বাংলায় বর্গির আক্রমণ বা মারাঠা আক্রমণ বা বর্গির হাঙ্গামা বা মারাঠা বাংলা যুদ্ধ (ইংরেজি: Maratha invasions of Bengal) হচ্ছে দশ বছর ধরে মারাঠাদের বঙ্গভূমি লুণ্ঠন ও নিপীড়ন করা, বঙ্গকে দুর্বল করা এবং দক্ষিণ এশিয়াকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অধীন করার পদক্ষেপ। বঙ্গে মারাঠা আক্রমণ শুরু হলে আলিবর্দি খান দিল্লীতে রাজস্ব পাঠান বন্ধ করে দেন। প্রাক-পলাশী যুগে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ এ দেশের কৃষি ও শিল্পের ক্ষতি করেছিল। মারাঠারা পুরো দশ বছর ধরে বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছিল। মারাঠাদের এই আক্রমণও বাংলাকে দুর্বল করে এবং বাংলাসহ পরে গোটা হিন্দুস্তান ব্রিটিশদের অধীনে যাবার পথকে সহজ করে।
প্রাক-পলাশী যুগে বাংলায় মারাঠা আক্রমণ এ দেশের কৃষি ও শিল্পের ক্ষতি করেছিল। এ আক্রমণ পশ্চিম ও মধ্য বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল। পূর্ব ও উত্তর বঙ্গে আঘাত আসেনি। এর ফলাফলকে লঘু করে দেখা ঠিক হবে না। আবার মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর সমস্ত আর্থিক ও সামাজিক দুর্গতির জন্য একে দায়ী করা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস বিরােধী কাজ হবে। মারাঠারা পুরো দশ বছর ধরে বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছিল। তাদের আসা যাওয়ার পথের দুধারে আগুন জ্বালিয়ে গ্রামবাসীদের ঘর-বাড়ি, শস্য গােলা এবং ক্ষেতের শস্য নষ্ট করে দিত। টাকা পয়সা, সােনা রূপাে লুঠ করত। মারাঠাদের মুখে ‘রূপেয়া’ সর্বদাই লেগে থাকত, গঙ্গারাম লিখেছেন সােনা রূপা লুটে নেএ আর সব ছাড়া’। নির্বিচারে নারী, বৃদ্ধ, শিশু হত্যা করত। বাংলার বহু হতভাগিনী নারী মারাঠাদের লালসার শিকার হন। শিবাজীর আদর্শচ্যুত মারাঠা দস্যুরা বাংলার সামাজিক জীবনে অভিশাপ বয়ে নিয়ে এলো। ব্রাহ্মণ ভারতচন্দ্র এবং গ্রাম্য হিন্দু কবি গঙ্গারাম মারাঠাদের নারী নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতচন্দ্র লিখেছেনও ‘লুটিয়া লইল ধন ঝিউড়ী বহুড়ী।’ গঙ্গারামের মন্তব্য হলো ‘ভাল ভাল স্ত্রীলােক জত ধইরা লইয়া জাএ’।
মারাঠা আক্রমণ বাংলাদেশে এমন ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল যে মারাঠারা আসছে শুনেই বাংলার হিন্দু মুসলমান সকল শ্রেণির লােক তাদের অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ত। গঙ্গারাম তার গ্রন্থে এ যুগের ভয় সন্ত্রস্ত, ভীত বিহ্বল মানুষের এক নিখুত চিত্র উপহার দিয়েছেন। অনেক সময় দেখা যেত জনরব ভিত্তিহীন; মারাঠারা সে অঞ্চলে আদৌ হানা দেয়নি, তবুও জনসাধারণ মারাঠাদের সম্পর্কে কিছু একটা শুনলেই ভীত চঞ্চল হয়ে পড়ত। পালানাের চেষ্টা করত (‘লােকের পলান দেখিয়া আমরা পলাই’)। স্বয়ং আলিবর্দী ও তার পরিবার পদ্মার রাজশাহীর কাছে রামপুর বােয়ালিয়াতে অস্থাবর সম্পত্তি স্থানান্তরিত করেছিলেন। জগৎশেঠরা ধনরত্ন নিয়ে ঢাকাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পশ্চিম বাংলার অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা গঙ্গার পূর্ব তীরে তাদের ধনসম্পদ স্থানান্তরিত করেছিলেন বলে জানা যায়।
মারাঠা আক্রমণে বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল চাষ হল না বেশ কয়েক বছর। ফলে খাদ্য শস্যের দাম বাড়ল। এ অঞ্চলের বিপন্ন মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় লাভের উদ্দেশ্যে পশ্চিম বাংলা। ছেড়ে দলে দলে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গে পাড়ি জমাল। এতে বাংলার পশ্চিম ও মধ্যভাগে লােকসংখ্যা কিছুটা কমে এল। অপরদিকে পূর্ব ও উত্তরদিকে লোকসংখ্যা বাড়ল। কিছু মারাঠা পরিবার বাংলার বীরভুম, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া অঞ্চলে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে রয়ে গেল। এককালের আক্রমণকারী ও আক্রান্ত পরবর্তী প্রজন্মে পরস্পরের প্রতিবেশী হলো।
বাংলার শিল্পােৎপাদনের ওপর মারাঠা আক্রমণের প্রভাব হল অনেক বেশি ও গভীর। এ সময় বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মারাঠারা কাচামাল ও বাণিজ্য পণ্য লুঠ করত। শিল্পে কাঁচামালের সরবরাহ ব্যাহত হল। অনেক সময় বিদেশী কোম্পানীর বাণিজ্য পণ্য তারা লুঠ করত। ১৭৪৮ খ্রীষ্টাকে মারাঠারা ইংরাজ কোম্পানীর পণ্যতরী আটক করে ৩০০ বেল কাঁচা সিল্ক লুঠ করেছিল।
এ যুগে বাংলার সূতী ও রেশমী বস্ত্রের উৎপাদন অনেক কমে যায়। ভাল কাঁচামালের অভাবে উৎপন্ন পণ্যের গুণগত মানের অবনতিও দেখা যায়। প্রতি বছর জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মারাঠারা শিবিরে আশ্রয় নিত বা দেশে ফিরে যেত। এই অবসরে অল্প সময়ের মধ্যে তাঁতি ও কারিগরদের কাজ করতে হত। তাড়াতড়ি করার ফলে উৎপন্ন পণ্য আগের মত উৎকৃষ্ট হত না। এ সময়ে ইউরােপের বাজারে এবং পশ্চিম এশিয়ার জেদ্দা, মােখা ও বসরাতে বাংলার বা শিল্পের দুর্নাম হয়েছিল। বাংলার সূতী ও রেশমী বস্তু আগের মত উন্নত মানের হলনা বা দামেও সস্তা রইল না। আড়ঙগুলি পরিত্যক্ত হলো। মারাঠারা গঞ্জ, বাজার ও হাটগুলি লুঠ করার চেষ্টা করত। বাংলার আভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। বিদেশে সরবরাহ অনেক কমে যায়। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাগজপত্রে বাংলার শিল্প বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। মারাঠা আক্রমণে বাংলায় মজুরের যােগান ও পুঁজি সরবরাহ ব্যাহত হয়েছিল বলে জানা হয়।
তথ্যসূত্র
১. সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রাক-পলাশী বাংলা, কে পি বাগচী এন্ড কোম্পানি, কলকাতা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১৬৪-১৬৫
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।