বাংলা গান হচ্ছে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উপাদান

বাংলা গান (ইংরেজি: Bangla music) হচ্ছে হাজার বছরের বঙ্গ অঞ্চলের বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। বাংলা গানেই বঙ্গের মানুষ স্বচ্ছন্দ, উদার ও অকৃপণ। বাংলা গান তার সৃষ্টিলগ্ন থেকে আপন নিয়মে আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে। বাংলা গানের এগিয়ে চলার পথে বস্তুবাদী ও ভাববাদী দুটি ধারা পারস্পরিক সমান্তরালভাবে বয়ে চলেছে। মানুষের জীবন ও প্রকৃতির বহু দিকের সাথে জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও ধর্ম এবং পুরাণের বিশেষ ঘটনা ও আখ্যান অবলম্বন করে এসেছে বাংলা গান।

বাংলা গীতিকাব্যে গীত রূপ ও পাঁচালি রূপ নিয়ে দুটি ধারা প্রাচিন ও সামন্তীয় মধ্যযুগ থেকেই প্রচলিত। বাংলা গানের স্তর পরম্পরাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাংলা গানের আদি পর্বে ছিল চর্যাপদের গান। এই চর্যাপদগুলির রচয়িতা ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়ারা। চর্যাপদের গানগুলিই ভক্তি সাধনার ভিত্তি তৈরি করে। এরপর এসেছে নাথগীতিকা, বৈষ্ণবগীতিকা, শাক্তগীতিকা, বাউলসংগীত; এই পাঁচ ধারার সংগীত ভক্তি সাধনা যুক্ত সংগীত। মঙ্গলকাব্য আর অনুবাদ সাহিত্য পাঁচালির অন্তর্ভুক্ত।[১]

নাথগীতিকা

নাথগীতিকাগুলির বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র। একটিমাত্র ঐতিহাসিক বিষয়বস্ত্ত অবলম্বনে সমস্ত নাথগীতিকা রচিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে বিষয়গত কোনো পার্থক্য নেই। যে মূল ঐতিহাসিক বিষয়বস্ত্ত অবলম্বনে সেগুলি রচিত তার একটি সর্বজনীন মানবিক আবেদন ছিল। এ ছাড়া এ গীতিকাসমূহ একটি সর্বভারতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়কে অবলম্বনের সুযোগ লাভ করে। নাথ সম্প্রদায়বিষয়ক রচনার দুটি প্রধান ভাগ: একটি হলো নাথগুরুদের অলৌকিক সাধন-ভজনের কাহিনী এবং অন্যটি তরুণ রাজপুত্র গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাসের কাহিনী। প্রথমোক্ত বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে  গোরক্ষবিজয়, মীনচেতন প্রভৃতি; আর দ্বিতীয়োক্ত বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে মানিকচন্দ্র রাজার গান, গোবিন্দচন্দ্রের গীত, ময়নামতীর গান, গোপীচাঁদের সন্ন্যাস, গোপীচাঁদের পাঁচালি প্রভৃতি। রাজপুত্রের অপূর্ব আত্মত্যাগের পাশাপাশি নাথগুরুদের অলৌকিক মাহাত্ম্যের কথাও এতে কীর্তিত বলে এগুলি বিষয়ের দিক থেকে বৈচিত্র্যহীন হলেও সর্বজনীনত্বের গুণে বাংলার সীমা অতিক্রম করতে পেরেছিল। নাথগীতিকাগুলি প্রধানত উত্তরবঙ্গে প্রচার লাভ করেছিল।[২]

আরো পড়ুন:  দূর কোন পরবাসে তুমি চলে যাইবা রে; বন্ধু রে, কবে আইবা রে

বৈষ্ণব পদাবলী

বৈষ্ণবগীতিকা বা বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যর সূচনা ঘটে চর্তুদশ শতকে এবং এই সাহিত্যের বিকাশ কাল হচ্ছে ষোড়শ শতক। বৈষ্ণব পদাবলী একদিকে যেমন গীতিসাহিত্য অন্যদিকে রোমান্টিক ভাবালুতায় আচ্ছন্ন সংগীত সমন্বিত ধর্মের বাইরেও সাধারণ জীবনকে প্রকাশ করেছে। পদাবলি একক কিংবা সম্মেলক কণ্ঠে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও ধর্ম সাধনার বাহনরূপে ‘কীর্তন’ নামে পরিচিত।

আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও ধর্ম সাধনার বাহনরূপে কালী বিষয়ক পদাবলি বা কালী কীর্তন বা শ্যামাসংগীতের ধারা সৃষ্টি হয়। সাধক রামপ্রসাদ এর প্রবক্তারূপে গণ্য হন। কীর্তনে প্রধানত দুটি ভাগ, নামকীর্তন ও রসকীর্তন। নামকীর্তনের অন্য নাম সংকীর্তন। সম্মিলিত কণ্ঠে জাতিধর্ম নির্বিশেষে গায়ক-অগায়ক মাধ্যমে কৃষ্ণ মাহাত্ম্য প্রচার ও আত্মশুদ্ধি এর উদ্দেশ্য। রস কীর্তনে রাধা-কৃষ্ণের বিচিত্র লীলা কাহিনি পালার আকারে পরিবেশিত হয়। রসকীর্তন লীলা কীর্তন নামেও পরিচিত।

বাউল গান

বাউল গান বা বাউল পদাবলি বাংলার সম্পদ। এটি বস্তুবাদী ও ভাববাদী উভয় ধারাকেই ধারন করে বেড়ে উঠেছে। যেমন আহমদ শরীফ উল্লেখ করেছেন যে, “বাউলের রস স্বরূপ হচ্ছে সাকার দেহের মধ্যে নিরাকার আনন্দ স্বরূপ আত্মাকে স্বরূপে উপলব্ধি করার প্রয়াস। এ হচ্ছে, অরূপের কামনায় রূপ সাগরে ডুব দেয়া।” তিনি আরো বলছেন, “বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাধারণ উত্তরাধিকার ছিল বলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে।”[৩]

তারপর পাঁচালী-তর্জা-হাফ আখড়াই-টপ্পা-কবিগান-রামায়ণ গান- টপ কীর্তন, যাত্রাপালার গান প্রভৃতি আঠারো আর উনিশ শতকের গানের পর্যায় পেরিয়ে বাংলা গান বিশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হলো।

বিশ শতক থেকে শুরু হলো বাংলা গানের নতুন পর্যায়। একদিকে প্রাচীন বাংলা গানের আদলে রচিত ধ্রুপদ ও খেয়াল-ভঙ্গিমার বিভিন্ন রাগাশ্রিত গান রচিত হতে লাগলো, অন্যদিকে পুরনো সুরের সঙ্গে নাগরিক জীবনধারা লব্ধ কিছু কিছু চটুল ও ‘জংলী সুরের আমেজ মিশিয়ে তৈরী হলো থিয়েটারের গান, কিন্তু সেটাই বাংলা গানের পরিবর্তনের একমাত্র চিহ্নিতব্য ধাপ নয়, তার চেয়েও অনেক বেশী বিশিষ্টতা জ্ঞাপক বড় রকমের পরিবর্তন ঘটলো অন্য কয়েক প্রকার অভিনব সুরসৃষ্টির মধ্যে। আধুনিক বাংলা গানের অব্যবহিত পূর্বদৃষ্টান্ত রূপে এইসব অনবদ্য সংগীত রচনাকেই নির্দেশ করতে হয়।[৪]

আরো পড়ুন:  নাইবা ঘুমালে প্রিয়, রজনী এখনো বাকি, প্রদীপ নিভিয়া যায়, শুধু জেগে থাক্ তব আঁখি

আধুনিক বাংলা গান

মূল নিবন্ধ: আধুনিককালে প্রচারিত ও প্রসারিত আধুনিক বাংলা গান এক বিশিষ্ট ধারা

আধুনিক বাংলা গান হচ্ছে আধুনিককালে প্রচারিত ও প্রসারিত বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারার সৃষ্টি। এর নাম থেকেই বোঝা যায় এটির জন্ম ও প্রসারের কাল হচ্ছে আধুনিক কাল। বাংলা গানের, যুগ থেকে যুগে অগ্রগতির ইতিহাসে, অনেকগুলি বিবর্তনের স্তর পেরিয়ে আধুনিক বাংলা গান তার স্বকীয়ত্ব ও প্রতিষ্ঠাভূমি পেয়েছে।

বলা বোধ করি প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ কাজী নজরুল রচিত গানই হলো ওই অনবদ্য সংগীত সম্পদ। সত্যিকথা বলতে গেলে, বাংলা গানের এই পাঁচ বিশিষ্ট সংগীতকাব্যের সম্মিলিত বাণী ও সুর সৃষ্টির সুসমৃদ্ধ ঐতিহই যাকে আজকের পরিভাষায় বলা হয় ‘আধুনিক বাংলা গান’ তার আর্বিভাব সম্ভব করে তুলেছে। কালের হিসেবে ‘আধুনিক বাংলা গান’ নামধেয় সংগীতের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে তিরিশের দশক থেকে।[৫]

তথ্যসূত্র

১. দিনেন্দ্র চৌধুরী, গ্রাম নগরের গান (১৮০০-২০০৫) লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা ৭
২. সৈয়দ আজিজুল হক, গীতিকা, বাংলাপিডিয়া, ৫ মে ২০১৪, http://bn.banglapedia.org/index.php?title=গীতিকা
৩. আহমদ শরীফ, বাউলতত্ত্ব, ঢাকা : পড়ুয়া, ২০১৩, পৃ. ৪২
৪. নারায়ণ চৌধুরী, চার দশকের বাংলা গান, অরুণ সেন ও গোপালকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সংকলিত, প্রকাশ ভারতী কলকাতা, মে ১৯৬০, পৃষ্ঠা-৫-৭।
৫ নারায়ণ চৌধুরী, পূর্বোক্ত।

Leave a Comment

error: Content is protected !!