বাংলা ভাষী অঞ্চলে বিপ্লবী গানের একটি বিশাল অংশ হচ্ছে বাংলা গণসংগীত

বাংলা ভাষী অঞ্চলে বিপ্লবী গানের একটি বিশাল অংশকে গণসংগীত বা বাংলা গণসংগীত (ইংরেজি: Bangla Ganasangeet বা Mass songs) বলা হয়েছে। গণসংগীত হচ্ছে সেই ধরনের সংগীত যেগুলো জনগণের মুক্তি সংগ্রামের সাথে জড়িত। জনগণের মুক্তি নিহিত ছিলো বাংলায় শ্রমিক ও কৃষকের মুক্তির সাথে। বাংলায় জমিদারতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে এই গণসংগীত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে এবং ভূমির মালিকানা কৃষকের হাতে গ্রহণের পক্ষে বিপ্লবী ভূমিকা গ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক ভূমিকা নিতে গিয়ে গণসংগীতকে জমিদারতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভূমিকা নিতে হয়।

ভারতীয় গণনাট্য প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই নাটকের সংগে সংগীতের ধারাটিতেও পরিবর্তন আসে। আধুনিক বাংলা গান দুটি ধারায় ভাগ হয়ে একটি হয়ে যায় বিপ্লবী ও প্রতিবাদী গানের ধারা, অন্যটি থেকে যায় প্রেমের বাংলা গানের ধারা। ফলে পেশাদারি গানের জগতে রোমান্টিক ভাবালুতা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল ১৯৪০-এর দশকের শুরুতেই। গণচেতনার নতুন অভ্যুদয়ের নৃত্যে গানে মানুষ খুঁজে পেল প্রতিবাদের ভাষা। শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, উৎপাদক শ্রেণির ও মেহনতি মানুষের মনের ভাষা, গানের ভাষায় উঠে এল প্রাজ্ঞ প্রতিভাবান তরুণ কিছু উদ্যমীর সংস্পর্শে এসে।

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ঘটে গেল গণসংগীতের সফল বিস্তার, এলো নতুন জোয়ার। বিভিন্ন গণসংগীতের গানের দল তৈরি হলো যোগ্য নেতৃত্বে। গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা বাংলার সংগীত মঞ্চে, পথেঘাটে, কলকারখানার গেটে, সদর মফস্বলে তাঁদের আসন কায়েম করে নিলেন দারুণভাবে। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, সলিল চৌধুরী, পরেশ ধর, সুধীন দাশগুপ্ত, প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সৃষ্টিশীল লেখক সুরকারের গণনাট্য মঞ্চ থেকেই আবির্ভাব। এদের সৃষ্ট গান বাংলার গানের ধারায় ব্যতিক্রমী প্রয়াস।[১]

গণসংগীত সুরের কলাকৌশলে বিশেষ আবদ্ধ নয়, কথা বা শব্দ বা বাণীই এর প্রধান দিক। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে সংগীত রচনা আর সুর সংযজনার একটি সম্পূর্ণ নতুন ক্ষেত্রে পদক্ষেপ করেন কয়েকজন নবীন স্রষ্টা-সলিল চৌধুরী, পরেশ ধর, হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই তিন সুরকার বাংলা গানে গণ-সংগীতের পথিকৃৎ। নিপীড়িত-শোষিত শ্রেণীর অগণিত মানুষের বঞ্চনা-ক্ষোভ-বেদনাকে কথা ও সুরে অভিব্যক্তি দানকারী যে যৌথগান, গণসংগীত তার পথিকৃত্যের গৌরব শেষোক্ত তিনজনকেই দিতে হয়। কোরাস গান থেকে গণসংগীতের উত্তরণকে ভাবের দিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয় এই রূপান্তর জাতীয়তার অভীপ্সা থেকে সমাজতন্ত্রের অভীপ্সার অভিমুখী, মধ্যবিত্ত শ্রেণির দেশপ্রেমের আকুতিকে ছাপিয়ে সর্বহারা শ্রেণির জাগরণের দ্যোতক।

আরো পড়ুন:  একটি দুটি তারা করে উঠি উঠি, মনকে দিলাম ছুটি তাই গো এই সন্ধ্যায়

আজকের দিনে সাংস্কৃতিক রুচিকে যারা নিয়ন্ত্রণ করে তারা হচ্ছে সিনেমা এবং রেকর্ড কোম্পানীসমূহ। এই সাঙ্গীতিক অবক্ষয়ের জন্য যতটা দায়ী গীতিকার সুরকারেরা, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অর্থনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থা, যেখানে একটি শক্তিশালী সামাজিক ক্ষমতাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এর মোকাবিলা করা সামান্য কাজ নয়—গােটা সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে মুনাফাবাজদের সরিয়ে দিতে না পারলে আমাদের সাংস্কৃতিক অবক্ষয় চলতেই থাকবে।[২]

মুনাফাবাজ সঙ্গীত-ব্যবসায়ীদের হাতে যারা নিঃশেষিতপ্রাণ হতে না চাইবেন, এমন কয়েকজন ব্যক্তিই আমাদের ভরসার কেন্দ্রস্থল। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দশক আমরা ভুলিনি—কয়েকজনের সদিচ্ছা যদি সাংগঠনিক শক্তির সাহায্য পায়, ক্রমশঃ নিজেই একটি সংগঠন হয়ে পড়ে, তখন তার শক্তিকে ব্যবসায়ীরাও উপেক্ষা করতে পারে না। এখানেই এসে পড়ে সমান্তরাল সঙ্গীতের কথা (Parallel Songs )। সেই সময় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ সমস্ত বাধার প্রাচীর টপকে জনসাধারণের সামনে তার স্বর্ণঝুলি থেকে ছড়িয়ে দিয়েছিল অমূল্য সব সাঙ্গীতিক অবদান- যার রেশ আজও চলছে। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়, সলিল চৌধুরী, পরেশ ধর, হেমাঙ্গ বিশবাসেরা যে গান বেঁধেছিলেন তাতে করে বাংলা সংগীতে একটি আশা সঞ্চারী দিগন্তের উন্মোচন হয়েছিল। সে ধারা কিছু ম্লান হলেও, আজও অব্যাহত আছে। অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও গণসংগীত আজো জনপ্রিয়।

গণসঙ্গীত জনপ্রিয় হলে আনন্দিত এবং আশান্বিত হবারও কথা, কিন্তু হওয়া যাচ্ছে না দুটি কারণে। এক : গণসঙ্গীতের মধ্যে ভেজাল ঢুকছে এবং দুই, গণসঙ্গীত শিল্পীদের আচরণে বৈপরীত্য। আমরা এখন এ ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত যে গণসঙ্গীতের সঙ্গে অন্য সব সংগীত শ্রেণীর যে স্বাতন্ত্র্য তা শুধুই এর সংগ্রামী অস্তিত্বের জন্যই নয়, এর বাণী এবং সুরের সহজিয়া ভাবের জন্যও অর্থাৎ খেটে খাওয়া অশিক্ষিত-নিরক্ষর মানুষদের সঙ্গীত এটি। এখন দেখা যাচ্ছে খুব দ্রুত এক শ্রেণীর লোক এই সঙ্গীতের বাহক হয়ে উঠছেন—এদের অনেকেরই শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাস নেই—এদের গানও সুতরাং কেমন একধরণের রোম্যান্টিক আবেদন সম্পন্ন।[৩]

আরো পড়ুন:  আঁখি দুটি ঝরে হায় একা জেগে থাকি

তথ্যসূত্র

১. দিনেন্দ্র চৌধুরী, গ্রাম নগরের গান (১৮০০-২০০৫) লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা ৭২-৭৩
২. নারায়ণ চৌধুরী, চার দশকের বাংলা গান, অরুণ সেন ও গোপালকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সংকলিত, প্রকাশ ভারতী কলকাতা, মে ১৯৬০, পৃষ্ঠা-৫-৭।
৩. মানস মুখোপাধ্যায়, সংস্কৃতির বেলা অবেলা, প্রকাশক: চন্দনা ঘোষ, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!