দর্শন কী? দর্শন হচ্ছে মানুষের বিশ্ববীক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গির মৌল বিধানের আলোচনা

দর্শন কী? দর্শন (ইংরেজি: Philosophy) হচ্ছে সামাজিক চেতনার সেই রূপ যা প্রকৃতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সংশ্লেষণ করে। পৃথিবী এবং পৃথিবীতে মানুষের স্থান সম্পর্কে বিশ্ববীক্ষা, ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির একটি সুসংবদ্ধ ব্যবস্থা প্রণয়নই হচ্ছে দর্শনের লক্ষ্য। শ্রেণিস্বার্থ, রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শগত সংগ্রামের সংগে দর্শন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।[১] দর্শন অভিধাটি ব্যবহৃত হতো অ-ধর্মীয় উপায়ে বিশ্বের বিশ্লেষণ বোঝাতে। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, রাজনৈতিক দর্শন, নীতিশাস্ত্র, অধিবিদ্যা, তত্ত্ববিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং নান্দনিকতাসহ বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে।

দর্শন হচ্ছে জগৎ, জীবন, মানুষের সমাজ, তার চেতনা এবং জ্ঞানের প্রক্রিয়া প্রভৃতি মৌলিক বিধানের আলোচনা। মানুষের সামাজিক চেতনার বিকাশের একটা পর্যায়েই মাত্র মানুষের পক্ষে বিশ্লেষণী দৃষ্টি নিয়ে জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে চিন্তা করা সম্ভব হয়েছে। মানুষ তার নিজের উদ্ভব মুহুর্ত থেকেই চিন্তার এরূপ ক্ষমতা দেখাতে সক্ষম ছিল না। মানুষের চেতনার বিকাশের একটা স্তরে মানুষ তার পরিবেশ সম্পর্কে চিন্তা করতে আরম্ভ করে। নিজের জীবনকে অধিকতর নিশ্চিত করে রক্ষা করার প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি জগতের রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে। প্রকৃতি, জগৎ এবং পরবর্তীকালে মানুষের নিজের দেহ এবং চেতনা সম্পর্কেও সে চিন্তা করতে শুরু করে।[২]

বুৎপত্তিগত দিক থেকে দর্শন কী:

দর্শনের স্বরূপ জানতে হলে, আমাদের প্রথমে জানতে হবে দর্শন কী? এর উৎপত্তি কোথা থেকে, এর বৈশিষ্ট্য কী, এর বিষয়বস্তু কী, লক্ষ্য কী? দর্শন শব্দটি মূলত সংস্কৃত শব্দ, এর সাধারণ অর্থ দেখা। ‘দৃশ’ ধাতু থেকে দর্শন শব্দের উৎপত্তি। দর্শন বলতে সাধারণত চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণকে বুঝায়, তবে এখানে দর্শন মানে তত্ত্ব-দর্শন, জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি।

দর্শনের ইংরেজি প্রতিশব্দ Philosophy শব্দটি গ্রিক শব্দ Philos এবং Sophia থেকে উদ্ভূত হয়েছে। Philos শব্দের ইংরেজি অর্থ Loving এবং বাংলা মানে অনুরাগ। Sophia শব্দের ইংরেজি অর্থ Knowledge or Wisdom এবং বাংলা মানে জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। কাজেই Philosophy শব্দের ধাতুগত অর্থ হয় ‘জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ।’ অন্যদিক থেকে দর্শন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। ‘দৃশ’ ধাতু এবং ‘অনট’ সংস্কৃত প্রত্যয়যোগে শব্দটির উৎপত্তি। দর্শন বলতে চাক্ষুস প্রত্যক্ষণকে বুঝালেও দর্শন শুধু চাক্ষুস প্রত্যক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দর্শন মানে তত্ত্ব দর্শন, জগৎ ও জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি। সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি বা তত্ত্ব সাক্ষাতকারই দর্শন।[৩]

দর্শনের সংজ্ঞায় বলা যায়, এটি এমন একটি বিদ্যা যা অনুদার মতবাদ, ভাবাবেগ ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞান বা সত্যের অনুসন্ধানে উদার দৃষ্টিভঙ্গি, অনুধ্যান, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের মাধ্যমে সত্তা, জগৎ ও জীবনের সাথে জড়িত চিরন্তন সমস্যাবলির সুষ্ঠু, যুক্তিসম্মত ও দৃঢ় আলোচনা করার একটা প্রচেষ্টা।

দর্শনের বিভিন্ন সংজ্ঞা

দর্শনের সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। প্রত্যেক দার্শনিক তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তবে এসব সংজ্ঞা সর্বজনগ্রাহ্য না হলেও একেবারে সঠিক নয় বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা এগুলো দর্শনের কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। বিভিন্ন দার্শনিকের দেয়া দর্শনের বিভিন্ন সংজ্ঞা পড়তে এখানে ক্লিক করে পড়তে পারেন।

তথ্যসূত্র

১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৬২।
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ৩০৯-৩১০।
৩. মো. আবদুল ওদুদ, রাষ্ট্রদর্শন, ঢাকা: মনন পাবলিকেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৪ পৃষ্ঠা ২০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!