ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য দিমিত্রভ থিসিসের গুরুত্ব

ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে দিমিত্রভ থিসিসের গুরুত্ব রয়েছে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে জর্জি দিমিত্রভ একটি সুপরিচিত নাম। মানব ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে জর্জি দিমিত্রভ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বা কমিন্টার্নের নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে সােভিয়েত রাশিয়ার অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধি, শ্রম ও পুঁজির মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরােধ এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাের সাথে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশ দেশগুলাের জাতিসমূহের ক্রমবর্ধমান বিরােধ সারা দুনিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনে তরঙ্গ প্রবাহ সৃষ্টি করে। শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রবল ঊর্ধ্বগতির যুগ।

বিপ্লবী আন্দোলনের সেই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে জাতিসমূহের অর্জিত সকল বিপ্লবী, গণতান্ত্রিকপ্রগতিশীল অগ্রগতির এবং জাতীয় স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জার্মানী, ইতালীসহ বিভিন্ন দেশে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষমতা দখল করে। এর পরিণতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শান্তি ও গণতন্ত্রের পক্ষে শ্রমিক শ্রেণি ও সকল স্তরের শান্তিকামী জনগণকে একত্রিত করার সংগ্রামের ঐতিহ্যের সাথে এক অটল ও দুঃসাহসী যােদ্ধারূপে জর্জি দিমিত্রভ চিরকাল আদর্শস্থানীয় ও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৯৮২ সালের ১৮ই জুন সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি, প্রগতিশীল ও শান্তিপ্রিয় জনগণ এই মহান নেতার শততম জন্মদিন পালন করে।

গরীব টুপী সেলাইয়ের দর্জি পিতার সন্তান জর্জি দিমিত্রভ, মাত্র ১২ বছর বয়সে ছাপাখানার কম্পােজিটার হিসাবে ধর্মঘট আন্দোলনে যোগদান করেন। অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় তিনি ছিলেন ৩৫ বছরের যুবক। এই যুবক বয়সেই তিনি তৎকালীন বামপন্থী সােশ্যালিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্য, জাতীয় ট্রেড ইউনিয়নের সম্পাদক এবং পার্টির পার্লামেন্টারী গ্রুপের সম্পাদক হিসাবে বুলগেরিয়ার শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতী জনতার সুযােগ্য ও জনপ্রিয় নেতা ও তাত্ত্বিক হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ১৯১৯ সালে বুলগেরিয়াতে প্রকৃত শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা জর্জি দিমিত্রভ প্রতিষ্ঠা কংগ্রেসেই পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নির্বাচিত হন।

প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধোত্তরকালের প্রথম দিককার বছরগুলােতে সারা পৃথিবী জুড়ে বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ারের সময় ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বুলগেরিয়ার রাজতন্ত্রী ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব উচ্ছেদের সশস্ত্র অভুখান সংঘঠিত হয়। ইতিহাসে এই অভ্যুত্থান কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে প্রথম ফ্যাসিস্টবিরােধী অভ্যুত্থান বলে পরিচিত। এই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ও তাত্ত্বিক হিসাবে দিমিত্রভ অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন। অভ্যুত্থানে পরাজিত হবার পরপরই তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।

১৯২৪ সালের শুরু থেকেই পুঁজিবাদী অর্থনীতি সংকটাবস্থা কাটিয়ে উঠে উন্নয়নের পর্যায়ে উপনীত হয় এবং ১৯২৮ সাল পর্যন্ত পুঁজিবাদী অর্থনীতি সাময়িকভাবে স্থিতি লাভ করে। এই বছরগুলােতে সােভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। এই পটভূমিতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের আদর্শগত ও সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও শক্তিবৃদ্ধির কর্মপন্থা গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ১৯২৫ সালের শরৎকালে জর্জি দিমিত্রভ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নির্বাহী কমিটির স্টাফ হিসাবে মনােনীত হন। ১৯২৯ সালে তিনি যুগােশ্লোভিয়া, রুমানিয়া, গ্রীস, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে গঠিত বলকান কমিউনিস্ট ফেডারেশনের রাজনৈতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।

আরো পড়ুন:  ফ্যাসিবাদ হচ্ছে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট শক্তির একত্রীকৃত রূপ

১৯২৯ সাল থেকেই পুঁজিবাদী দুনিয়ার অর্থনৈতিক সংকট আবার তীব্রতর হতে থাকে। এই সংকট ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত চলে। এই বছরগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সােভিয়েত জনগণ প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করে। এই সময়কালে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ এই দুই সমাজব্যবস্থায় পৃথিবীর বিভক্তি ও তাদের পরস্পরবিরােধী সংগ্রাম তীব্রতর হয়। পুঁজিবাদের সংকট ও সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রার পটভূমিতে একদিকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশসহ ঔপনিবেশিক দেশসমূহে বিপ্লবী জোয়ার দেখা দেয়, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের শত্রুভাবাপন্ন শক্তিরূপে ফ্যাসিস্টদের আবির্ভাব ঘটে। ১৯৩২ সালের শুরুতে জার্মানীর লগ্নিপুঁজির প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো ফ্যাসিবাদী হিটলারকে ক্ষমতায় বসায় এবং ইতিহাসের এক কলংকময় অধ্যায়ের সূচনা করে।

হিটলারের ক্ষমতা দখলের সময়ে জীবনের নিরাপত্তার অভাবকে উপেক্ষা করে দিমিত্রভ ফ্যাসিবাদবিরােধী ইউরােপীয় শ্রমিকদের কংগ্রেসের প্রস্তুতিমূলক কাজে জার্মানীতে ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই নাৎসিদের দ্বারা প্ররোচিত জার্মানীর পার্লামেন্ট ভবন রাইখস্টাগে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে উপলক্ষ করে জার্মানীর কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের সাথে দিমিত্রভকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রাইখস্টাগ অগ্নিকাণ্ড মিথ্যা মামলার আসামী হিসাবে দিমিত্রভ নির্ভিকভাবে ফ্যাসিবাদের বর্বর নৃশংসতা ও সন্ত্রাসবাদী নীতির মুখােশ খুলে দেন এবং তর্কাতিতভাবে প্রমাণ করেন যে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত প্রতিহিংসা গ্রহণ, দেশে সন্ত্রাস ও পরিকল্পিত নরহত্যার শাসন কায়েম করার উদ্দেশ্যেই নাৎসিরা রাইখস্টাগ অগ্নিকাণ্ড সংঘঠিত করেছে। দিমিত্রভ আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্ট, সােশ্যাল ডেমােক্র্যাটসহ সকল স্তরের শান্তিকামী ও গণতন্ত্রী মানুষকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহবান জানান। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির যুক্তফ্রন্ট ও সকল স্তরের মানুষের গণফ্রন্ট গঠনের তাত্ত্বিক ভিত্তি তিনি মামলা চলাকালীন সময়েই উত্থাপন করেন।

১৯৩৪ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে সংগ্রাম আরাে তীব্রতা লাভ করে। একদিকে সােভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নব নব সাফল্য অর্জন করে, অন্যদিকে পুঁজিবাদী দেশগুলােতে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়ার আক্রমণ জোরদার হয়। এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ১৯৩৪ সালের এপ্রিলে দিমিত্রভ আন্তর্জাতিকের নির্বাহী কমিটির রাজনৈতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের মাসেই তিনি আন্তর্জাতিকের নির্বাহী কমিটির সভাপতিমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির এই জটিল ও সংকটজনক মুহূর্তে কমিন্টার্নের মূল কাজ হয়ে দাড়ায় ফ্যাসিবাদের আক্রমণ ও যুদ্ধের ভয়াবহ বিপদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণি ও শান্তিকামী জনগণকে একত্রিত করা। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকের সেকেলে কৌশলগত পথনির্দেশগুলোকে পরিবর্তন করে নতুন পথনির্দেশ প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। এই যুগসন্ধিক্ষণে আন্তর্জাতিকের কাজে জর্জি দিমিত্রভ এক উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯৩৫ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। জর্জি দিমিত্রভ তার বিপুল সৃজনশীল প্রতিভা ও শ্রম দিয়ে আন্তর্জাতিকের অন্যান্য নেতাদের সহযােগিতায় এই কংগ্রেসের অন্যতম মূল রিপাের্টে ফ্যাসিবাদের আক্রমণ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যগঠনের সংগ্রামে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দায়িত্ব প্রণয়ন করেন। রিপাের্টটি তিনিই কংগ্রেসে উত্থাপন করেন এবং রিপাের্টের উপর উত্থাপিত প্রশ্নসমূহের জবাব দেন। এই রিপাের্টের উপর ভিত্তি করেই ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির যুক্তফ্রন্ট এবং ব্যাপক গণফ্রন্ট গঠনের তত্ত্ব সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। এই কংগ্রেসেই তিনি আন্তর্জাতিকের সাধরেণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

আরো পড়ুন:  ফ্যাসিবাদ কাকে বলে এবং কেন ও কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে

আন্তর্জাতিকের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে জর্জি দিমিত্রভ শান্তির পক্ষে ফ্যাসিস্ট যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট ও সােশ্যালিস্ট শ্রমিকদের নিয়ে শ্রমিক শ্রেণির যুক্তফ্রন্ট এবং ব্যাপক ভিত্তিতে গণফ্রন্ট গঠনের বাস্তব কাজে উদ্যোগী হন। তা সত্ত্বেও ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর হিটলারের পােল্যাণ্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। মানব ইতিহাসের এই কঠিন, জটিল ও বিভীষিকাপূর্ণ দিনগুলােতে দিমিত্রভের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিকের তৎপরতার মধ্য দিয়ে দেশে দেশে শান্তিকামী, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিকদের একত্রিত করা সম্ভবপর হয়। এর ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন দেশে, ফ্যাসিবিরোধী প্রতিরােধ আন্দোলন জোরদার হয় এবং কমিউনিস্ট প্রতিরােধ আন্দোলনের উদ্যোক্তা, সাংগঠনিক পরিচালক হিসাবে নেতৃত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধোত্তরকালে পূর্ব ইউরােপের একগুচ্ছ দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের এই অবস্থান গ্রহণের ফলেই সম্ভবপর হয়।

ফ্যাসিস্ট জার্মানীর পতনের মুখে ১৯৪৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর বুলগেরিয়ার শ্রমজীবী জনগণ ফাদারল্যাণ্ড ফ্রন্টের নেতৃত্বে রাজকীয় ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ববাদী শাসকদের উচ্ছেদ করে সমাজতান্ত্রিক বুলগেরিয়া প্রতিষ্ঠা করে। ফাদারল্যাণ্ড ফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে দিমিত্রভের যুক্তফ্রন্ট ও গণফ্রন্টের তত্ত্ব বাস্তব রূপ লাভ করে। ফাদারল্যাণ্ড ফ্রন্টের নেতা হিসাবে ২২ বৎসর দেশান্তরী জীবন কাটানাের পর দেশে ফিরে এসে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জর্জি দিমিত্রভ সমাজতান্ত্রিক বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার সুযােগ্য নেতৃত্বেই বুলগেরিয়ার শ্রমিক শ্রেণি সমাজতন্ত্রের ভিত্তি সৃষ্টি করে। ১৯৪৯ সালের ২রা জুলাই জর্জি দিমিত্রভ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের সুযােগ্য উত্তরসুরী, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম তাত্ত্বিক ও সংগঠক, সমাজতান্ত্রিক বুলগেরিয়ার স্থপতি জর্জি দিমিত্রভের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আসছে সারা দুনিয়ার সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীগণ। দিমিত্রভের সৃষ্টিশীল তাত্ত্বিক কীর্তি আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে উথাপিত ‘ফ্যাসিবাদের আক্রমণ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য সংগঠনের সংগ্রামে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দায়িত্ব’ বিষয়ে রিপোর্ট ও রিপাের্টের উপর আলােচনা করা সকল কমিউনিস্টদের একটি দায়িত্ব। দিমিত্রভের এই রচনাটি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো।

প্রথমত, এই রিপাের্টটি ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে। সকল বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তির সংগ্রামের বিকাশের জন্য এবং শ্রমিক শ্রেণি ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগতির জন্য মৌলিকভাবে ও ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদবিরােধী আন্দোলনে শান্তি ও গণতান্ত্রিক কর্তব্য সম্পাদনের জন্য শ্রমিক শ্রেণির যুক্তফ্রন্ট ও ব্যাপক গণফ্রন্ট মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করেছে। মতাদর্শগত ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব এক নতুন সংযােজন বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই রিরাের্টটি বিপ্লবী দিমিত্রভের সৃষ্টিশীল তাত্ত্বিক কীর্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ বলে থাকেন যে বিপ্লবী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা কেবল ইতিহাসের বিষয় মাত্র। তারা সাধারণত সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থনৈতিক জীবনের দ্রুত পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে বলেন যে শ্রেণি সংগ্রামের অগ্রগতির জন্য সর্বদা সম্পূর্ণ নতুন তত্ত্বকথার প্রয়োজন। এর বিপরীতে কমিউনিস্টরা মনে করে যে বিপ্লবী আন্দোলনের অভিজ্ঞতাই হচ্ছে তত্ত্ব। এই কথাটিই এই রিপাের্টে জর্জি দিমিত্রভ সুন্দর করে উল্লেখ করে বলেছেন যে, বিপ্লবী তত্ত্ব হলো বিপ্লবী আন্দোলনেরই সাধারণীকৃত সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা। প্রকৃতপক্ষেই রিপাের্টটি হচ্ছে বিপ্লবী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত এক জীবন্ত তত্ত্ব, যা কেবল পুঁথিগত বিষয় নয়, যা হচ্ছে কর্মসাধনের সহায়ক। তাই শ্রমিক শ্রেণির যুক্তফ্রন্ট, ব্যাপক গণফ্রন্ট ইত্যাদি তত্ত্ব উপস্থিত করার সাথে সাথে রিপাের্টে পার্টি, পার্টির করণীয়, ক্যাডার ইত্যাদি বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে। রাজনীতি কেবল বিজ্ঞান নয়, রাজনীতি আর্ট—এটা উপলব্ধির ক্ষেত্রে এই রিপাের্টটি সহায়ক বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

আরো পড়ুন:  মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে?

তৃতীয়ত, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলাের নীতি আন্তর্জাতিক উত্তেজনা যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জা ও অস্ত্র প্রতিযােগিতা আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট এবং যুদ্ধের বিপদ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি করেছে। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলাে পুঁজির শােষণ অব্যাহত রাখার জন্য দেশে দেশে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বকে অব্যাহতভাবে সাহায্য, উৎসাহ ও সমর্থন দিয়ে আসছে। এই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে শান্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জোরদার করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তির শক্তিবৃদ্ধির প্রশ্নে এবং প্রতিটি দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় সমাজতন্ত্রী, গণতন্ত্রী, ট্রেড ইউনিয়ন, ধর্মীয় মহল ও সকল শান্তিকামী-গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে কমিউনিস্টদের সহযােগিতা অপরিহার্য। তাই বর্তমান সময়ের জটিল ও ঝটিকাসঙ্কুল মুহূর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালপর্বে যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শান্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য বিশ্বের শান্তিকামী জনগণকে উৎসাহিত ও আলাের পথ দেখায়।

এইসব দিক বিবেচনায় রেখে প্রকাশিত এই দিমিত্রভের এই লেখাটি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাভাষী প্রগতিশীল, গণতন্ত্রী ও শান্তিকামী পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে বলে আমরা আশা করি। লেখাটি পড়তে পারবেন এই লিংক থেকে ‘ফ্যাসিবাদের আক্রমণ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্য সংগঠনের সংগ্রামে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দায়িত্ব’।

তথ্যসূত্র:

১. জর্জি ডিমিট্রভ, অনুবাদক অজানা, ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রাম ও যুক্তফ্রন্ট প্রসঙ্গে, জর্জি ডিমিট্রভের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত, প্রাচ্য প্রকাশনী, ঢাকা, জুন ১৯৮২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!