সর্বজনগ্রাহ্য কতকগুলো কথা প্রচলিত আছে আমাদের মধ্যে– যেমন চিত্রই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি বাস্তবমুখী শিল্প; সবচেয়ে শক্তিশালী বাস্তবতার মাধ্যম; বস্তুমুখী জীবনকে তার সর্ববৈচিত্র্য সমেত ধরতে পারে একমাত্র চলচ্চিত্রই,– ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো তলিয়ে দেখা বিশেষ হয় নি এতদিন, অবকাশও তার বিশেষ ছিল না। গণনাট্যের নতুন জোয়ারের মধ্যে ছবিটা কোনো সময়ই এসে পড়ে নি।
আজ অবস্থার বদল হচ্ছে। এবং অতি নিকট ভবিষ্যতে আরো বদল হবেই। ছবি মোটেই কোনো দূরের জিনিস থাকবে না আর। গণনাট্যের চিন্তাধারার অন্তর্ভুক্ত বা তার সহগামী একটা শক্তি চিত্রজগতে তার স্থান করে নিচ্ছে। কিছুদিন বাদে নেতৃত্বও নেবে– এ অবধারিত।
আইজেনস্টাইন, পুদোভকিন বা গ্রিয়ারস পড়ার দরকার আছে, স্টানিস্লাভস্কির মূল বক্তব্যকে চিত্রের মাধ্যমের মতো করে গুছিয়ে নেওয়া সম্বন্ধেও আলোচনা চলবে। ইতালিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান বা রাশিয়ান ছবির ইতিহাস জানার দরকার নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তার আগে দরকার বাংলা এবং ভারতের ছবির গতি-পরিণতি, বাংলার দর্শকদের বৈশিষ্ট্য এবং বাংলার নিজস্ব বাস্তবকে ভালো করে অনুধাবন করা। বিদেশি বই কিছু পড়াশুনা করলেও বিলিতি ছবি নিয়ে ঘোরর আলোচনা চালালেও নিজেদের পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে মোটামুটি উন্নাসিকই থেকে গেছি আমরা। Rise of American films থেকে ফোর্ড, চ্যাপলিনের শিল্পজীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি আমরা জেনেছি, কিন্তু একটা মেহবুব কি শান্তারামের উত্থান ও পতন সম্বন্ধে নীবব থেকে গিয়েছি।
একজন বড়ুয়া কি মেহবুব আলোচনার অনেক মালমশলা দিতে পারেন আমাদের। আর বাস্তববাদ সম্বন্ধে চিন্তা করতে গিয়ে সর্বাগ্রে নিজেদের চারপাশের বাস্তবকে যদি আমরা হিসেবের মধ্যে না আনি, তা হলে সেটা হবে হাওয়ায় ইমারত গড়া। এ সাবধানবাণীর দরকার আছে মনে হয় প্রগতিশীল পত্রিকাগুলোতে চিত্র-সমালোচনা পড়ে। ভারতীয় ছবিরও একটা ঐতিহ্য আছে। আজ মার্কিনী ঢঙ আর ইতর ন্যাকামিই আমাদের একমাত্র অবদান নয়– রোটি, আদমি আর দেবদাস, গৃহদাহও আমাদের চিত্রজগতের একটা বিরাট ধারা। সেই ধারাই জয়ী হয়ে চলেছে আজও পর্যন্ত। শুধু ইতিহাসকারের অভাবে সেই বিশ্লেষণ এবং পথ কখনো চিত্রনির্মাতাদের সামনে তুলে ধরা হয় নি। বাংলাদেশে, আমি তো বলব: সমাধান, ভাবীকাল, উদয়ের পথে, পরিবর্তন, বিদ্যাসাগর, বাবলার মধ্যে দিয়ে সেই ধারাই আজও বলিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে চলেছে।
এই সব বইগুলোর কি দুর্বলতা নেই? আমরা যখন ছবি করতে যাব, তখন এই ধরনের বই করে যাব কি? মোটেই না। দুর্বলতা, অবাস্তবতা– এদের মধ্যে আছে; কিন্তু কোথাও আন্তরিকতা এগুলোর মধ্যেও ছিল, এই সম্মানটুকু এদের দিতে বলছি। তা হলেই দুর্বলতাগুলো শুধুই দুর্বলতা হয়ে দেখা দেবে, অপাঙক্তেয় করে তুলবে না এদের।
“বাংলা বই যাচ্ছে তাই” “ভারতীয় ছবি না দেখাই উচিত”, “এগুলোর সম্বন্ধে বিদ্বানসমাজে আলোচনাই করা চলে না।” – এসব অনেক বলা হয়েছে। কিন্তু কাজে কিছু করা হয় নাই একমাত্র “ধরতী কে লাল” বাদে। এইসব ধরনের কথা বলা ছেড়ে, এখন কাজ দেখাবার সময় এসেছে।
বক্তব্যের দিক দিয়ে এদের মধ্যে যে দুর্বলতা ছিল, প্রধানত তা অবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা। এর ফলেই শস্তা সেন্টিমেন্টের মধ্যে বারে বারে ছবিগুলি আবর্তিত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাস্তবকে অনুধাবন করে শিল্পসুলভ হৃদয়াবেগের সংযোগে ছবি করা এইটেই আজকের প্রগতিশীল কাজ। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে বই করা হয়েছিল, তাতে হৃদয়াবেগের অবকাশ থাকলেও এবং বিষয়বস্তু অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও শিল্প হিসেবে ছবিটি উৎরোয় নি। সেটি হচ্ছে, “ছিন্নমূল”, শুধু বিষয়বস্তু নয়, প্রকাশভঙ্গিতেও কাচা ছিল ছবিটি। তবু বাস্তববাদী বিষয় এবং আঙ্গিক ভারতে প্রথম ব্যবহৃত হয় এই ছবিতে। ছবির নিজের শিল্প অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে জায়গায় জায়গায় প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাই সমস্ত খুঁত থাকা সত্ত্বেও সোনার অক্ষরে ‘ছিন্নমূল’-এর নাম লেখা থাকবে প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোভাগে প্রথম দিকদর্শক হিসেবে। ‘ছিন্নমূল’ আমাদের গৌরব।
জার্মান উফা’র ছবি, ফরাসি ‘আভা গার্দ– আন্দোলন, বাশিয়ার আইজেনস্টাইন, পুডোভকিন, ডভশেঙ্কো, আলেকজান্দ্রভূদের নতুন পথের দিকসংকেত, হলিউডের গ্রিফিথ থেকে আরম্ভ করে ডিয়েটার্স ফোর্ড, চ্যাপলিন পর্যন্ত, গ্রিয়ারসনের নেতৃত্বে ইংলন্ডের ডকুমেন্টারি আন্দোলন, আজকের রসেলিনী ডিসিকার ইতালি, সারা পৃথিবীর বাস্তববাদী চিত্রের যে বিরাট বৈচিত্র্যময় অভিযান, সে সম্বন্ধে আমরা অনেক জানি।
শুধু জানি না একজন বড়ুয়া কী করে ‘অপরাধী’ থেকে ‘দেবদাস’-এর মধ্যে দিয়ে ‘গৃহদাহে’ এসে পৌঁছল। তার পর তার পতন, এর কারণ বিশ্লেষণের কোনো চেষ্টাই আমরা করি নি। দেবকী বসুর বিরাট প্রতিভা শেষ অবধি পৌরাণিকেই সীমাবদ্ধ হলেও মাঝে মাঝে ‘কবি’ ইত্যাদির মধ্যে কেমন করে চমক দেয়? আজ মেহবুব ‘আন’ তোলেন। কিন্তু তার ‘রোটি’ ‘Only way’ এসব বইয়ের কথা আমরা ভুলে গেছি। আমাদের মনে রাখা উচিত, বোঝার চেষ্টা করা উচিত। কারণ নতুন ছবির আন্দোলন যাঁরা করবেন তাদের শ্রেষ্ঠ চিত্রকর হলেই চলবে না, সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোককে নেতৃত্বও দিতে হবে– এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবকে বার বার অনুসন্ধান করতে হবে। একটা ‘বাইসাইকেল থিফ’ তৈরি হয় পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে ঘন যোগসূত্রের মাধ্যমেই চমক লাগানোর চেষ্টার দ্বারা নয়। আমাদের ‘বাইসাইকেল থিফ’ পথে-ঘাটে ছড়িয়ে আছে। শ্রদ্ধা নিয়ে খুঁজলে দেখব, তার ইতালির ঘটনার সঙ্গে গল্পের সঙ্গে কোনো যোগই নেই, অথচ তার মতোই দেশের মরমের কথাটি সে বলছে।
আঙ্গিকের উপর পরিপূর্ণ দখল নিতেই হবে। তার জন্যে সমস্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যকে অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু সে আঙ্গিক হবে একেবারেই দেশজ আঙ্গিক। একেবারেই তার জন্ম হবে না– হবে ধীরে ধীরে, যেমন শিল্পী অনুভব করতে করতে চলবেন সেই পথে।
চিত্রে বাস্তবতা কীভাবে ব্যবহার করা যায়, কেমনভাবে তার ব্যবহার হয়েছে, এ-সব বিষয় নিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। তার থেকেও যেটাকে বেশি জরুরি মনে হয়েছে, সেই কথাটাকে ঘুরে ফিরে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।
তবু, এটা জানা দরকার যে আজও বহু প্রভাবশালী এবং প্রগতিশীল চিন্তধারার লোক আছেন, যাদের বিশ্বাস ছবিতে আমোদই দেওয়া উচিত; সেখানেও জীবনের দুঃখ-কান্নার প্রতিফলন বিরক্তিরই উদ্রেক করবে! র্যাশন নেই, খাওয়া হচ্ছে না এ আর ছবিতে দেখে কী হবে, দেখবেই না কেউ।… এঁদের যুক্তির সমর্থনে অবশ্য এরা একটিও ছবি দেখাতে পারবেন না যাতে ঐ-সব যথাযথভাবে দেখানো হয়েছে। কাজেই বিরক্তির কথাটা তাদের মনগড়া এ কথা বোঝানোর দরকার আছে।
সঙ্গে সঙ্গে তুলে ধরা উচিত, যে ছবি বাস্তবের যতটা কাছে গেছে, সেই ছবি ঠিক ততটাই জনপ্রিয় হয়েছে। অবশ্য শিল্প হিসেবে উৎরোলেই সে কথা বলা চলে।
এই সব কথাগুলিকে বলার জন্যে আজ ‘ছিন্নমূল’-এর সহযাত্রী বহু শক্তিশালী শিল্পী সমাবিষ্ট হয়েছেন। তাদের আপ্রাণ চেষ্টার দ্বারা বাস্তবকে চিত্রে তারা প্রতিষ্ঠা করবেনই। সত্যেন বসুর ‘ভোর হয়ে এল’, সলিল চৌধুরীর ‘রিক্সাওয়ালা’ ইত্যাদি ছবি আমাদের মনে সেই আশাই জাগিয়েছে। এই পথে পা বাড়াবেন আরো অনেক নতুন ও পুরোনো শিল্পী, সে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বাংলার চিত্রজগৎ আমাদের কাছ থেকে সকৌতূহল ও সচেতন দৃষ্টিপাত দাবি করছে। এদের যা দরকার, তা হচ্ছে সত্যিকারের দরদী ও ভালো সমালোচনা। আমরা কি রীতিমতো সেটা দিয়ে যাব?
এইটাই প্রশ্ন।
টিকা:
১. ঋত্বিক ঘটকের এই লেখাটি নেয়া হয়েছে ঋত্বিককুমার ঘটক; চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরও কিছু দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা; পুনর্মুদ্রণ নভেম্বর ২০১৫; পৃষ্ঠা ৭৩-৭৫ থেকে।
ঋত্বিক ঘটক (জন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫ – মৃত্যু : ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুবার বহুভাবে উচ্চারিত। তিনি পরিচালনা করেছেন নাগরিক (১৯৫২, মুক্তি ১৯৭৭), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্র।