সহেলা গীত বাংলার লোকসংগীত ও লোকনৃত্যের ধারায় একটি স্বতন্ত্র শাখা

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লোকসংগীত ও লোকনৃত্যের ধারায় সহেলা গীত (ইংরেজি: Sahela geet) ও মেয়েলী গীত একটি স্বতন্ত্র শাখা। পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে বা আচার ব্রতে মেয়েরা যে গান পরিবেশন করে থাকে তাই সহেলা গীত নামে পরিচিত। ড. মুহম্মদ এনামুল হক একে বলেছেন ‘সহেলা গীত’। এ নামকরনের ব্যাপারে তার যুক্তি হলো, মেয়েরাই এ গানের গায়িকা এবং শ্রোতা । তাই এ গানের নাম সহেলা বা সখীদের সম্মিলিত গান। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুমিত্রা সেনের গাওয়া ‘কেনো আইলাম কেনো আইলাম কেনো আইলাম গো, আগে না জাইনা আমি কেনো আইলাম গো’ একটি জনপ্রিয় সহেলা গীত।

অন্যান্য অনেক লেখক মেয়েলী গীতকেই সহেলা গীত বলেছেন। মেয়েলী গীতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো না কোনো সামাজিক পারিবারিক অনুষ্ঠান বা উপলক্ষে কিনবা নারীজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে জরিত এবং প্রধানত মেয়েদের দ্বারা রচিত আর গীত লৌকিক গানের নাম মেয়েলী গান।

সহেলা গীত বহির্জগতের প্রভাব শূন্য। নারী মনের উৎস হতে অতি স্বাভাবিক ভাবেই এর জন্ম হয়েছে। এ গান পরিকল্পিতভাবে মেঝে ঘষে তৈরি করা নয়। বিশেষ কোনো ঘটনায় তাড়নায় বিশেষ করে বিবাহ অনুষ্ঠান, ধান ভানতে, চিড়া কুটতে, মুসলিম পরিবার হতে ছেলেদের খাৎনা উপলখ্যে মেয়েরা এ গান গেয়ে থাকে। যেসব মেয়ে একত্রে হয়ে গীত গায় তাদের কে বলে ‘এয়ো’।

সহেলা গীতের কথা ও সুর একেবারেই সরল। পরিবেশিত হয় দলবদ্ধভাবে। অন্যান্য বাংলা লোকসংগীতের মতো মেয়েলী গীতেরও সৃষ্টি, প্রচার, প্রসার সবই মৌখিক ঐতিহ্যের ধারায় চলে। নারী জীবনের আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, কামনা-বাসনা, হাসি-কাণ্ণা, উল্লাস- বিষাদ এ গানের মূল ভাব। সহেলা গীত পল্লীর কৃষ্টি, আচার-অনুষ্ঠান, সমাজচিত্র, পারিবারিক চিত্র, দাম্পত্য জীবন, সংসার যাত্রার ছবি, পিতৃগৃহ ত্যাগের ব্যাথা, শাশুড়ি-ননদীর নিগ্রহ, স্বামীর সোহাগ, দেবরের প্রতি ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। এছাড়া, হিন্দু সমাজের গর্ভাধান, সাধভক্ষণ, বিয়ে, নাইয়র, জামাই আগমন, বিয়ের আগের ও পরের প্রেম ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য মেয়েলী গান হিন্দু মোসলমান উভয় সমাজে প্রচলিত আছে। মেয়েলী গীত প্রকৃতপক্ষেই গতিশীল, চিরসবুজ, অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক।

আরো পড়ুন:  হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন উপমহাদেশের বাংলা গণসংগীতের জননন্দিত মহাযোদ্ধা

একটি সহেলা গীত

১.

কন্যারা মা বন্ধন করে পশ্চিম দুয়ার ঘরে
খেরকি দুয়ারে ফালাইছি পানি জাল্যা বেটার গায়ে
মাছ খাওয়ার আশাতে।
কন্যার জেঠি রন্ধন করে উত্তর দুয়ার ঘরেতে
খেরকি দুয়ারে ফালাইছি পানি বেয়ারা (বেহায়া) বেটার গায়েতে
সোয়ারী উঠার আশাতে।
কন্যার পিসী রন্ধন করে পূর্ব দুয়ার ঘরেতে
খেরকি দুয়ারে ফালাইছি পানি ঢুলি বেটার গায়েতে
নাচিবার আশাতে।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতে প্রেমচেতনা, আবুল হাসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

একটি মেয়েলী গীতের সাথে নাচ দেখুন ইউটিউব থেকে

মেয়েলী গীতের সাথে নাচ

Leave a Comment

error: Content is protected !!