ফ্যাসিবাদ কাকে বলে এবং কেন ও কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে

ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিজম (ইংরেজি: Fascism) হচ্ছে পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের সৃষ্টি, শোষক শ্রেণিগুলোর সর্বাপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল, জাতিদাম্ভিক ও আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক ধারা। ফ্যাসিবাদের প্রধান ভিত্তি শহর ও গ্রামের ক্ষুদে-বুর্জোয়া শ্রেণি এবং সমাজের শ্রেণি-বহির্ভূত স্তরগুলো। ফ্যাসিবাদের মতাদর্শিক বৈশিষ্ট হলো চরম সাম্যবাদ-বিরোধিতা ও বর্ণবাদ।[১]

পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া মহাজনী মূলধনের চরম জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ও সন্ত্রাসমূলক প্রকাশ হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ চরম জাতীয়তাবাদ, অযৌক্তিক ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষ এবং উদ্দেশ্য সাধনে চরম বর্বরতার আদর্শ প্রচার করে। ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের চরম সংকটের পরিচয়বাহক। সাম্রাজ্যবাদী যুগ হচ্ছে পুঁজিবাদের চরম যুগ। জাতীয় ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিকাশ যখন নিঃশেষিত, তখন পুঁজিবাদ নিজের শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করে। সাম্রাজ্যবাদী যুগেরও পরিণামে পুঁজিবাদ সামাজিক সংকটের ফলে বিপ্লব এবং নিজের উচ্ছেদ অত্যাসন্ন দেখে জাতীয় ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সকল ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে স্বৈরতন্ত্রের রূপ গ্রহণ করে।[৪]

অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ হচ্ছে পুঁজিবাদের তীব্র সংকটের যুগে সাম্রাজ্যবাদের একচেটিয়া পুঁজির উগ্র-জাতিয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরাচারি রূপ। জাতীয় ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিকাশ যখন নিঃশেষিত, তখন পুঁজিবাদ নিজের শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করে। আর সাম্রাজ্যবাদী যুগের পরিণামে পুঁজিবাদ সামাজিক সংকটের ফলে নিজের উচ্ছেদ আসন্ন দেখে জাতীয় ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সকল ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে স্বৈরতন্ত্রের রূপ গ্রহণ করে।  তবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রাচ্য স্বৈরাচারের ধ্রুপদী রূপ থেকে এটি মূলগতভাবে পৃথক এবং দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদী সমাজের স্বৈরাচার থেকে স্বতন্ত্র।

ফ্যাসিবাদের ইতিহাস

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে এবং ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানিতে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ফ্যাসিবাদী ইতালি এবং জাপান দখলের বেপরোয়া জঙ্গী নীতি থেকেই শুরু হয়। পরবর্তীকালে ফ্যাসিবাদী ইতালি ও জাপান জার্মানির সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী অক্ষ তৈরি করে।[৪]

১৯৩০ এর দশকে বিশ্বের সামনে ফ্যাসিবাদের প্রত্যক্ষ আক্রমণের বিপদ দেখা দেয়। ১৯১৮ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ৭ম কংগ্রেসে গৃহীত হয় দিমিত্রভ থিসিস। কমরেড দিমিত্রভ সর্বহারা একনায়কত্ব কায়েমের পথ সুগম করার লক্ষ্যেই তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে “ফ্যাসিবাদের আক্রমণ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য সংগঠনের সংগ্রামে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দায়িত্ব” থিসিস সামনে আনেন। সেই থিসিসে দিমিত্রভ দেখান,

“ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল,সবচেয়ে জাতিদাম্ভিক এবং লগ্নী পুঁজির সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূর প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব।”[২]

“ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল,সবচেয়ে জাতিদাম্ভিক এবং লগ্নী পুঁজির সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিভূর প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব।” — জর্জি দিমিত্রভ,

এই তত্ত্বে তিনি আরও বলেন যে,

“ফ্যাসিবাদের ক্ষমতারোহণ একটি বুর্জোয়া সরকারের পরিবর্তে আর একটি বুর্জোয়া সরকারের সাধারণভাবে ক্ষমতারোহন নয়, কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণির শ্রেণি আধিপত্যের এক রাষ্ট্ররূপের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পরিবর্তে আর এক রূপের প্রকাশ্য সন্ত্রাসমূলক একনায়কত্বের ক্ষমতা আরোহণ।”[২]

সে প্রেক্ষিতে করণীয় হিসেবে এই বলা হয়,

“বর্তমানে ফ্যাসিস্ট প্রতিবিপ্লব মেহনতি জনগণের ওপর শোষণ এবং পীড়নের সবচাইতে বর্বর রূপ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে আক্রমণ করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশের মেহনতি জনগণকে সুনির্দিষ্টভাবে এবং আজই বেছে নিতে হচ্ছে সর্বহারা একনায়কত্ব ও বুর্জোয় একনায়কত্বের ভিতর একটিকে নয়, বেছে নিতে হচ্ছে বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে একটিকে।”[২]

এক কথায় বলা যায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যখন শাসনকাজ চালানো পুঁজিপতিদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখনই ফ্যাসিবাদের ডাক পড়ে মূলত শ্রমিক শ্রেণি ও তার সংগঠনগুলিকে ধ্বংস করা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশে। এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৩০-এর দশকের ইউরোপ-আমেরিকার;পুঁজিবাদী মহামন্দার পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।

আরো পড়ুন:  সমর শিল্প বুর্জোয়ার শ্রেণিগত আধিপত্য সুদৃঢ়করণ ও সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের শক্তি

রম্যাঁ রলাঁ ফ্রান্সের একজন উদারনৈতিক সাম্যবাদ অনুরাগী দার্শনিক ছিলেন। তিনি সেসময় ফ্যাসিবাদ বিরোধিতায় গোটা দুনিয়াকে আলোড়িত করেছিলেন। তিনি ফ্যাসিবাদের উগ্র-জাতিয়তাবাদিতা ও এটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট বলতে গিয়ে বলেছেন,

ফ্যাসিবাদের মুখোশ একটি নহে। যে-কোনো জাতির রূপই ইহা ধারণ করিতে পারে। ইহার অঙ্গে কখনো সামরিক বেশ, কখনো ধর্মযাজকের পোশাক। ইহার রূপ কখনো পুঁজিবাদি, কখনো বা সমাজতন্ত্রী। সংস্কৃতির সর্বপ্রকার তরল মিশ্রণের মধ্যেই ইহার জীবাণু বাড়িতে পারে। কিন্তু যে মুখোশই ইহার মুখে থাকুক না কেন মূল প্রকৃতি ইহার সর্বত্রই এক — ইহা জাতিয়তাবাদী। ইহা সব কিছুকে জাতি ও জাতির সহিত একাত্মীকৃত একনায়ক রাষ্ট্রের প্রাধান্য স্বীকারে বাধ্য করে, যাহাতে সব কিছুকেই সে শৃঙ্খলিত করতে পারে।[২]

ফ্যাসিবাদ জঙ্গি ক্রিয়াকলাপ ও যুদ্ধকেও আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করে, কারণ তাতে জাতীয় আবেগ তীব্র হয় এবং সমগ্রের স্বার্থে জনগণের আত্মাহুতির প্রবণতা উত্সাহিত হয়। এক কথায় রাষ্ট্রকে উঁচু করার অর্থে ফ্যাসিবাদ সরকারকে উঁচুতে তুলে ধরে। কার্যত এটি হেগেলীয় ‘নিঃস্বার্থ আদর্শবাদ’ হিসেবে একজন স্বৈরাচারের স্থূলতায় পর্যবসিত হয়।[৩]

ফ্যাসিবাদের আক্রমণ কেবল জাতীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। বর্বরতা, অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও অন্ধ জাতীয়তাবাদ দ্বারা সঙ্কটের সমাধান করতে না পেরে ফ্যাসিবাদ অপর জাতি ও দেশকে আক্রমণ করতে শুরু করে। দেশের মানুষের দৃষ্টিতে আভ্যন্তরিক সংকট থেকে এভাবে বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়।[৪]

সমাজতন্ত্রই পুঁজিবাদের মূল প্রতিপক্ষ। এই জ্ঞান থেকেই ফ্যাসিবাদ শ্রমিক শ্রেণি ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে আক্রমণের মূল লক্ষ্য বলে নির্দিষ্ট করে। শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী আদর্শ ও সংগঠনকে ব্যর্থ করার জন্য একদিকে যেমন শ্রমিক শ্রেণির উপর সে চরম অত্যাচারের নীতি গ্রহণ করে, তেমনি তার মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য ‘জাতির ঊর্ধ্বে কিছু নেই’, ‘আমার জাতি সবার সেরা’, ‘জাতিয় সমাজতন্ত্র’ ‘জাতিদাম্ভিক ঐক্য’ ইত্যাদি ভাবধারা প্রচারের সর্বপ্রকার মাধ্যম গ্রহণ করে।[৪]

ফ্যাসিবাদের আক্রমণ যখন নিজ দেশে তৈরি হয় তখন তা সাম্প্রদায়িকতার রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। ফ্যাসিবাদের আক্রমণ কেবল নিজ দেশে সীমাবদ্ধ থাকে না। বর্বরতা, অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও উগ্র জাতিয়তাবাদ দ্বারা সংকটের সমাধান করতে না পেরে ফ্যাসিবাদ অপর জাতি ও দেশকে আক্রমণ করতে শুরু করে। দেশের মানুষের দৃষ্টিকে এভাবে অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে বাইরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়। ভারতের জনগণ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার শত্রু, ফ্যাসিবাদের পৃষ্ঠপোষক দল কংগ্রেসের ভেতরে এইসব প্রবণতা বহুবার দেখা গেছে এবং এসব থেকেই এই দলটি জন্ম দিয়েছে উগ্র স্বৈরাচারী দল বিজেপিকে।

ফ্যাসিবাদিরা মুলত তাদের ভিত্তি খুঁজে পায় পেটি-বুর্জোয়া জনতার মধ্যে যা বড় পুঁজির আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদের যুগে পেটি-বুর্জোয়ার জন্য সমাজতন্ত্র ভিন্ন অন্য কোনো রাস্তা খোলা থাকে না। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা যদি একটি দেশে ক্ষয়িষ্ণু হয় বা একেবারেই না থাকে তাহলে সাম্রাজ্যবাদের যুগে পেটি-বুর্জোয়ারা ফ্যাসিবাদিদের সমর্থন করে। এ বিষয়ে লিও ত্রতস্কি লিখেছেন,

পেটি-বুর্জোয়ার অসন্তোষ, ক্রোধ এবং হতাশাকে ফ্যাসিবাদিরা বিপথগামী করে বড় পুঁজির থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় আর শ্রমিক শ্রেণির বিরুদ্ধে পরিচালনা করে। এটা বলা যেতে পারে যে ফ্যাসিবাদ তার চরমতম শত্রুকে নির্মূল করার জন্য পেটি বুর্জোয়াকে ব্যবহার করে। এইভাবে বড়পুঁজি মধ্য শ্রেণিগুলোকে ধ্বংস করে এবং তারপর ভাড়াটে ফ্যাসিস্ট জননেতাদের সাহায্যে হতাশাগ্রস্ত পেটি বুর্জোয়াকে উদ্দিপ্ত করে শ্রমিকশ্রেণিকে আঘাত করার জন্য। বুর্জোয়া ব্যবস্থা কেবলমাত্র এই ধরনের ঘাতক পদ্ধতির সহায়তায় টিকে থাকতে পারে, কিন্তু কতক্ষণের জন্য? যতক্ষণ না প্রলেতারিয় বিপ্লব তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।[৫]

অর্থাৎ সমাজতন্ত্রীদের বিজয়ের উপরই নির্ভর করে ফ্যাসিবাদের পরাজয়। সমাজতন্ত্রীরা যত পেছনে হটবে ফ্যাসিবাদিরা তত এগুবে।[৬] ২০০৭-৮ সালের পুঁজিবাদী অর্থনীতির মন্দার পরে ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদী দলগুলো শক্তিশালী হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে ইউরোপের সাম্যবাদী দলগুলোর সুবিধাবাদের কাছে আত্মসমর্পণ। ফ্যাসিবাদি আদর্শের স্থায়ী উচ্ছেদ সমগ্র পৃথিবীতে দেশে দেশে সমাজতন্ত্র অভিমুখী বিভিন্ন বিপ্লবগুলো ছাড়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন পুঁজিবাদি দেশ সংকট থেকে পরিত্রাণের শেষ উপায় হিসেবে এখনো ফ্যাসিবাদি চরিত্র গ্রহণ করার চেষ্টা করে।

আরো পড়ুন:  ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য দিমিত্রভ থিসিসের গুরুত্ব

ফ্যাসিব্যাদের যেসব বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে সেগুলো সরাসরি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক। ফ্যাসিবাদের সাধারণত একটি সাধারণ শত্রু থাকে। দেশের সব সমস্যার জন্য একটি সাধারণ শত্রুকে জনতার সামনে উপস্থিত করা হয়। যেমন হিটলারের দেশে সাধারণ শত্রু হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল ইহুদিদের। একুশ শতকে ইউরোপের দেশে দেশে উল্লেখ করা হয় অভিবাসীদের, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ফ্রান্সে উল্লেখ করা হয় মুসলমানদেরকে। বিশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উল্লেখ করা হতো কমিউনিস্টদের; সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থ খরচ করে নিজেরাই শত্রু হিসেবে লাদেন ও তালেবানকে তৈরি করে নেয়। তালেবানরা দুর্বল হলে আইএসকে তৈরি করে। এভাবেই ফ্যাসিবাদ দেশে দেশে নিজেরাই শত্রু তৈরি করে জনগণকে ধোঁকা দেয়। এমনকি ফ্যাসিবাদে কোনো কোনো সময় অন্য সংখ্যালঘু জাতিদেরকেও দেখানো হতে পারে সাধারণ শত্রু হিসেবে। ফ্যাসিবাদে বিভিন্ন জাতিসমূহের সমান বিকাশকে হত্যা করা হয়।

ফ্যাসিবাদে সামরিক প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে চরম গুরুত্ব প্রদান করা হয়। তারা সামরিক শক্তির উপর প্রাধান্য দেয় সব সময়, এমনকি দুর্যোগের সময়েও সামরিক শক্তিকে প্রাধান্য দেয়। জাতীয় বাজেটের মূল অংশটা যায় সামরিক খাতে। সামরিক সেবাকে মহত পেশা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফ্যাসিবাদিরা জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে আহাজারি করে। জাতিয় নিরাপত্তা লঙ্ঘন নিয়ে ফ্যাসিবাদ নানা সময়ে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। সময়ে সময়ে অন্য ধর্মীদের দ্বারা বা শত্রু রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার জুজু ও কল্পকাহিনী তৈরি করে। সারা দুনিয়ার আমলাতন্ত্র তাদের শক্তি বৃদ্ধি ও জনগণকে শোষণ ও নিপীড়ন করার জন্য এই ভয় জাগিয়ে তোলে। ভারত-পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনবরত পারস্পরিক বিদ্বেষ ছড়ায়। একই ভাবে সব সাম্রাজ্যবাদী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই কাজ প্রতিদিন করে।

ফ্যাসিবাদে ধর্ম আর রাষ্ট্রের মাখামাখি থাকে। ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্র ও সরকার দেশের প্রধান ধর্মটি নিয়ে অন্যান্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিনিয়ত বিদ্বেষ, ঘৃণা, আক্রোশ সৃষ্টি করে। ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালায়। রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মীয় অনুভূতি, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্মীয় আইন ইত্যাদি নিয়ে সব সময় জনতার মধ্যে বিতর্ক ও কুতর্ক চালাতে থাকে এবং রাষ্ট্রের সমস্যাগুলো থেকে জনতার চিন্তাকে ধর্মের দিকে কেন্দ্রিভূত রাখে। ফ্যাসিবাদী এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের লোককে অনবরত ঘৃণা করে এবং অন্যের ধর্মকেই সমস্ত সমস্যার মূলে উপস্থাপন করে।

ফ্যাসিবাদ কর্পোরেটদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়। সকল ফ্যাসিবাদী সরকার কর্পোরেটদের কাছ থেকে সহায়তা নেয় এবং পুঁজিবাদিদের ও ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। এ-প্রসঙ্গে বেনিতো মুসোলিনির উক্তিটি স্মরণযোগ্য। তিনি বলতেন,

“ফ্যাসিবাদকে আরো যথাযথভাবে কর্পোরেটবাদ বলা উচিত কারণ ফ্যাসিবাদ হচ্ছে রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট শক্তির একত্রীকরণ।”

ফ্যাসিবাদ প্রধানত উগ্র জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবাদী শ্লোগান, গান, চিহ্ন ব্যবহার করে থাকে। এটি মানবাধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। এটি সবসময় শ্রমিকদের ক্ষমতা সীমিতকরণে মনোযোগ দেয় এবং শ্রমিকদের ক্ষমতা খর্ব করে। এই মতবাদ বুদ্ধিজিবিতা ও শিল্পকর্মের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা প্রদর্শন করে। এই মতবাদের সমর্থকেরা অপরাধ ও শাস্তি নিয়ে মাত্রাধিক আগ্রহ প্রকাশ করে এবং অপরাধীদের অতিমাত্রায় শাস্তি দিতে চায় কিন্তু অপরাধের মূলোতপাটন করতে চায় না। অপরাধ যে সামাজিক বৈষম্যের কারণেই উদ্ভুত হয় এ-সত্য তারা মানে না। ফ্যাসিবাদীরা অবাধ স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। তারা সর্বদাই নির্বাচনে কারচুপি করতে চায়। তারা প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয় এবং নিয়ন্ত্রিত রেখে প্রচারমাধ্যমকে চালায়। ফ্যাসিবাদে লিংগবৈষম্য বিরাজমান। এটি পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারি।

আরো পড়ুন:  যে বোকা বুড়োটি পাহাড় সরিয়েছিলেন

১৯৪৫ সালে বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব ক্ষয়-ক্ষতি ও জীবন বিনাশের পরে ফ্যাসিবাদী শক্তি সাময়িকভাবে পরাভূত হয়। ফ্যাসিবাদী আদর্শের স্থায়ী উচ্ছেদ সমগ্র পৃথিবীতে সামাজিক বিপ্লব ব্যতীত সম্ভব নয়। বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশ সংকট থেকে পরিত্রাণের শেষ উপায় হিসাবে এখনো ফ্যাসিবাদী চরিত্র গ্রহণ করার চেষ্টা করছে।[৪]

তথ্যসূত্রঃ

১. দেখুন; Sofia Kholod; What is What? A Concise Dictionary of Social and Political Terms.
২. জর্জি দিমিত্রভ; The Fascist Offensive and the Tasks of the Communist International in the Struggle of the Working Class against Fascism; Main Report delivered at the Seventh World Congress of the Communist International. সেই রিপোর্টের ইংরেজি বাক্যগুলো দেয়া হলও।

Fascism in power was correctly described by the Thirteenth Plenum of the Executive Committee of the Communist International as the open terrorist dictatorship of the most reactionary, most chauvinistic and most imperialist elements of finance capital.

The accession to power of fascism is not an ordinary succession of one bourgeois government by another, but a substitution of one state form of class domination of the bourgeoisie — bourgeois democracy — by another form — open terrorist dictatorship.
২. রম্যাঁ রলাঁ; শিল্পীর নবজন্ম; সরোজকুমার দত্ত অনূদিত; অগ্রণী বুক ক্লাব; কলকাতা; অষ্টম মুদ্রণ, ২০০০; পৃষ্ঠা ২২৪।
৩. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান;
৪. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ, প্যাপিরাস, ঢাকা; পঞ্চম সংস্করণ, ২০০৬ পৃষ্ঠা ১৬৮-১৬৯।
৫. লিও ট্রটস্কি; ফ্যাসিবাদ কি এবং কিভাবে প্রতিরোধ করিতে হইবে; কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি; কলকাতা, প্রথম বাংলা অনুবাদ সংস্করণঃ ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৩।
৬. দেখুন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী; রাষ্ট্র কল্পলোক; বিদ্যাপ্রকাশ ঢাকা; প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১ পৃষ্ঠা-৭০।

রচনাকাল ১ মার্চ, ২০১৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!