়া চিন্তাধারা

ফা-চিয়া প্রাচীন চীনের একটি অগ্রসরকামী চিন্তাধারা। এই ধারার প্রধান প্রবক্তা হিসাবে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে আমরা শাঙচুন এবং হানফিজু নামক দুজন দার্শনিকের সাক্ষাৎ পাই। আলোচ্য সময়ে চীনের সমাজ-দেহ একটা পরিবর্তনের প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষের অর্থনীতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহজতর বিনিময় পদ্ধতির উদ্ভবে সমাজে নতুনতর শক্তির সৃষ্টি হচ্ছিল। এর ফলে এতদিনকার অনড় সীমাবদ্ধ মাতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী-সমাজ বিচলিত হয়ে উঠল। তার স্থানে ব্যাপকতর এলকাভিত্তিক নতুন অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রয়াস পেতে লাগল।

ফা চিয়া সীমাবদ্ধ গোষ্ঠী-সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামী নতুনতর অভিজাত তন্ত্রেরই আদর্শগত হাতিয়ার। ফাচিয়া মতের অনুসারীগণ গোষ্ঠীতান্ত্রিক বিভাগের স্থানে ঐক্যবদ্ধ চীন গঠনের এবং সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের পক্ষপাতী ছিল। হানফিজু ছিলেন এই নতুন বিকাশের দার্শনিক। তিনি বলতেন, বস্তুজগতের নিয়ামত হচ্ছে ‘তাও’ বা প্রাকৃতিক বিধান। কোনো অতিপ্রাকৃতিক বিধাতা নয়। তেমনি সমাজের নিয়ামত হিসাবেও থাকবে সামাজিক বিধান বা ‘ফা’। সামাজিক বিধান দ্বারাই মানুষ সংগ্রাম করবে রক্ষণশীল শক্তির বিরুদ্ধে। হানফিজু এবং ফাচিয়ার অন্যান্য অনুসারীরা ধর্মান্ধতা, রহস্যবাদ এবং কুসংস্কারের বিরোধী ছিলেন।[৩]

বৌদ্ধবাদী চিন্তাধারা

খ্রিষ্টাব্দের প্রথম শতকে চীনা দর্শনে ভাববাদ ও বস্তুবাদের দ্বন্দ্ব অধিকতর স্পষ্টরূপে আত্মপ্রকাশ করে। চীন ভূখণ্ডে বৌদ্ধধর্মের প্রসারও এই যুগে ঘটতে থাকে। কনফুসিয়াসবাদ এবং তাওবাদের সঙ্গে বৌদ্ধবাদ একটি তৃতীয় দার্শনিক মত হিসাবে অনুসৃত হতে শুরু করে। বৌদ্ধবাদীগণ জগৎকে মায়া বলে ব্যাখ্যা করেন।

কনফুসিয়াসবাদ

কনফুসিয়াস ও তাওবাদ ভাববাদী দর্শনের উদগাতা। কিন্তু কেবল ভাববাদী দর্শনই নয় –এই যুগের বিখ্যাত দার্শনিক হো চেন তিয়েন এবং ফানচেন জগৎ, অস্তিত্ব, আত্মার অমরতা ইত্যাদি প্রশ্নে বস্তুবাদী মত প্রচার করেন।

দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকে চীনের সমাজ পরিবর্তন তার ভাবাদর্শেও প্রকাশ পেতে শুরু করে। ভাব এবং বস্তুর প্রকৃতি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনফুসিয়াস ও বুদ্ধের মতবাদের স্থানে নবকনফুসিয়াসবাদের উদ্ভব ঘটে এই সময়ে। এই যুগের অন্যতম দার্শনিক চুশী ‘লী’ এবং ‘চী’ অর্থাৎ ভাব এবং বস্তুর মধ্যে ভাবকে প্রধান বলে গণ্য করে ভাববাদের পক্ষ অবলম্বন করেন।

চীনের আধুনিক পর্বের শুরু হিসাবে আফিং যুদ্ধের বৎসর অর্থাৎ ১৮৪০ সালকে উল্লেখ করা যায়। এই সময় থেকে চীনের সমাজ জীবনে নতুন আলোড়ন ও পরিবর্তনের ধারা বইতে শুরু করে। একদিকে বৈদেশিক শক্তি চীনকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করার চেষ্টা করে। চীনের সঙ্গে আধুনিক জগতের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটতে শুরু করে। আবার অপরদিকে বিদেশীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধাত্মক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ হতে আরম্ভ করে। চীন ক্রমান্বয়ে আধা উপনিবেশে পরিণত হয়। কিন্তু ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ নতুন সংগ্রামী বস্তুবাদী চিন্তাধারারও পথ প্রশস্ত করে দেয়। মাও সেতুং এবং সান ইয়াত সেনের ন্যায় অগ্রসরবাদী চিন্তাবিদ এবং নেতৃবৃন্দ প্রাচীন বস্তুবাদের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে সামন্তবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচার এবং প্রয়োগ করতে শুরু করেন।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ১৩ মে ২০১৯, “চীনা দর্শন প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/philosophy/chinese-philosophy/
২. সরদার ফজলুল করিম, দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা, ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২, পৃষ্ঠা ১১০-১১১।
৩. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৬।

রচনাকাল: ১৩ মে ২০১৯, নেত্রকোনা, বাংলাদেশ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!