ইসলামী রাষ্ট্র এমন রাষ্ট্র যেখানে ইসলামী আইনের উপর ভিত্তি করে সরকার রয়েছে

ইসলামী রাষ্ট্র (ইংরেজি: Islamic state) হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে ইসলামী আইনের উপর ভিত্তি করে একটি সরকার রয়েছে। একটি শব্দ হিসাবে, এটি ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহাসিক রাজনীতি এবং শাসনের তত্ত্ব বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়েছে।[১] আরবি শব্দ দাওলাহ ইসলামিয়াহ (আরবি: دولة إسلامية) এর অনুবাদ হিসাবে এটি রাজনৈতিক ইসলাম (ইসলামবাদ) এর সাথে যুক্ত একটি আধুনিক ধারণাকে বোঝায়।

ইসলাম ধর্মের উত্থানের পিছনে ধর্মীয় আন্দোলনের চেয়ে রাজনৈতিক আবেদনই ছিল বেশি। ইসলামের ইতিহাসের গোড়ায় ছিল আরব মরুভূমির বিভিন্ন বেদুইন জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার হৃদয়স্পর্শী আহ্বান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকার গোত্রভিত্তিক বা গোষ্ঠীভিত্তিক জনপদগুলি ভগ্নপ্রায় প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থা থেকে বেঁচে ওঠার তাগিদে এই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় একেশ্বরবাদী পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হয়।

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ও ইসলামি রাষ্ট্র সমার্থক নয়। ইসলাম ধর্মের বন্ধনে আরবের বিভিন্ন গোত্র ভিত্তিক গোষ্ঠী একটি রাষ্ট্রে সমন্বিত হয়। তার শীর্ষে বিরাজ করেন ঈশ্বর আল্লাহ এবং তাঁর প্রতিভূ পয়গম্বর হজরত মহম্মদ। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পার্থিব ও পারলৌকিক ক্ষমতার একই দেহে অদ্বৈত অবস্থান। ধর্মীয় ক্ষমতা ব্যতিরেকে রাষ্ট্র অর্থহীন, আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবিহীন ধর্ম অবাস্তব। ইসলামে আধুনিক ইউরোপীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মতো রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক নয়। যথার্থ ইসলামি রাষ্ট্রে বহুত্ববাদ অচল, যদিও শোষণ স্বাভাবিক।

ইসলামে আল্লাহই (সমার্থে: ঈশ্বর) হলেন আইনের স্রষ্টা। মহম্মদের কাছে আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট যাবতীয় আইন কোরানে লিপিবদ্ধ হয়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রামাণ্য উৎস হলো দিব্যবিধান হিসেবে রচিত কোরানের ভাষ্য শরিয়ত এবং সুন্নাহ যা মোহাম্মদের ব্যবহারিক জীবনে স্থাপিত অনুসরণীয় আদর্শ দৃষ্টান্ত। আইনকানুনের বৈধতা কোরানের উপর নির্ভরশীল। কাজেই আইনের প্রামাণ্য কর্তৃত্ব পরমবাদ সম্পন্ন।

স্বয়ং মোহাম্মদ ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে তার রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেন। ইসলামী যাজকতন্ত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনও প্রভেদ নেই, বরং অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ও অভিন্ন। যাজকীয় রাষ্ট্র ক্রমে রাষ্ট্রীয় যাজকতন্ত্রে পরিণত হয়। আদিপর্বে ইসলামি রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ও কেন্দ্রীভূত শক্তি ও ক্ষমতা খলিফার উপর নাস্ত থাকত। খলিফা ছিলেন কার্যনির্বাহি অধিকর্তা, আইনকে রূপায়িত করাই তাঁর কাজ। খলিফা কিন্তু সার্বভৌম ছিলেন না। খলিফা পয়গম্বর হজরত মহম্মদের উত্তরাধিকারী। স্বভাবত পয়গম্বরের অবর্তমানে বংশানুক্রমে এক একজন খলিফাই হন জনগণের পার্থিব ও পারলৌকিক বিষয়াদির অধিকর্তা। ইসলামি আইনবিদরা উত্তরকালে ‘ইমাম’ পদের সৃষ্টি করেন, যিনি মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও জাগতিক ক্রিয়াকর্মের ধর্মগুরু।

উল্লেখ্য, খলিফার ক্ষমতা ও খিলাফতি রাজত্ব নিয়ে পরবর্তীকালে দ্বন্দ্ব বাধে এবং ধর্মের ভিত্তিতেই একাধিক খলিফার রাষ্ট্রধারা বিরাজ করে। একাধিক খলিফার অস্তিত্ব কিন্তু ইসলামের শাস্ত্রবিরোধী। প্রাদেশিক রাজশক্তির অধিকারী সুলতানেরা স্বাধীনভাবে মাথা চাড়া দেন। পরিণামে ধর্মের ক্ষেত্রেই কেবল খলিফাদের প্রাধান্য থাকে। সুলতানেরা তাবশ্য উলেমাদের পরামর্শে চলতেন। সর্বশেষ খলিফাদের মূলােচ্ছেদ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্ক।

আদিপর্বে ইসলামী রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কোনও ভুখণ্ডের প্রশ্ন ছিল না। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রত্যয়ে ভূখণ্ডের প্রয়োজন নেই। এর কারণ সম্ভবত গোড়ার দিকে এক একটি গোত্রভিত্তিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত আরবেরা সাধারণত যাযাবরের জীবনযাপন করত। তখনও সেখানে কৃষিনির্ভর সভ্যতার প্রচলন হয়নি। তাই ভূখণ্ডের প্রশ্ন রাষ্ট্রীয় প্রত্যয়ে অনুপস্থিত। সেই নিরিখে হাল আমলে প্যালেস্তাইন নামে ভূখণ্ডবিহীন যে-রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে যার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইয়াসের আরাফত, তার যৌক্তিকতা আছে। সংগঠিত আরব রাজনীতিকে এক ধরনের অর্থনৈতিক সমবায়ী সংঘ হিসেবে দেখা হতো। তাতে রাষ্ট্র, যাজকতন্ত্র ও সমবায়ী সংঘের এক ত্রিত্ব (trinity) গড়ে ওঠে। ইসলাম প্রকৃতপক্ষে একটি সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী (totalitarian) সত্তা। আধুনিক রাষ্ট্রের মতো ইসলামি রাষ্ট্রপ্রত্যয়ে ক্ষমতার পৃথকীকরণের অবকাশ নেই।

ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষের অধিকারের প্রশ্ন উপেক্ষিত। আধুনিক সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রের মতো ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্য আছে। কোরানে আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট আইন ও নির্দেশাবলি কেউ অমান্য করলে তার ধ্বংস অনিবার্য। সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী রাষ্ট্রের মতোই ইসলামি রাষ্ট্রপ্রত্যয়ে বলা হয় যে ঈশ্বরই হলেন আইনের স্রষ্টা; ঐশী বিধানের উত্তরণ বা বিপক্ষতা চলে না। ইসলামি বিধিব্যবস্থায় আইনই ধর্ম এবং ধর্মই আইন। কারণ উভয়ের উৎস একই, সেখানে প্রত্যাদেশই বড় কথা, বিবেকের স্থান নেই।

আল্লাহর কাছে মানুষ নির্বিশেষে সবাইকার মর্যাদা সমান এবং সমাজের সর্বাত্মক সাম্য স্বীকৃত কিন্তু স্বাধীনতার স্থান শূন্য। ইসলামী গণতন্ত্র হলো সাম্যের ও মৈত্রীর, স্বাধীনতার নয়। সেদিক থেকে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সুস্পষ্ট। ইসলামী রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ সাম্য ও অর্থনৈতিক সমতাবিধানের জন্য কোরানে সবাইকে বায়-তুল-মাল নামক রাজকোষে বাধ্যতামূলকভাবে জাকাত (দান) দেবার এক ধরনের কর-ব্যবস্থা আছে, যার উপকারিতার অধিকারী হলো সমগ্র সমাজ (উম্মা)। বস্তুত ইসলামী গণতন্ত্র হলো সামাজিক, রাজনৈতিক নয়।

ইসলামী আইন যেহেতু আল্লাহর প্রত্যাদিষ্ট, সেই কারণে অপরিবর্তনীয়। পরিবর্তনশীল সমাজকে ইসলামি আইনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। রদবদল চলে না। উল্লেখ্য, কোরানে অন্তর্ভুক্ত সব কিছুই সঠিক অর্থে আইন নয়। যা কিছু করণীয় তার সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে, কিছু বিষয়ের উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। এই দুটির মাঝামাঝি অনেক কিছুর সুপারিশ, পন্থা, পদ্ধতি ও প্রবণতাকে অনুমোদিত অথবা নামঞ্জুর করা হয়েছে। শাস্তির ব্যবস্থা হিসেবে প্রায়শ্চিত্ত, লঘুদণ্ড থেকে শুরু করে অঙ্গচ্ছেদ ও প্রাণদণ্ডের শাস্ত্রীয় বিধান আছে।

ইসলামের এই পূর্বনির্ধারিত ও অপরিবর্তনীয় দিব্য বিধিব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুলতানেরা প্রয়ােজন অনুসারে কিছু কিছু নববিধান প্রবর্তনের প্রয়াসী হন। তার মূল কারণ আরবভূমি ছাড়িয়ে ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহু দেশে বিস্তৃত হয়। মালিকী, শাফঈ, হাম্বলি প্রভৃতি ‘ফিকাহ’ আইনে সংশোধনের প্রচেষ্টা হয়। কালক্রমে ইসলামি শাসনব্যবস্থায় এখনকার মতো জুরি (মুফতি), বিচারক (কাজি), প্রধান বিচারপতি (শেখ-উল-ইসলাম), দিব্য আইনজ্ঞ (উলেমা), ধর্মীয় আদেশ (ফতোয়া), বিদগ্ধজনের নির্দেশ (ইজমা) ইত্যাদির প্রচলন ঘটে। কাজির সিদ্ধান্ত থেকে অথবা ভিন্ন বিচারে প্রদত্ত রায়ের দৃষ্টান্তে নতুন আইন রচনার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। পয়গম্বরের উপদেশাবলি, বাণী কিংবা তাঁর অনুসৃত বিধিব্যবস্থার প্রথা বা ধারা (সুন্নাহ) যেগুলি তাঁর বিশ্বস্ত সহচরেরা হাদিস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন সেগুলি অবশ্যই যাবতীয় বিধিবিধানের মানদণ্ড।

মধ্যযুগে ইসলামী ধারায় কয়েকজন রাষ্ট্রদার্শনিক গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় প্রভাবিত হন। তাঁরা প্লেটো, এরিস্টটল ও নব্যপ্লেটোনীয়দের রচনাদি ভাষ্যসহ অনুবাদ করেন। তাঁরা গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে ইসলামি দিব্যবিধানের সঙ্গতিস্থাপনের চেষ্টা করেন। তবে মুসলিম তাত্ত্বিকেরা আইনকানুনকে শুধু ইহজগতেই নয়, পরলোকেও প্রয়োগ করেন। কাজেই তাঁদের আদর্শ রাষ্ট্র মানুষের জাগতিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতিহীন হয়ে পড়ে। অন্যতম ব্যতিক্রম ছিলেন ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রি), যিনি রাষ্ট্রকে ঐহিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে দেখেন, যেখানে এক একটি রাজবংশ রাজত্ব চালায়। রাজবংশ সংক্রান্ত তত্ত্বে তিনি দেখিয়েছেন যে এক একটি রাজবংশ চল্লিশ বছর ধরে মোট তিনটি প্রজন্মে শাসনে অধিষ্ঠিত থাকে। রাজত্বের উত্থান ও পতন সম্পর্কেও তিনি তিন ধরনের রাষ্ট্রের কথা বলেছেন: ১. ইসলামী দিব্যতন্ত্র, ২. তারই সমগ্রোত্রীয় রাষ্ট্র যেটা অনেকাংশে যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ৩. দার্শনিকদের কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র। খালদুনের রাষ্ট্রচিন্তায় আইনশাস্ত্রের একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উৎপাদন ও কর নির্ধারণ চিন্তার সমন্বয় দেখা যায়।

সাম্প্রতিক কালের ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তায় ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে আধুনিক ভাবনাচিন্তার সংমিশ্রণ দেখা যায়। কামাল আতাতুর্ক খলিফার অধীন সুলতানি শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে তুরস্কে আধুনিক রাষ্ট্রের পত্তন করেন। শিক্ষা, প্রশাসন ও আইনগত সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলেন। বিবাহবিধির সংস্কার, নারীদের বােরখা পরিধান বর্জন থেকে শুরু করে তুরস্ক ভাষায় রোমান লিপির প্রবর্তন পর্যন্ত বহুবিধ বিষয়ে তিনি আমূল পরিবর্তন সাধন করেন।[২]

চিত্র: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম যেসব রাষ্ট্রে সেরকম ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ (গাঢ় সবুজ), ইসলাম যেখানে রাষ্ট্রধর্ম (হালকা সবুজ), ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (নীল) এবং অন্যান্য (কমলা) দেখানো হয়েছে।

দ্রষ্টব্য: আল্লামা ইকবাল

তথ্যসূত্র:

১. Ayubi, Nazih N.; Hashemi, Nader; Qureshi, Emran (2009). “Islamic State”. In Esposto, John L. (ed.). The Oxford Encyclopedia of the Islamic World. Oxford: Oxford University Press.
২. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪৪-৪৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!