সারিবদ্ধভাবে কাজ করতে করতে যে লোকসংগীত গাওয়া হয় তাই সারি গান

সারিবদ্ধভাবে বা একত্রে কাজ করতে করতে কায়িক শ্রমকে মধুর করার জন্য কিংবা কাজের মধ্যে প্রাণ বা উন্মাদনা সঞ্চার করার জন্য যে লোকসংগীত গাওয়া হয় তাকে সারি গান (ইংরেজি: Sari gaan বা Shari gaan) বলা যায়। সুরের বৈচিত্র্য খুব বেশি লক্ষিত হয় না এখানে। এ গানগুলি অত্যন্ত আবেগধর্মী সমবেত সংগীত। সমবেতভাবে গাওয়া হয় বলে এগানের মূল আশ্রয় তাল বা রিদিম। এই গান তাল প্রধান বলেই এর মধ্যে ভাবের গভীরতার থেকে ছন্দের চঞ্চলতা বেশি লক্ষ্য করা যায়।

কর্মের সঙ্গে এ সঙ্গীত যুক্ত বলে এই গানকে কর্মসঙ্গীতও বলা যায়। কর্মের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে সারিগানকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা যায়। যেমন, ছাদপেটার গান, ধান ভাঙার গান, পাট কাটার গান, নৌকা বাইচের গান ইত্যাদি। কিন্তু সারিগানের প্রাণময়তা বা উদ্দামতা দেখা যায় নৌকা বাইচের গানে। এ কারণে সারি গান বলতে অনেকে শুধুমাত্র নৌকা বাইচের গানকেই বোঝে।

প্রাচীন কাল থেকেই বাংলা অঞ্চলের উদ্দীপনাময় পল্লীসঙ্গীতের মধ্যে সারি গান একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। দেশের গৌরব ও গরিমামণ্ডিত অতীতের ঐতিহ্যকে বহন করে এনেছে সারির নামের এই রণ সঙ্গীত (March Songs)। এককালে বাঙলার দুঃসাহসী নাবিক দল বঙ্গোপসাগর এমন কি ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বেড়িয়েছে। এ দেশের নৌ-সৈন্যগণ সিংহলে বিজয়পতাকা উড়িয়ে এসেছে, বাঙালি সওদাগরগণ পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ হতে রাশি রাশি পণ্য বহন করে এনেছে, শ্যাম-কম্বোডিয়া-যবদ্বীপে শিল্প ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশ গঠন করেছে— তাদের সেই বিজয়যাত্রায় উদ্দীপনা যুগিয়েছে এই সারি গান। 

বড় বড় ময়ূরপঙ্খী নৌকা তাদের পণ্য বহন করত, কিন্তু যুদ্ধের জন্য ব্যবহত হতো ছিপ নামক এক ধরনের নৌকা। সে দিনের সেই গৌরবময় যুগের অবসান হয়েছে, কিন্তু নদীমাতৃক বাঙলার নৌজীবনে উদ্দীপনা আজও তেমনই রয়েছে। এ পূর্ববঙ্গের নদীনালার বাইচ খেলা আজও চলে এই ছিপ নৌকার সাহায্যে। এই নৌকাগুলো লম্বায় ২৫ থেকে ৩০ হাতের কম কোনটিই নয়, কিন্তু প্রস্থের দিক হতে এত সকীর্ণ যে পাশাপাশি দুজন বসতে পারে না, এইগুলি দুই দিকে দ্রুত বৈঠা চালায় বিদ্যুৎ গতিতে জলপথ অতিক্রম করিতে পারে। 

বাংলার লোকসঙ্গীত সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ কবি শ্রী যতীন্দ্র সেন এই প্রসঙ্গে বলেছেন— “বাঙ্গলার নৌশিল্প যে এক সময়ে সমৃদ্ধ ছিল এবং বাঙলার নাবিকেরা যে নৌ-চালনায় প্রশংসনীয় দক্ষতা লাভ করিয়াছিল, তাহার প্রমাণের অভাব নাই। আজকালও পূর্ববঙ্গের বিশেষত ফরিদপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, বরিশাল প্রভৃতি সমুদ্রতীরবতী ও সমুদ্রের নিকটবর্তী জেলাসমূহের মুসলমান অধিবাসীগণের এক বৃহৎ অংশ জাহাজের খালাসী, সারেঙ, যুগানী প্রভৃতি পদে নিযুক্ত হইয়া পৃথিবী পরিভ্রমণ করিতেছে। বাঙ্গালী নৌ সেনারা এক সময়ে সমুদ্রের জলরাশি অতিক্রম করিয়া, হয়ত সারিগান গাহিয়া গাহিয়াই নানা দিকদেশে ছুটিত, তাহাদের গানের সুরের যে সামান্য রেশ বাঙ্গালীর কণ্ঠে ছিল, তাহা নদনদী শুষ্ক হওয়ায় নৌ চালনার অসুবিধার জন্য দারিদ্র ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির জন্য আজ লুপ্ত হইতে বসিয়াছে।”

আরো পড়ুন:  হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন উপমহাদেশের বাংলা গণসংগীতের জননন্দিত মহাযোদ্ধা

বাংলা গানের অন্যতম প্রধান অবলম্বনই হয়ে আছে সেই বংশী রব। সারিগানেও সেই বংশীরব বা বাঁশির কথা শুনতে পাওয়া যায়। সারি গানের সুরের সঙ্গে বাঁশী যেন অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। অধিকাংশ গানেই থাকে হয় বংশী, না হয় বংশীধরের কথা। নৌকায় দাঁড় টানিতে টানিতে অথবা হাল ধরিয়া বসিয়া থাকিবার সময়ে বাঁশী বাজাইবার অবশ্য কোন সুবিধা নাই। বাঁশীর কথা যেসব গানে আছে সেগুলোর সঙ্গে বাঁশী বাজানো হয়। এই ধরনের সারির সুরই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন। এই ধরনের গান বেশ ধীর লয়ে গাওয়া হয়।

সারি সাধারণত দ্রুত লয়ের জলদ ছন্দের পান। কিন্তু এক ধরনের সারির সুর স্বভাবতই উদাস করুণ, অকূলে স্রোতের টানে তরী ছেড়ে দিয়া পশ্চিম গগণের অস্তগামী সূর্যের দিকে চেয়ে মাঝিরা গায় কিছু সারি গান।

শব্দের ও বাক্যের চটুলতা এ গানের মেরুদণ্ড স্বরূপ।  প্রাচীন বাঙলা দেশের আদিরসাত্মক গানমাত্রই রাধাকৃষ্ণের নামাঙ্কিত হতো। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলিয়াছেন – “আমাদের দেশের কবিরা আদিরসের গান লিখিতে গেলেই রাধা কৃষ্ণের দোহাই দিতেন। নিজের মনের ভাব ছল করিয়া রাধা কৃষ্ণের ঘাড়ে চাপাইয়া দিতেন। পাঁচালীওয়ালারা এই কাজ করিতেন, কবিওয়ালারাও করিতেন, ঝুমুরওয়ালারাও করিতেন, তরজাওয়ালারাও অনেক সময় করিতেন।” 

কেবল তারাই নয়, লোকসঙ্গীতকারদেরও অধিকাংশ প্রেমগান রাধাকৃষ্ণকে অবলম্বন করিয়াই রচিত। রাধাকৃষ্ণের যমুনাপুলিনের লীলাবিলাসও সারি গানের অন্যতম বিষয়বস্তু। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের সেই নৌকাখণ্ডের লীলার অনুসরণে কোনো কোনো সারি গান রচিত, নৌকার সঙ্গে জড়িত থাকায় এই সকল উপাখ্যান সহজেই সারিগানের উপজীব্য হয়ে উঠছে।

একটি দারুণ সারি গান শুনুন ইউটিউব থেকে

তুমি তো সুন্দর কানাই, তোমার ভাঙা নাউ

কোরাস গাওয়া বা একক গানে ডাক দেয়া, সংগে বৈঠার ছলাত শব্দ। এক যোগে সব কয়টি বৈঠা জলে ছপাৎ করিয়া পড়ে। গানের শব্দে তাই ছলাত ছলাত আছে। এইভাবেই নৌকা ঝড়ের বেগে বয়ে চলে চলে। অস্তমিত সূর্যের জন্য তাড়া, ঝড়ের বেগ এবং গতি। সঙ্গে সঙ্গে গানের প্রত্যেক মাত্রায় জলে বৈঠার তাল চলতে থাকে। 

আরো পড়ুন:  সহেলা গীত বাংলার লোকসংগীত ও লোকনৃত্যের ধারায় একটি স্বতন্ত্র শাখা

সাধারণত সারিগানের ও সেই সঙ্গে নৌকাবাইচের মরশুম আসে দুর্গা পুজার ভাসানের সময়ে; সারা বৎসরের যত গান যেন এই সময়ের জন্যই হয়ে থাকে। মুসলমান মাঝিমাল্লারাও এ সময়োপযোগী করুণ সরের সারি গান রচনা করেন।

দুর্গা পুজার সময় ও বিশ্বকর্মা পূজার দিন পূর্ববঙ্গের বহু নদীনালায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়; বৈঠার তালের সঙ্গে সঙ্গে মনের ছন্দও সমান তালে বাজিতে থাকে। এই সময়ের জন্য রচিত গানগুলিতে আছে কতকটা সামাজিক উদ্দীপনা।

তাছাড়া অন্যান্য সারিগানেও সময়ে সময়ে সামরিক উদ্দীপনার সুর ধ্বনিত হয়। পশ্চিমাকাশে অন্ধকার করে ঝড় আসছে তুফান উঠেছে, পীর গাজীর নামে ‘বদর বদর’ ডাক ছেড়ে শক্ত হাতে হাল চেপে দ্রুত বেগে দাঁড় বাইতে হবে।

সারিগানের অন্যতম মূল সুর কারুণ্যের। উদ্দীপনাময় সুরটি সাময়িক, প্রতিযোগিতার অবসান হলে দলছাড়া হয়ে যখন মাঝি তার খেয়া নিয়ে উজানে পাড়ি দেয়, তখন আর তার মনে সেই আনন্দের রেশ নাই, পদ্মার উদ্দাম প্রকৃতি সন্ধ্যার ছায়া ম্লান পরিবেশে তাহার মনে বেদনার ছায়াপাত করে ভাটিয়ালির ন্যায়ই সারির করুণ সুর তার কণ্ঠে ধবনিত হয়।

উদ্দাম উচ্ছল সুরে গান গাইতে গাইতে হঠাৎ পদ্মার দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি তাহাদের উন্মনা করে দেয়। চড়া ও খাদে একই সঙ্গে দুইটি সুরধ্বনি সারিগানের একটি বৈশিষ্ট্য।

সারিগানের বিষয়বস্তুর মধ্যে বিরহের আক্ষেপ ছাড়া অন্য বিষয়ও কিছু কিছু আছে। নবদ্বীপের নিমাই চাঁদ পদ্মা নদীর মাঝিদের সারিগানেরও নায়ক; তাঁর আসন্ন সংসার ত্যাগে শচীমাতা ব্যাকুলতা যেমন সারি গানে আছে, তেমনি লড়াইয়ের কথাও আছে। মাতার কণ্ঠে অনুনয় সারা বাঙলার বিভিন্ন গানেই ধ্বনিত হইয়াছে। নাটোরের দানশীল রাণী ভবানীর ধর্মপ্রাণতাও সারিগানের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।

সারি মূলত পুরুষদের কন্ঠেই নদী বক্ষে গীত হয়। তারাই যখন আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে নিভৃত গৃহে বিশ্রামসুখ উপভোগ করে, সেই সরের প্রতিধবনিই তাহারা গৃহ প্রাঙ্গণে প্রণয়িনীদের আকুল কণ্ঠে শুনিতে পায় এই সারি গানে। টুসু গানের ন্যায় এ ধরনের সারি গানেও নানা সাংসারিক কথা এসে পড়েছে। পদ্মা মেঘনার উপর গীত এ সকল গানে মাছের কথা নিতান্তই স্বাভাবিক।

আরো পড়ুন:  আলকাপ গান হচ্ছে উত্তরবঙ্গের বাংলা ভাষার জনপ্রিয় বাংলা লোকসংগীত

মুসলমান মাঝিমাল্লাদের কণ্ঠে বাৎসল্য রসটিও সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বিগলিত হয়। গোকুলের নন্দরাণী অতি সহজেই তাদের মাতা যশোদারূপে দেখা দিয়াছেন। নন্দদুলালের দৌরাত্ম্যে যশোদা অস্থির হইয়া পড়েছেন, ব্রজগোপাল ননী চুরি করিয়া পালাচ্ছেন, পশ্চাতে হাতে লড়ি নিয়ে মাতা তাড়া করলেন, সব মিলে গৃহ সংসারের একটি পরম রমণীয় চিত্র।

সারি গানের সুর সম্পূর্ণরূপে সমবেত কণ্ঠের উপযোগী করে রচিত। নৌকায় সারি দিয়ে বসে এই গান গাওয়া হয় বলেই এই সুরের নাম সারি হয়েছে। সাধারণত সারি গানে দুইটি ভাগ থাকে। একটি একক কণ্ঠের বা ‘পয়ার’ ও অপরটি সমবেত কণ্ঠের বা ধুয়া। যেমন একক কণ্ঠে গাওয়া হয় “ওহে কি করিব কোথায় যাব, কতই উঠে মনে, অন্তরে প্রেমের ধারা বহিছে রাত্রদিনে।” তেমনি ধুয়া বা কোরাস কণ্ঠে গাওয়া হয় “প্রাণ ত ছিনিল রে ছিদাম ভাই। চল ভাই সকলে মায়ের কোলে যাই।। ”

একক কণ্ঠের বা পয়ারেও একটি লাইনের বেশি একজনের গাইবার অধিকার নেই পরের লাইনটি। আবার পরবতী জন একক কণ্ঠে উদ্গীত করে। সব কিছু মিলে সারি গানে রীতিমত টিম ওয়ার্ক আছে। সারি গানের সুর ভাটিয়ালি ঢঙেরই, তা সত্ত্বেও এই সুরের মধ্যে এমন একটা বৈশিষ্ট্য আছে যে, সারি গান পূর্ববঙ্গের লোকসঙ্গীতে মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। ভাটিয়ালির ন্মতো সারি গানের সুর তেমন এক টানা নয়, একটি নিজস্ব ছন্দের সৃষ্টি করে। স্থলের উপরে এ সুরে যেন আপন স্বাভাবিকতা হারায়! জলের ছলছল সুরের সঙ্গে তাল রেখে সারি গানের টানে পানসি যেন তরতর করে বয়ে চলে।[১]

তথ্যসূত্র

১. জয়দেব রায়, “বাংলার সারি গান”, আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত সম্পাদিত সমকালীন, ষষ্ঠ বর্ষ, জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৫, পৃষ্ঠা ১২৪-১২৮।

Leave a Comment

error: Content is protected !!