ঠাকুরগাঁও জেলা উত্তরবঙ্গের একটি প্রাচীন জনপদ যা বর্তমানে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের একটি জেলা। ভৌগোলিক দিক থেকে ঠাকুরগাঁও অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ ফুটের বেশি উঁচু নয়। বেশির ভাগ ছোট নদী, শাখা নদী ও উপনদীর জল প্রবাহের কারণে প্রায় সবখানেই সমতল ভূমির সৃষ্টি হয়েছে। ভূ-প্রকৃতিগতভাবে বরেন্দ্র অতিপ্রাচীন এবং এর ইতিহাসও প্রাচীন। যতোদূর জানা যায় প্রাচীনকালে ঠাকুরগাঁও অঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধনের অংশ ছিলো। এই ভূখণ্ডই পাল শাসনামলে বরেন্দ্র অঞ্চল নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
রাজা গোপাল রাজধানী স্থাপন করেছিলেন দেবকোটে। যা বর্তমানে বানগড় (অন্যনাম কোটিবর্ষ) নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে পালরাজাদের একাধিক রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুণ্ড্রবর্ধন ও গৌড়ে। সুতরাং বলা যায় পাল শাসনামলে ঠাকুরগাঁও অঞ্চল সামগ্রিক হোক কিংবা আংশিক হোক পাল রাজাদের অধীনে ছিলো। ধর্মপালের পর তাঁর পুত্র দেবপাল শাসন ক্ষমতায় বসেন। দেবপাল ইতিহাস প্রসিদ্ধ। তিনি কলিঙ্গ ও কামরুপ রাজ্য জয়লাভ করেছিলেন। পিতার আদর্শে শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন ৪০ বছর। দেব পালের নামানুসারে তার রাজধানীর নাম হয় দেবকোট। দেবপালের সময়েও করতোয়া ও পুণ্ডভুক্তির সীমারেখা ছিল। দেবপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহেন্দ্রপাল রাজধানী স্থানান্তর করে টঙ্গিল নদীর তীরে। অর্থাৎ বর্তমানে টাঙ্গন নদের তীরে কুদ্দালখাতক নামক স্থানে। এই মহেন্দ্রপাল সাত বছর ক্ষমতা পরিচালনা করেন। ৮৮৮ শকাব্দের দিকে কনৌজরাজ উত্তরবঙ্গ দখল করেন। এ থেকে অনুমান করা যায় যে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের কিছু অংশ বা সমগ্র অঞ্চল কিছু সময়ের জন্য হলেও কনৌজরাজ শাসন করেছিলেন।
রামপাল ও ভীমের যুদ্ধে-ভীম নিহত হন। তবে রামপাল ও ভীমের যুদ্ধের কাহিনী ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার গেড়া গ্রামকে কেন্দ্র করে কিছু লোককথা প্রচলিত আছে। এই লোককথাটি হচ্ছে— ‘পালরাজা রামপাল বরেন্দ্র ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কৈবর্তরাজা ভীমের বিরুদ্ধে এই গেড়া গ্রামের আশপাশে থেকে প্রথম যুদ্ধ-যাত্রা সূচনা করেন।
বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও অঞ্চল বারবার কামরুপ রাজ্যের আক্রমনে পরিণত হয়েছিল । কখনো কখনো কামরুপ রাজ তা দখল করে নিয়েছিলো। কিন্তু পাল রাজাদের দৃঢ় সংবদ্ধে পুনরায় উদ্ধার করতে পেরেছিলো। প্রকৃতপক্ষে ঠাকুরগাঁও অঞ্চল ছিলো পাল রাজাদের ভিত্তি ভূমির অংশ।
প্রাচীনকালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ভেতর দিয়ে তিনটি বড় নদী প্রবাহিত হতো সেগুলো হচ্ছে (১) পুনর্ভবা (২) করতোয়া ও (৩) আত্রাই। প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থে এসব নদীর কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন মহাভারতে করতোয়া, দেবীপুরাণ গ্রন্থে কল্লোলিনী আত্রাই এবং পুরাকাহিনীতে পুনর্ভবা নদীকে পবিত্র নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই জেলার কূলবর্তী পুনর্ভবা নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল কোটিবর্ষ নগরী। মুসলিম শাসনামলে এই নদীর তীরেই গড়ে উঠছিলো তুর্কি আক্রমণকারীদের দুর্গ দমদমা। সেই জন্য রামচরিত্র পুস্তকে সন্ধ্যাকর নন্দী এই নদীকে অতি ভয়ংকরী বলে চিহ্নিত করেছেন।
রাজমহলের যুদ্ধের ফলে বাংলায় মুঘল শাসন শুরু হয়। খান জাহান তানডায় রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি এই জেলাসহ উত্তর বাংলা ও অন্যান্য স্থান দখল করেন। মুঘল সেনাধ্যক্ষের নিকট কিছু জমিদার পরাজিত হন এবং অনেকে আত্মসমর্পণ করেন। অল্প কিছুদিন পর জমিদাররা আবার স্বাধীন হন। এর ফলে, মুঘল শাসনাধীনে শুধুমাত্র বাংলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলই অবশিষ্ট থাকে।
ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাস
ঠাকুরগাঁওয়ের নদীগুলোর তীরেই বাঙালির প্রাচীনতম সংস্কৃতির অভ্যুদয় ঘটেছিলাে এবং বাঙালির চাষ-বাস, ধান, শস্য উৎপাদন, ঘরবাড়ি নির্মাণ ও জীবনের গতিপথ দেখা যায়। ৬০৬ অব্দে গৌড় দেশে শশাঙ্ক নামের একজন পরাক্রমশালী রাজা আক্রমণ করে গুপ্ত রাজাদের পরাজিত করে একটা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মুর্শিদাবাদের কর্ণ-সুবর্ণে তিনি রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। আবার অনেকের ধারণা শশাঙ্কের দ্বিতীয় রাজধানী ছিলো উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্রবর্ধন। শশাঙ্কই ছিলেন প্রথম বাঙ্গালি; যিনি বঙ্গদেশের বাইরে সাম্রাজ্য বিস্তারের সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্বে বাঙালির এতো বড় রাজ্য ছিলে না। (১) সমতট (২) গৌড় (৩) পুণ্ডু (৪) তাম্রলিপ্তি ও (৫) বঙ্গ নামেই রাজ্যগুলো পরিচিত ছিলো। একমাত্র সমতট ব্যতিত রাজা শশাঙ্কের রাজ্যের সবকটি অন্তর্ভুক্ত ছিলো। এ থেকে প্রমাণিত করা যায় যে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলও রাজা শশাঙ্কর রাজ্যের অধীনে ছিলো।
আদিকাল থেকে শুরু করে তুর্কি অভ্যুদয় পর্যন্ত বিভিন্ন বিচিত্র রক্ত ও সংস্কৃতির ধারা এই অঞ্চলে বয়ে এসেছে এবং ধীরে ধীরে কোথায় কীভাবে তা বিলীন হয়ে গেছে তা কেউ সেভাবে বলতে পারেননি। কিন্তু মানুষ তার রক্ত দেহ গঠন, ভাষা, সভ্যতার বাস্তব উপাদান ও সংস্কৃতির ধারা কিছুটা রেখে যেতে বাধ্য হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিককালে ভারতের উত্তর হিমালয় পাদদেশ সন্নিহিত অঞ্চলে মঙ্গলীয় বা মোঙ্গল জাতির বসবাস এই জেলায় বিস্তৃত ছিলো। সময়ে সময়ে মোঙ্গল জাতি গোষ্ঠী ও ঠাকুরগাঁওয়ের দক্ষিণ বাঙালি জনগোষ্ঠির মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যেত। স্থানীয়দের সাথে মোঙ্গল জাতিগোষ্ঠি না পেরে হিমালয় পাবর্ত্য অঞ্চলে আত্মগোপনে বসবাস করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। আবার সুযোগ পেলেই মোঙ্গল জাতিগোষ্ঠি ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে এসে বসবাস করার চেষ্টা করেছে যেখানে তাদের গোষ্ঠির লোকরা বাস করেছিলো।
ঠাকুরগাঁওয়ের ভূপ্রকৃতি
ঠাকুরগাঁও জেলা সমভূমিতে অবস্থিত। এ জেলায় বনভূমি আছে মাত্র ১.৭%। ২০১৪ সালের স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে এই জেলায় বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট আয়তন ৩০.৪৯ বর্গ কিলোমিটার।[২]
ঠাকুরগাঁও জেলার কৃতি ব্যক্তিত্ব
ঠাকুরগাঁও জেলার কীর্তিমান কয়েকজন ব্যক্তি এই জেলাকে তাঁদের কর্মের দ্বারা মহিমান্বিত করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে এই জেলার দুজন ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের বিপ্লবী হচ্ছেন নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ এবং স্বদেশরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। এই জেলার ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন রাজা গণেশ।
এছাড়াও অন্যান্য কীর্তিমান ব্যক্তি হচ্ছেন সুরবালা সেনগুপ্ত, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং তৃপ্তি মিত্র। এই জেলায় সংগীত এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মো. সাবের আলী ও শাহেরা খাতুন। এই জেলা জন্ম নেয়া গুরুত্বপূর্ণ লেখক হচ্ছেন মো. আবদুল ওদুদ।
ঠাকুরগাঁও জেলার নদনদী:
ঠাকুরগাঁও জেলায় অনেকগুলো নদী আছে। এই জেলার ছোট বড় অসংখ্য নদীর তীরেই প্রাচীন সময়ে গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধবিহার, হিন্দুমন্দির, স্থানীয় শাসন কেন্দ্র, রাজধানী, ব্যবসা বাণিজ্যের নগর। এ নদীগুলো হলো আমনদামন, টাঙ্গন, নাগর, কুলিক, পুনর্ভবা, শুক, লাচ্ছি, ছিরামতি, ছোট ঢেপা, ছোট সেনুয়া, কাহালাই, গভুরা, যমুনা, বালিয়া, পিতানু, রুহিতা, কুমড়ি, গামারি, তুলাই, ডাহুক, তিরনাই, তিমাই, নোনা, পাথরাজ, তালমা, লাচ্ছি, ভুল্লী, গন্দর এবং সোজ ইত্যাদি। এই নদীগুলো পূর্বে নাব্যতায় পূর্ণ ছিলো এবং বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার যাতায়াত ব্যবস্থাকে উন্নত করে রেখেছিলো।
তথ্যসূত্র:
১. অজয় কুমার রায়, ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস, টাঙ্গন, দ্বিতীয় সংস্করণ আগস্ট ২০১৮, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫-১৬।
২. বন অধিদপ্তর, তথ্য কণিকা, জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০১৯, শিক্ষায় বন প্রতিবেশ, আধুনিক বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ৬।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।