মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার ইতিহাস হচ্ছে কর্ণাটকের সেন ও দিল্লির সুলতানী শাসনের অধীনতা

মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার (ইংরেজি: Medieval dependent Bengal) যুগ হচ্ছে বাংলার সামগ্রিক ইতিহাসে কর্ণাটকের সেন এবং দিল্লির সুলতানী শাসনের যুগ। এই আমলের সূচনা ঘটে ১০৭০ সাল থেকে বাংলা কর্ণাটকের সেনবংশীয়দের দ্বারা আক্রমণ থেকে। সেনদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ১০৯৭ সালে বাংলা পরাধীন হয়ে যায় বিদেশী বিভাষী কর্ণাটকের সেন রাজাদের দ্বারা। পাল আমলের পতনের ভেতর দিয়ে বাংলায় ধ্রুপদী স্বাধীন যুগের শেষ হয় এবং শুরু হয় মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার যুগ। এই মধ্যযুগীয় পরাধীন বাংলার যুগ শেষ হয় ১৩৩৮ সালে স্বাধীন সুলতানী আমলের আরম্ভ হলে।

প্রতিবেশী কোন কোন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ পাল আমলে স্থলপথে বাণিজ্য-সম্বন্ধ পাতিয়ে হারানাে সমৃদ্ধি কিছুটা ফিরে পাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতেও তার কৃষির ওপর ঐকান্তিক নির্ভরতা ঘােচেনি। সেন আমলে বাংলাদেশ একেবারেই কৃষিনির্ভর, ভূমিনির্ভর, গ্রাম্য সমাজে পরিণত হল। এই পর্বে সােনা-রুপো দূরের কথা, কোন রকম ধাতুর মুদ্রাই আর দেখা যায় না। গ্রাম এবং কৃষি বাঙালীব জীবনে সর্বেসর্বা হয়ে থাকল। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের থিতিয়ে-থাকা জীবনের নিশ্চিত আর স্বাচ্ছন্দ্য, স্নিগ্ধতা আর আমেজ বাঙালীকে এমন করে পেয়ে বসল যে, বাইরের সংগ্রামময় তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ বহুবিস্তৃত জীবনের ডাক কিছুতেই তার কানে গেল না।[১] ফলশ্রুতিতে বাংলা দিল্লির সুলতানী শাসনের অধীন হয়ে পড়ে।

সেন আমলের পরাধীন বাংলা

দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে অর্থাৎ মদন পালের রাজত্ব কালে উত্তরবঙ্গ আক্রমণ করেন সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন। পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযােগে বিজয় সেন বঙ্গদেশ জয় করেন এবং সেনরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন বৃহত্তর দিনাজপুরসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ। কর্ণাট দেশীয় নান্যদেব ছিলেন বিজয় সেন। উত্তরবঙ্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে কামরুপ রাজ দূরীভূত কলিঙ্গরাজকে পরাজিত ও গৌড়ের রাজকে দ্রুত পলায়নে বাধ্য করেছিলেন। তিনি মিথিলায় তাঁর রাজ্য প্রশাসনিক প্রশাসন স্থাপন করেন। বিজয় সেনের দ্বারা পরাজিত হন গৌড় রাজা মদন পাল। ফলে পাল রাজ্য বিনষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ধর্মপাল, দেবপাল, মহীপাল ও রামপালের স্মৃতি বিজরিত শেষ চিহ্নগুলাে ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিজয় সেনের মৃত্যুর পর অর্থাৎ ১১৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পুত্র বল্লাল সেন রাজ-ক্ষমতায় বসেন এবং পুরাে রাজ্যকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেন। (১) রাঢ় (২) বরেন্দ্র (৩) বাগড়ী (৪) বঙ্গ ও (৫) মিথিলা। বল্লাল সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র লক্ষণ সেন ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। এবং ১২০৫ খ্রি. পর্যন্ত শাসন করেন।[২]

উপরােক্ত আলােচনা থেকে অনুমান করা কী যায় না, যে সেন শাসনের আমলে ঠাকুরগাঁও অঞ্চল সেন রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি ছিল। কেননা বিজয় সেন কামরুপরাজকে একরকম পরাজিত করে উত্তর বঙ্গের সর্বউত্তরের ঠাকুরগাঁও অঞ্চল দিয়েই গৌড়, বরেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য জয়লাভ করেছিলেন। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে (সম্ভবত) তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজি অতর্কিত আক্রমণে রাজা লক্ষণ সেনকে নদীয়া থেকে পালাতে বাধ্য করেন। বখতিয়ার খিলজি গৌড়রাজ জয় করে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রা জারি করেন। বখতিয়ার খিলজি দেবকোট দখল করে তার সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন। আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে সেন শাসনের অবসান ঘটে এবং মুসলিম শাসনের সূচনা হয়।

দিল্লির সুলতানি আমলে পরাধীন বাংলা

১২০৫ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি বীর বখতিয়ার খিলজি যেদিন দেবকোটে আসেন সেদিন তাকে স্বাগত জানানাের লােকের অভাব ছিলাে না। কারণ দেবকোটে আসার পূর্বেই এখানাকার অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। ওই দিন বখত-ই-আর খলজি বিনা রক্তপাতে গৌড়রাজ দখন করতে পারেননি। কারণ রাজা লক্ষণ সেনের সৈন্য-সামন্ত যেভাবে ওত পেতে থাকতাে তা সহজে লক্ষণ সেনের প্রাসাদে ঢুকা সহজ ছিল না বখত-ই-আর খলজির। তিনি কৌশল অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছেন। আর পূর্বেই যেভাবে বখত-ই-আর খলজির অনুসারীরা দস্যুর ন্যায় আক্রমণ করে লুঠ, ধর্ষন ও ডাকাতি করে পালিয়ে যেত, তা কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে সুন্দরভাবে বর্ণনা আছে। অর্থাৎ আচমকা উপস্থিত হয়ে তুর্কি দস্যুরা আক্রমন করে তরবারি আঘাতে হত্যা, লুঠ ও ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে পালিয়ে যেত। একদিকে যেমন রাজা লক্ষণ সেনের রাজ্যে সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার ও নির্যাতন যেভাবে বেড়েছিল ঠিক অপরদিকে তুর্কি দস্যুদের উপদ্রব্য বেড়েছিল। কারণ সেন রাজা ও সামন্ত প্রভুদের সাথে এ-বঙ্গের বৌদ্ধদের সম্পর্কের চিত্র ছিলাে এক্কেবারে দা-কুড়াল। বৌদ্ধরা সামন্ত প্রভু ও সেন শাসকের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় তুর্কি দস্যুদের আহ্বান করেছিল এ-বঙ্গে আসার এবং সব রকমের সহযােগিতাও করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল বৌদ্ধ দেখলেই সেন রাজার সামন্ত প্রভুরা কঠোর নির্যাতন করতে কোন দ্বিধা করতাে না। হিন্দু ও বৌদ্ধদের অমীমাংসিক সম্পর্কের সুযােগে এ-বঙ্গে আগত সুফী সাধকরা নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়কে মুক্তির বাণী শুনিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিক করতে শুরু করে। এমন কি সেন রাজ মুসলমান সুফীদের আস্তানা গড়তে সাহায্য করে। ফলে এ-বঙ্গে মুসলমান সুফী সাধকদের আস্তানা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। এ-সুযােগটা কাজে লাগান তুর্কি সেনাপতি বখত-ই-আর খলজি। আমার ধারণা মতে- তুর্কি দস্যুরা যখন এ-বঙ্গে এসে ডাকাতি, হত্যা ও লুঠ করতে থাকে তখন কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিল এ-বঙ্গ দখল করার তাদের সময়ের ব্যাপার। কেননা সেন রাজের সামন্ত প্রভুরা যেভাবে নির্যাতন ও অত্যাচারে এ-বঙ্গের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল এবং সুখ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছিল; আর এটা বুঝতে তাদের সহায়তা করেছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। ফলে সেন রাজ্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছিল। রাজ্য ও প্রাসাদ জুড়ে যখন অন্ধকারের ঘনচ্ছটা নেমে আসে তখন কার সাধ্য সে অন্ধকারটাকে সরিয়ে ফেলার।

আরো পড়ুন:  বাংলাদেশ পুঁজিবাদ অনুসারী সাম্রাজ্যবাদ পীড়িত শোষণমূলক নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র

যখন এ-বঙ্গের ক্ষমতায় বসার সম্ভাবনা খুব কাছে চলে এসেছে; ঠিক তখনি একটি কৌশল অবলম্বন করেছিলেন বখত-ই-আর খলজি। যে কৌশলে সেন সৈন্যরা বুঝতে এমনকি সেন রাজা লক্ষণ সেন বুঝতে পারেননি। যখন বুঝালেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অর্থাৎ বখত-ই-আর খলজি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ব্যবসায়ীর বেশে লক্ষণ সেনের প্রাসাদে ঢুকেন ঠিক দুপুরবেলায় যখন সৈন্য ও তার দেহরক্ষীরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রামে চলে গেছে। প্রাসাদের অনেকেই বুঝে উঠে আগেই বখত-ই-আর খলজি ও অনুসারী উদ্যত তরবারী রক্তে ভেসে যেতে শুরু করেছে। রাজা লক্ষণ সেনের দেহরক্ষী ও সৈন্যরা প্রতিরােধ ব্যুহ তৈরি করলেও বখত-ই-আর খলজির তরবারীতে টিকতে পারেনি। ফলে লক্ষণ সেন গােপন পথে প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। আরও একটা বিষয় হতে পারে যে- তুর্কিরা এ-বঙ্গে এসেই হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্মান্তরিত করার পেছনে তাঁদের এ-বঙ্গের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ভাষা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। তাই এ-বঙ্গে এসেই তাদের দেওয়া অনেক কিছু তরবারির আঘাতে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কেননা এ-বঙ্গে তারা এসেই প্রথমে বৌদ্ধ মঠগুলাে ধ্বংস করতে থাকে, মন্দিরগুলাে অপবিত্র করতে থাকে। যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তুর্কিদের আহ্বান করে এনেছিল তাদের উপরে বেশি আঘাতটা করে বসে বখত-ই-আর খলজির অনুসারীরা। যা অস্বীকার করা উপায় নেই।

রাজ্য ক্ষমতায় বসে বখতিয়ার এখানকার বৌদ্ধবিহার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলাে ধ্বংস করলেন এবং কিছু কিছু জায়গায় মসজিদ, খানকা ও মাদ্রাসা স্থাপন করলেন। এই দেবকোটে সুফী সাধকদের আগমন ঘটে লক্ষন সেনের রাজত্বকালে।

বাংলার শেষ নরপতি লক্ষণ সেন রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে তাঁর পিতার পথে না গিয়ে বৌদ্ধদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন এবং ইসলামপন্থি সুফী সাধকদের সঙ্গে আপস করে শাসন কাজ চালাতে লাগলেন। তিনি শেখ মখদুম শাহজালাল তাব্রিজীকে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রয়ােজনীয় জমি, বাইশ হাজার খাজনা আদায়ের গ্রামসমূহ দান করেন। এই সময় বৃহত্তর দিনাজপুরের অনেকেই তাব্রিজীর অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ ও কর্ম-দক্ষতার মুগ্ধ হয়ে ধর্মান্তরিক হয়েছিলেন। ফলে বখতিয়ার খিলজি আরাে অনেককে জোর করে হােক বা অন্য কোনাে উপায়েই হােক ধর্মান্তরিত করতে দ্বিধা করলেন না। এভাবেই ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্য বাড়তে থাকে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের গােড়াপত্তন শুরু হয়।

আরো পড়ুন:  বাংলার জনগণের দিল্লি বিরোধিতা হচ্ছে এক হাজার বছরের শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস

মধ্যযুগীয় বাংলার আরেক শাসক ছিলেন বখতিয়ার খিলজি। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দেবকোট শহর থেকে তিনি দশ হাজার সৈন্য নিয়ে তাঁর বিখ্যাত তিব্বত অভিযান শুরু করেন। তিব্বত অভিযানের পূর্বে বখতিয়ার খিলজী, শীরান খিলজী ও তাঁর ভ্রাতা আহম্মদ শীরান খিলজীকে সেনাবাহিনীর একাংশসহ জাজ নগরের (উড়িষ্যার দিকে) পাঠান। তাঁর তিব্বত অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পর্যবসিত হয় এবং দশ হাজার সমর নায়ক সৈন্যের মধ্যে মাত্র এক হাজার সৈন্য নিয়ে কোনাে রকমে দেবকোট ফিরে আসেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি আলী মর্দান কর্তৃক দেবকোট শহরে নিহত হন।

বখতিয়ারের মৃত্যুর উত্তরকালে বাংলায় নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলমান রাজ্যে খিলজী মালিকদের মধ্যে অন্তর্বিরােধের সৃষ্টি হয়। বখতিয়ারের মৃত্যুর খবর। পেয়ে খিলজী মালিকদের অন্যতম মােহাম্মদ শিরান খিলজী বীরভূম জেলার লখনৌর থেকে দ্রুত দেবকোটে ফিরে আসেন। অতঃপর তিনি নারকোটির নিকট আলী মর্দানকে পরাজিত ও বন্দী করেন এবং লখনৌতি রাজ্যের শাসন ভার গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় নামে খােতবা পাঠ ও মুদ্রার প্রচলন করেন। তাঁর লক্ষনৌতি রাজ্যের শাসনভার গ্রহণের পর আলী মর্দান কৌশলে কারাগার থেকে পালিয়ে যান এবং দিল্লীতে কুতুব উদ্দীন আইবেকের আশ্রয়প্রার্থী হন। বাংলায় নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলমান রাজ্য দ্রুত পট পরিবর্তনের ফলে দিল্লীর শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কুতুব উদ্দীন আইবেক অযােধ্যার শাসনকর্তা কায়েমাজ রুমীকে লখনৌতি আক্রমণ করে খিলজী আমীরদের বিরােধ মীমাংসা করতে এবং প্রত্যেক আমীরকে ইকতায় বহাল আদেশ দেন। ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল মাসে কায়েমাজ রুমী শিরান খিলজীকে মাকসিদাহ ও সন্তোষ অঞ্চলের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেন। কনকৌরীর জায়গীরদার হােসান উদ্দীন ইওজকে কায়েমাজ রুমী লখনৌতির রাজ্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এভাবে লখনৌতিতে দিল্লীর শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। হােসান উদ্দীন ইওজ খিলজী দিল্লীর অধীনস্থ শাসকর্তা হিসাবে লখনৌতিতে দিল্লীর শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হন। হােসান উদ্দীন ইওজ খিলজী দিল্লীর অধীনস্থ শাসকর্তা হিসাবে লখনৌতি শাসন করতে থাকেন। ইওজ এ পদে দুই বা আড়াই বৎসর বহাল থাকেন। পক্ষান্তরে কুতুব উদ্দীন আলী মর্দানকে লখনৌতির শাসকর্তা নিয়ােগ করেন। ১২০৯ খ্রিস্টাব্দে আলী মর্দান বাংলায় আগমন করেন। ইওজ আলী মর্দানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ১২১০ খ্রিস্টাব্দে।

আরো পড়ুন:  ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ ছিলো তিন গণশত্রুর পারস্পরিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত

আলী মর্দান খিলজী অতি সহজেই এ জেলাসহ লখনৌতির শাসনকর্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সমর্থ হন। ১২১০ খ্রিস্টাব্দে আইবেকের মৃত্যুর পর আলী মর্দান দিল্লীর সঙ্গে লখনৌতির সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং সুলতান আলাউদ্দীন আলী মর্দান খিলজী নাম ধারণ করেন। তিনি নিজ নামে খােতবা পাঠ ও মুদ্রার প্রচলন করেন। কিন্তু স্বাধীন নরপতি হিসাবে বেশিদিন শাসন করতে পারেন নাই। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে খিলজী আমীরগণ হােসান উদ্দীন ইওজের নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হন। ১২১২ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা সুলতান আলাউদ্দীনকে হত্যা করেন এবং হােসান উদ্দীন ইওজ খিলজীকে নেতা নির্বাচন করেন। হােসান উদ্দীন ইওজ সুলতান গিয়াস উদ্দীন ইওজ খিলজী উপাধি ধারণ করে লখনৌতির সিংহাসন আরােহণ করেন। তিনি দেবকোট থেকে গৌড় বা লখনৌতির সিংহাসনে আরােহণ করেন। সামরিক কারণে ও প্রজাদের মঙ্গলের জন্য লক্ষনৌতির সঙ্গে দেবকোটের যােগাযােগের জন্য একটি রাস্তা নির্মাণ করেন। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র নাসিরউদ্দীনের কাছে পরাজিত ও নিহত হন। অতঃপর বাংলার মুসলমান রাজ্য দিল্লীর অধীনস্থ প্রদেশে পরিণত হয়। দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের রাজত্বকালে বাংলার শাসনকর্তা মুগীস উদ্দীন তুঘরল বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন তুঘরলকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলাকে তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। কিন্তু অল্পকালের জন্য বাংলা দিল্লীর অধীনস্ত প্রদেশ ছিল।

১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর বােখরা খান নাসির উদ্দীন মাহমুদ উপাধি ধারণ করে নিজকে বাংলার স্বাধীন সুলতান ঘােষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রুকুন উদ্দীন কায়কাউস বাংলার শাসনকর্তা হন। তাঁর রাজত্বকালে অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার দেবকোটে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তারপর শামসউদ্দীন ফিরােজ শাহ ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন অধিকার করেন। তাঁর শাসনামল ছিল এ দেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য হিসাবে লক্ষনৌতির সমৃদ্ধি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তাঁর মৃত্যুর পরে ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে গিয়াস উদ্দীন তুঘলক লখনৌতি আক্রমণ করেন। তিনি বাংলা জয় করে দেশটিকে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত করেন। তন্মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাঙলার প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল লখনৌতি। তখন বাংলার এ অঞ্চলের প্রশাসক ছিলেন আলাউদ্দিন আলী শাহ।

তথ্যসূত্র

১. সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বাঙালীর ইতিহাস, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলকাতা, জুন ১৯৬০, পৃষ্ঠা ১৯৮।
২. অজয় কুমার রায়, ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস, টাঙ্গন, দ্বিতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫-৩১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!