শিল্প মানেই লড়াই …

প্রশ্ন: একান্নর-পরবর্তী ঢাকা সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী?

উত্তর: ঢাকা এখন আগেরকার সরলতা খুঁজে পাচ্ছি না। এখন দেখছি আভিজাত্য চারদিক জাঁকিয়ে বসেছে। জীবন যখন বদলায়, মানুষও বদলায়। জীবন হচ্ছে বহতা নদীর মতো।

প্রশ্ন: নবজাত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে ঋত্বিক বাবু বলেছিলেন-

উত্তর: বিহারী পাঞ্জাবীরা আগে ডমিনেট করেছিল, বাঙালিরা সেই শেকড় এবং শেকল ভেঙেছে, কিন্তু আজো আমি ভিখিরি দেখেছি। ওরা হাত পাতে। তবে সমস্যা এখন অনেক সহজ। আপনাদের হাতে এবং সরকারের হাতে তা নিশ্চয়ই নির্মুল হবে। সমস্যা নেই, বাংলাদেশ স্বর্গে পরিণত হয়েছে, এমন ধারণা আমার অত্যন্ত কম। ঋত্বিকবাবু সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন। সমস্যা কোথায় নেই বলুন তো? কাজেই আপনারা আমাকে এই ধরনের প্রশ্ন না করে ফিল্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে তার মতামত কী?

উত্তর: বাংলাদেশের ছবি আমি তেমন দেখিনি। জহির রায়হানের জীবন থেকে নেওয়া, স্টপ জেনোসাইড এবং সুভাষ দত্তের আয়না ছবি তিনটি আমি দেখেছি। একটা হাতে গোনা ছবি দেখে তো আর মন্তব্য করা যায় না। তবে একটা জিনিস আমি বুঝেছি, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনে একটা বিরায় পরিবর্তন এসেছে। এখানকার তরুণদের দিয়ে কিছু হবে। কিন্তু আমরা? আমরা সব্বাই ডুবে যাচ্ছি। বসে যাচ্ছি।

প্রশ্ন: আমাদের সংক্রামিত হওয়াটার আশঙ্কা নেই তো?

উত্তর: সেটা আপনাদের হাতে। এখানে উপকরণ আছে। সম্ভাবনাও আছে। শিল্পের ব্যাপারে আমি হাততালি চাই না। বাঙালি জাতি মরে গেছে ভাবলেই বাঁচতে ইচ্ছে করে না। বাঙালির হৃদয়ে নবতর জাগৃতির জন্ম হয়েছে। দুঃখ-দুর্দশা থাকবে। থাকবে অভিযোগ। গ্রামে গঞ্জে রটে গেছে বাঙালি বলে একটা জাতি আছে। কলকাতার রকের ভাযায় ‘কাটেমাস কারবার’ করেছে বাঙালি। আমার বিশ্বাস, এপারের সংস্কৃতি, ওপারের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ নতুন ভাবে মোড় নেবে।

প্রশ্ন: এ ব্যাপারে আপনি কি কিছু ভাবছেন?

উত্তর: ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছুই ভাবছি, এ বাংলায় আমি কিছু করতে পারব কি না জানি না। আমি মনে করি, মানুষকে জানতে হলে জাগাতে হবে।

আরো পড়ুন:  চলচ্চিত্র সাহিত্য ও আমার ছবি

প্রশ্ন: বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের ছবির মধ্যে কোনো চরিত্রগত পার্থক্য রয়েছে কি না?

উত্তর: সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং তপন সিংহের ছবি সম্পর্কে ভাবা যেতে পারে। আর এপার বাংলা ছবি অত্যন্ত কাচা। তবে চিন্তাধারা স্বচ্ছ। এখানকার চিত্রনির্মাতাদের মনে ও ইচ্ছে রয়েছে তা বোঝা যায়। চলচ্চিত্র নির্মাদের ব্যাপারে টেকনিকটা হচ্ছে ভীষণ মূল্যবান। শুধু চিন্তাধারা দিয়ে তো আর ছবি হয় না। টাইম এবং কনটেন্ট সম্পর্কে চিত্রনির্মাতাকে সদাসচেতন থাকতে হবে।

প্রশ্ন: এপার বাংলায় ওপার বাংলার ছায়াছবির বাজার সম্প্রসারণ কি সম্ভব? আরো পড়ুন

উত্তর: বাজার সম্প্রসারণ সম্পর্কে আমার ভাবনার কোনো মূল্য নেই। আমি আমার মাতৃভূমিতে বেড়াতে এসেছি। দেখতে এসেছি।

প্রশ্ন: চলচ্চিত্র আপনি কাদের জন্য নির্মাণ করেন?

উত্তর: আমি মানুষের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাল করি। আইজেনস্টাইন, পুদভকিনও তাই করতেন। চলচ্চিত্রকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে দিতে হবে। ভ্যানে করে নিয়ে গিয়ে গায়ে গায়ে ছবি দেখানোর বন্দোবস্ত করতে হবে। বাংলাদেশের মা বোনেরা যাত্রাপালা পার্বণ দেখতে অভ্যস্ত। এক সময় যাত্রার মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হতো। এখন যাত্রার কর্মটাকে হৃদয়গম করতে হবে এবং সাধারণ মানুষের নাড়ী বুঝে চরিত্র সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামে গ্রামান্তরে ফ্যামিলি প্ল্যানিং কিংবা সরকারি প্ররোচণামূলক ছবি দেখালে চলচ্চিত্র শিল্পের কোনো উন্নতি হবে না। মশাই স্কুলে কি কবিতা শেখানো যায়? ভ্রাম্যমাণ ভ্যানের সাহায্যে চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় শুধু নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। অভ্যস্ত জীবনের ছবি আমি আমার সবগুলো ছবিতে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছি। আমি ছবি করে অর্থ বানাতে চাই না। আমি মিডিয়েট সাকসেস শিল্পের শেষ কথা নয়। কোন ছবি অর্থ দেবে, কোন ছবি অর্থ দেবে না, তা নির্ণয়ের জন্যে কোনো ফিল্মের ডাক্তার পাওয়া যায় না। আমি ছবি করছি আমার মানুষের জন্য। সংগ্রামে আমি বিশ্বাস করি। শিল্প মানে লড়াই।

আরো পড়ুন:  শিল্প, ছবি ও ভবিষ্যৎ

টিকা:

১. ঋত্বিককুমার ঘটক; চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরও কিছু দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা;  পুনর্মুদ্রণ নভেম্বর ২০১৫; পৃষ্ঠা ৩৪৩-৩৪৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!