জনজীবনের রূপকার শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী

জয়নুল আবেদীন (২৯ ডিসেম্বর, ১৯১৪ – ২৮ মে, ১৯৭৬) ছিলেন বাংলাদেশের জনজীবনের রূপকার এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। তিনি ‘শিল্পাচার্য’ নামে পরিচিত ছিলেন। তার বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে-দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড় এবং আরো অনেক ছবি। ১৯৬৯ সালে গ্রাম বাংলার উৎসব নিয়ে আঁকেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ তাঁর বিখ্যাত ছবি নবান্ন।

জয়নুল তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে আবার ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর প্রথম দিককার আঙ্গিকে। মোটা তুলির টানে কালো বর্হিরেখা তাঁর ছবির মূল কাঠামো নির্মাণ করে। নবান্ন শীর্ষক সুদীর্ঘ স্ক্রলচিত্র, ’৭০-এর মনপুরা, প্যালেস্টাইনের যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্যাবলী, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্কেচ, অথবা ’৭০-দশকের প্রথম থেকে তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আঁকা প্রতিকৃতিমূলক ড্রইং সবই এই আঙ্গিকে আঁকা।[১]     

তার আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা পৃথিবীবিখ্যাত চিত্রকর্মের সিরিজ। সেই দুর্ভিক্ষ বা মণ্বন্তর ঘটেছিল ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায়; বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের বেঙ্গল প্রদেশে যা তেতাল্লিশের মণ্বন্তর নামেও পরিচিত। সেই সময় ৬০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৩ মিলিয়ন এর বেশি মানুষ তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রি শয়তান গণহত্যাকারী নরপিশাচ চার্চিলের সৃষ্ট দূর্ভিক্ষের কারণে অনাহার, অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সেই তেতাল্লিশের মণ্বন্তর সম্পর্কে জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন

“১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ ছিলো মনুষ্য সৃষ্ট। একটি পরাধীন দেশে একটি বিদেশী শক্তির চক্রান্ত। তার একটা স্বতন্ত্র আবেদন ছিলো; তাই অন্তর থেকে ছবি আঁকার দুর্বার প্রেরণা ছিলো। সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ধ্বংসলীলা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে কারো হাত নেই তেমন। এতে দুঃখ হয় কিন্তু আবেদন ক্ষণস্থায়ী, তাই অধিকসংখ্যক উল্লেখযোগ্য ছবি হয়নি। আর এখন? এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটি স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের ছবি হয় না!”

আমরা কী সেই রুচির দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে উঠতে পারছি। আমাদের আশাবাদি হতে ইচ্ছে করে। কেননা এই আশাবাদের দিক নির্দেশনা আমরা পাই তাঁরই লেখা থেকে। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত ডিলিট ডিগ্রিপ্রাপ্তির দিনে যে ভাষণ প্রদান করেন তাতে বলেছিলেন,

“আমাদের বস্তুগত উন্নয়নকে অবশ্যই মানবীয় সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে চালিত করতে হবে। আমরা যেন বস্তুজগতের সেবক না হয়ে পড়ি। আমাদের অগ্রগতির লক্ষ্য যেন উত্তম হয়। আমরা যদি আমাদের জীবনের স্বাভাবিক বাস্তবতা, আমাদের পরিবেশ এবং সমাজ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকি, তাহলে শিল্পী এবং বিজ্ঞানী সকলেই অধিকতর মানবীয় হয়ে উঠবো। কারণ ছাড়া সমাজ অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে না। একটি সুন্দর ও সম্মানজনক মানবসত্তা গড়ে তোলার এই হলও অবশ্যম্ভাবী পথ। 
আমার সমস্ত জীবন ও কর্ম নিবেদিত ছিলো একজন সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার পথে।”[২]    

জয়নুল আবেদীন সমাজতন্ত্রের পক্ষে বিশেষ ভুমিকা রেখেছিলেন। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র The People’s War পত্রিকায় ১৯৪৫ সনের ২১ জানুয়ারি সংখ্যায় জয়নুলের উপর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই কাগজটি তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলো,

“বাংলার ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘের একজন সদস্য জয়নুল। এই সংঘটি সমগ্র বাংলার সকল শিল্পী ও লেখকের এরকম একটি প্রতিষ্ঠান যার প্রধান কর্তব্যই ছিলো সমস্যাতাড়িত জনগণকে সাহায্য করা। আর এতে কোনো সন্দেহই নেই যে, সে সকল সময়েই এঁদের একজন অগ্রণী সদস্য থাকবে।”

জয়নুল আবেদীন তার রেখে যাওয়া শিল্পের মাধ্যমে আমাদের মননজগতকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন অনবরত। তিনি নিজে নির্ভীক থেকে জনগণকে শেখান লড়াই করতে, ঘুরে দাঁড়াতে। তিনি আমাদের সেই বাতিঘর যেখান থেকে আমরা দেখি গণ মানুষের হাজার বছরের আর্তি ও সংগ্রামকে জয়নুলের শিল্প হচ্ছে বাঙলার জনগণের যন্ত্রণার অমর ছবি।

আরো পড়ুন:  সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শ্রেণিসংগ্রামের লড়াইয়ের পথের পথিকদের আলোকবর্তিকা

তথ্যসূত্রঃ

১. নজরুল ইসলাম, তাঁর কাজ ও কথা; সমাবেশ, ঢাকা; ফেব্রুয়ারি, ২০০২; পৃষ্ঠা ৪৭।

২. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১০।

Leave a Comment

error: Content is protected !!