বাংলা লোকসংগীত (ইংরেজি: Folk music of Bengal) হচ্ছে বাংলা সংস্কৃতির সূচনাপর্ব থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত গ্রামীণ জনগণের সংগীত বিষয়ক আনুষঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহের ইতিহাসে রচিত, গীত এবং সংরক্ষিত সংগীতভাণ্ডার। অর্থাৎ দীর্ঘকাল ধরে মুখে মুখে প্রচলিত ও সমাজের নিজস্ব ধারার স্বীকৃত গানগুলিই লোকসংগীত হিসেবে গণ্য।
বাংলা লোকসংগীতের রূপ ও বিষয়গত বৈচিত্র্য এই অঞ্চলের লোকসংগীতকে দিয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রধানত দেশের প্রত্যক্ষ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে বাংলা লোকসংগীতের সুর-বৈচিত্র্য। আর সেই বৈচিত্র্যের সূত্র ধরেই বাংলা লোকসংগীতে পড়েছে আঞ্চলিকতার প্রভাব। পশ্চিম সীমান্ত বাংলার লোকসঙ্গীতের মৌলিক ভিত্তি ঝুমুর, উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া, পূর্ব বাংলার ভাটিয়ালি, দক্ষিণবাংলার সারি আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রে নির্ভরশীল। এছাড়াও বোলান, জারিগান, ঘেঁটু গান, ভাদু, টুসু, পটের গান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
গ্রাম ও শহরের মানুষের সাথে গ্রামীণ গানের যোগাযোগের পথেই মূলত অষ্টাদশ শতকে গ্রামীণ গীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তার বিকাশ ঘটতে শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে গ্রাম্যগীতি বা পল্লীগীতির বিস্তারলাভ ঘটতে থাকে দিনের পর দিন। কলের গানের কালে স্পর্শ কাতরতায় লোকসংগীতের স্থান ছিলো তুঙ্গে। অন্যান্য গানের তুলনায় লোকসংগীতের বিক্রি ছিলো আশাপ্রদ।[১]
বাংলা লোকসংগীত শুধু রেকর্ডের মাধ্যমেই বা কেন বলি, আকাশবাণী বা ঢাকা রেডিয়োর মাধ্যমে বিশ শতকে এই গান সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে বাংলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এইভাবে এক অঞ্চলের গানের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে অন্য অঞ্চলের মানুষ খুব সহজেই। যা আগে কখনোই এভাবে সম্ভব হয়ে ওঠে নি।
বাংলা লোকসংগীতের সীমানা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে যে সমস্ত শিল্পীর কণ্ঠ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তাঁদের মধ্যে—আব্বাসউদ্দীন, নায়েব আলী, গিরীন চক্রবর্তী, গৌরী কেদার চক্রবর্তী, অনন্তবালা, সুরেন চক্রবর্তী, মিস্ হরিমতিসহ আরো অনেক অনেক শিল্পীর অবদান আমরা কখনোই ভুলতে পারি না। পল্লীবাংলার বিভিন্নধারার প্রচলিত গান উঠে আসে জনসমক্ষে যা আজও আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। বিশেষ করে তার কথার সরলতা এবং সুরের সাবলীলতা গ্রাম থেকে শহুরে মানুষের মন ছুঁয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। যার ফলস্বরূপ আমরা বড়ো জায়গায় বা উচ্চশিক্ষিত সমাজে গ্রামীণগীতি বা পল্লীগীতিকে প্রতিষ্ঠা পেতে দেখি। এর ফলে শিক্ষিত সমাজ পল্লীগানের অনুরাগী হয়ে ওঠেন বিশেষভাবে।[২]
বাংলা লোকসংগীতের উদ্ভব
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সাথে বাংলা লোকসংগীতের সম্পর্ক নেই। বাংলা লোকগান ঐতিহাসিককাল থেকেই স্বাধীন ধারা। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলির থেকে বাংলা পাঁচালীর উদ্ভব ধরলেও সেটা কেবল ধারাক্রম বর্ণনার জন্যই। মহাভারত, রামায়ণ, ভাগবতের বাংলায় অনূদিত গান লোকায়ত ধারায় মিশে পাঁচালীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। এই পাঁচালীই বাংলা লোকসংগীতের আদি উৎস। যদিও লেখক তপন রায় মনে করেন প্রাচীন বেদউদ্ভূত সামগানের সপ্ত স্বরের রূপটি থেকেই ক্রমঃপরিবর্তিত ধারাটি গ্রাম্যগীতি বা গ্রামীণগীতি। এই গ্রামীণগীতিই পল্লীগীতি হিসেবেও বেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু কোন সময় প্রতিষ্ঠা লাভ করে তা তিনি বলেননি। অর্থাৎ এই অনুমানটি যথার্থই ভ্রান্ত।
পল্লীগীতি প্রতিষ্ঠা পাবার পরে রবীন্দ্রনাথও একে অনুরাগের সাথে আবিষ্কার করেন। পল্লীসংগীতের অনুরাগী হয়ে তিনি বলেই ফেললেন—নিঃসংশয়ে জানি বাউলগানে একটা অকৃত্রিম বিশিষ্টতা আছে, যা চিরকেলে আধুনিক। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার প্রকাশ আমরা অবশ্যই পরবর্তীকালে দেখতে পাই গ্রাম্যগীতি বা পল্লীগীতিতে। এই সময় থেকেই আস্তে আস্তে গ্রাম্যগীতি বা পল্লীগীতি কথাটাই বা এর আবেগটাই হারিয়ে যেতে বসে। আমরা নতুন এক সংজ্ঞা নির্ধারণ করে ফেলি এই গানগুলোর ক্ষেত্রে। এই সময় থেকেই শুরু হয় এই গ্রামীণ ঐতিহ্যের ক্রমন্বয় আধুনিকরণ।
গ্রাম্যগীতি বা পল্লীগীতি থেকে রবীন্দ্রযুগে এই সংগীত ধারার নামকরণ হলো লোকসংগীত। আর দ্রুত এই নাম শহর থেকে গ্রাম গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ল খুব অল্প সময়ের মধ্যে। যতটা কঠিন পথ ধরে গ্রামীণ এই ঐতিহ্য শহরের বা আধা শহরের জনমানসে উঠে এল ততটাই সহজ পথ বেয়ে লোকসংগীত শব্দটা বিস্তার লাভ করল। তাতে সমগ্র বাংলার ঐতিহ্যলালিত এই গানের কোনো মূল পরিবর্তন না ঘটলেও মানগত বা গুণগত পরিবর্তন শুরু হয়ে গেল।
বাংলা লোকসঙ্গীতের বিষয়বস্তু
বাংলা লোকসঙ্গীত বৈচিত্র্যময়। পল্লীর শ্রমজীবী জনমানসের সংস্কারগত চিন্তা-ভাবনা, বারোমাসে তেরো পার্বণের উৎসব-অনুষ্ঠান, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ঔৎসুক্য, বাংলার নিসর্গশোভা, নদী ও নৌকার রূপকাশ্রয়ী চিন্তা-চেতনা, দারিদ্র্য, সমাজের অন্যায়-অবিচার, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য প্রভৃতি বিষয়গত বোধ ও অলৌকিক বিশ্বাসকে অবলম্বন করে গ্রামবাংলার মানুষ এ গান বেঁধেছে। তবে বাংলা লোকসঙ্গীতে লোকসংস্কারগত আচার-অনুষ্ঠানই প্রাধান্য পেয়েছে; সেই সঙ্গে নদী ও নৌকাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে জগৎ ও জীবনের রূপকাশ্রয়ী অধ্যাত্মলোকের মরমি গান।
বাংলা লোকসঙ্গীতে আরও একটি বিষয় বৈচিত্র্য এনেছে, সেটি হলো ভিন্ন ভাষাভাষী আদিম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির প্রভাব। বাংলাদেশে যেসব আদিম জনগোষ্ঠী রয়েছে, তারা বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত। তাদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি পরস্পর ভিন্ন। সেসব সংস্কৃতি দ্বারা বাংলা লোকসঙ্গীত বিষয়, সুর ইত্যাদি দিক থেকে অনেকাংশে প্রভাবিত হয়েছে।[২]
বাংলা লোকসংগীতের ধারা উপধারা
আমাদের দেশীয় লোকসংগীতের মধ্যে বাংলা লোকসংগীতের যতগুলো ধারা আছে সেগুলোকে মূলত চারটি অঞ্চলভেদে ভাগ করা যায়। যেমন-পূর্বাঞ্চল বা পূর্ববঙ্গ, উত্তরাঞ্চল বা উত্তরবঙ্গ, পশ্চিমাঞ্চল বা পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণাঞ্চল বা দক্ষিণ বঙ্গ। এই চারটি ধারার প্রত্যেকটি আবার বিভিন্ন উপধারায় বিভক্ত।
মূল নিবন্ধ: বাংলা লোকসংগীতের ধারা উপধারা হচ্ছে চারটি অঞ্চলের অর্ধশত লোকসংগীত
পূর্বাঞ্চল বা পূর্ববঙ্গের ধারাগুলোর মধ্যে মূল ধারাটি হলো ভাটিয়ালি। উত্তরাঞ্চল বা উত্তরবঙ্গের ধারাগুলোর প্রধান ধারাটি ভাওয়াইয়া। পশ্চিমাঞ্চল বা পশ্চিমবঙ্গের ধারাগুলোর মধ্যে মূল ধারাটি হল ঝুমুর। দক্ষিণাঞ্চল বা দক্ষিণবঙ্গের ধারাগুলোর মধ্যে মূলধারাটি—সারি গান ও বনবিবির গান। এই চার অঞ্চলের চারটি ধারা থেকেই অনেকগুলো উপধারা বের হয়েছে।
বাংলা লোকসংগীতের বিষয়ভিত্তিক ধারা
বাংলা লােকসঙ্গীতের বিপুল বৈচিত্র্য বাস্তবিকই আমাদের আশ্চর্যান্বিত ও বিস্মিত করে। বাঙালি জীবনের এমন কোনো পর্যায় নেই, যা এইসব সঙ্গীতে ধরা পড়েনি। বাংলা দেশের অঞ্চলভিত্তিক গানের আলোচনাকে বৈশিষ্ট্য ও ভাব বিষয় অনুসারে একত্রিত করলে যে ভাগ ও উপবিভাগগুলি পাওয়া যায় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
১. প্রভাতী: নামগান ও টহল গীত ২. ব্রত গীত: ননী চুরি, গােষ্ঠ-ফিরাগােষ্ঠ, কুঞ্জভঙ্গ, নিদ্রাভঙ্গ, নৌকাবিলাস ৩. ভাটিয়ালি : লৌকিক, দার্শনিক ৪. সারি : নৌকা বাইচ, খেদ-বিচ্ছেদ ৫. ঝুমুর : লৌকিক, দরবারি ৬. ভাদু ৭. টুসু ৮. জারি ৯. গীতিকার গান : মৈমনসিংহ গীতিকা, গুণাই বিবির পালা, দক্ষিণ রায়ের গান, বনবিবির পালা ১০. বারােমাইস্যা ১১. জীবিকা সংস্কার ১২. রঙ্গ ব্যঙ্গ ১৩. ঘুমপাড়ানি গান ১৪. মনসাভাসান : রয়ানি ১৫. শীতলামঙ্গল ১৬. গম্ভীরা: গাজন, আলকাপ ১৭. হােলি ১৮. জল ভরার গান ১৯. ধামাইল ২০. বিবাহ গীতি: হিন্দু রীতি, মুসলমান রীতি ২১. আগমনী-বিজয়া ২২. মালসি ২৩. বাউল-ফকিরি গান: তত্ত্বাশয়ী, দেহতত্ত্ব, মনঃশিক্ষা, চুয়া, আখেরি-চেতন, মুর্শিদী, মাইজভাণ্ডারি, মারফতি, ভাবগান ২৪. মেছেনির গান ২৫. ঝাপান ২৬. গারাম ঠাকুরের গান ২৭. পাঁচালী গান ২৮. কবিগান: তরজা ঢপ, ২৯. গাজির গান ৩০. রাখালিয়া গান ৩১. জাগ গান, ৩২. ভাওয়াইয়া: যাইটোল, কাতি পুজার গান, ছুবচনি, চটকা ৩৩. শ্রম সংগীত: ছাঁদ পেটার গান, ঢেঁকি ও যাতা ভানার গান, ধান ভানার গান ছাড়াও আরো অনেক উপবিভাগ
বিশ্ব সংগীতে বাংলা লোকসংগীতের অবস্থান
সমগ্র পৃথিবীর লোকসংগীতের দিকে তাকালে আমরা সুরগত একটা মিল কোথায় যেন খুঁজে পাই। যেমন আমার শোনা কিছু পাশ্চাত্যের বা মধ্যপ্রাচ্যের লোকসংগীতের মধ্যে আমাদের ভাটিয়ালি সুরের এবং ঝুমুর শৈলীর সুরের একটা মিল খুঁজে পাই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকসংগীত নিয়ে যে সমস্ত মানুষ দিনের পর দিন কাজ করে চলেছেন তাঁরা অনেকেই যা মত প্রকাশ করেন তা থেকে আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে লোকসংগীতের সুরের ক্ষেত্রে হয়ত আমরা একসূত্রে কোথায় যেন বাধা। ভাষাগত মিল কতটা বা ভাবগত মিল কতটা পাওয়া যায় তা নিশ্চিতভাবে জোর দিয়ে বলতে না পারলেও, ভাষা বিজ্ঞানীরা সেটা বলতে পারবেন এবং সেটা এই সময়ে ভীষণ জরুরিও বটে। তবে সুরগত বা স্বরগত মিলের একটা বড় কারণ কারোর কারোর মনে হয় সেই সাতস্বর। এই সাতস্বরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বা বাধা আছে প্রতিটি গানের সুরের প্রাণ ভ্রমরাটি। তা সে যে দেশেরই হোক না কেন। কারণ যে কোনো সুরকে ব্যাকরণগতভাবে গানে রূপ দিতে গেলেই আশ্রয় করতে হবে এই স্বরমলীকে। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই এই সৃষ্টির একটা সুরগত মেলবন্ধন ঘটবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. দিনেন্দ্র চৌধুরী, গ্রাম নগরের গান (১৮০০-২০০৫) লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা ১১৬
২. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, বাংলাপিডিয়া, ঢাকা, ১২ মার্চ ২০১৫, http://bn.banglapedia.org/index.php?title=লোকসঙ্গীত
৩. তপন রায়, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৬০০-৬০৩।
নিচের লিংক থেকে পনেরটি জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত শুনুন ইউটিউব থেকে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।