বর্ণনা: গজার মাছের দেহ সম্মুখে প্রায় চোঙাকৃতির এবং পশ্চাতে চাপা। সম্মুখ নাসারন্ধ্র নালীর ন্যায় প্রসেস তৈরি করে। নিম্নচোয়ালে এক সারি ভিলি আকৃতির দাঁতের পিছনে অল্প সংখ্যাক ছেদন দাঁত থাকে। সিমপাইসিসে (Symphysis) ৫ থেকে ৬ সারি ভিলি আকৃতির দাঁত, ভোমারে ২ থেকে ৩টি বড় দাঁত এবং তালুতে অল্প সংখ্যক দাঁত বিদ্যমান। মাথার উপরিভাগ বড় বড় প্লেটের ন্যায় আঁইশ দ্বারা আবৃত থাকে এবং অক্ষিকোটর থেকে প্রাক অক্ষিকোটর পর্যন্ত ৯ থেকে ১০টি আঁইশ বিদ্যমান। পার্শ্বরেখা অঙ্গে আঁইশের সংখ্যা ৫৪ থেকে ৬৪টি। পার্শ্বরেখা অঙ্গ প্রথমে ১৮ থেকে ১৯টি আঁইশ পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে দুইটি আঁইশ নীচে নামে, তারপর সোজা পুচ্ছ পাখনা ভিত্তির মধ্য পর্যন্ত অগ্রসর হয়। শ্রোণীপাখনা বক্ষদেশে অবস্থান করে।
এই মাছ দেহের রঙ, বয়স এবং বাসস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়। তরুণ মাছের পার্শ্বদিকে মাঝ বরাবর উজ্জল কমলা বর্ণের ডোরা থাকে কিন্তু পরিণত মাছে পার্শ্ব বরাবর ৪ থেকে ৫টি বড় গুচ্ছাকার কালো ফোটা দেখা যায়। পুচ্ছ পাখনার উপরের গোড়ায় একটি উজ্জ্বল কিনারা বেষ্টিত স্বচ্ছ কালো অসেলাস (ocellus) বিদ্যমান। তরুণ মাছে চোখ থেকে পুচ্ছ পাখনার মধ্যবিন্দু পর্যন্ত কমলা বর্ণের ডোরা থাকে। এরা প্রায় ১২০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হয় (Rahman, 1989) ।
স্বভাব ও আবাসস্থল: গজার চরম রাক্ষুসে প্রকৃতির শিকারী মাছ; যা অল্প দূরত্বের মাঠ ও অতিক্রম করতে পারে। প্রাথমিকভাবে এই প্রজাতি ছোট ছোট মাছ, সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, কেঁচো এবং ব্যাঙ্গাচী খায়। এই প্রজাতির মাছ স্বজাতিভুক, কেননা প্রায়ই বড় মাছ তাদের ছোট মাছগুলোকে শিকার করে। বর্ষা মৌসুমে এদের প্রজনন ঘটে এবং জলজ আগাছায় ভাসমান বাসা তৈরি করে সেখানে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রায় ৩৬ থেকে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগে।
পুরুষ ও স্ত্রী উভয় মাছই এক মাসের জন্য বাচ্চাদের পাহারা দেয়। সাধারণত নদী, খাল, হৃদ এবং জলাশয়ের মন্থর ও স্থির পানিতে দেখা যায় । এরা নদী, খাল এবং হ্রদের গভীর ডোবা ও যেখানে নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ থাকে সেখানে বাস করে। বালু বা পাথুরে তলা বিশিষ্ট গভীর ও পরিষ্কার পানি এদের পছন্দ (Talwar and Jhingran, 1991)।
বিস্তৃতি: পাকিস্তানের ইন্দাচ নদীর নালা বা নর্দমা ভারতের অনেক নালা/নর্দমা, শ্রীলংকা বাংলাদেশ, নেপালের দক্ষিণাংশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্পোডিয়ার মেকং অববাহিকা এবং দক্ষিন চীনে এদের পাওয়া যায় । এই মাছ বাংলাদেশে ময়মনসিংহ এবং সিলেটের বিল, হাওড় ও জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায় (Rahman, 1989)।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব: গজার স্থানীয়ভাবে খাদ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য আহোরণে এই মাছের অবদান শতকরা ৩.৪১ ভাগ বা ৭১৫৮৩ মেট্রিকটন (FRSS, 2004-05)। এই প্রজাতির মাছ, অন্যান্য সর্পমাথা প্রজাতির তুলনায় কম পাওয়া যায়। সৌখিন মৎস্য শিকারে এই মাছের ব্যাপক কদর থাকে। এটি দক্ষিণ ভারতের পুকুরে চাষ করা হয় (Talsar and Jhingran, 1991)।
এই মাছকে এ্যাকুয়ারিয়ামে ও লালন পালন করা যায়। বড় এবং গভীর পুকুরে এই মাছের চাষ সম্ভব। আমেরিকাতে এটি অ্যাকুয়ারিয়াম মাছ হিসেবে ‘কোবরা সৰ্প মাথা’ নামে বিক্রি হয়। সিলেটে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর দরগায় এ প্রজাতির বড় বড় মাছ পালন করা হয়।
বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা: গজার মাছ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারীতায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যেহেতু এটি শীর্ষ স্তরের শিকারী, তাই এই মাছ স্থানীয় শিকারের মাধ্যমে বা তাড়িয়ে দিয়ে অন্যান্য মাছের সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে ফেলতে পারে। সিঙ্গাপুর এবং আমেরিকার হ্রদে এই মাছ ছাড়ার পর সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বিঘ্নিত হয়েছিল।
বর্তমান অবস্থা এবং সংরক্ষণ: IUCN Bangladesh (২০০০) এর লাল তালিকায় এটি বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। পলি জমাট এবং বড় বড় হ্রদ, বিল, হাওড়, নদী শুকিয়ে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান মৎস্য আহরণই এই প্রজাতির জন্য প্রধান হুমকি। C. maraulius অন্যান্য সর্পমাথা মাছ অপেক্ষা কম পাওয়া যায়। ময়মনসিংহ এবং সিলেট অঞ্চলের বিল, হাওড় ও জলাভূমিতে সহজেই পাওয়া যায়। এই মাছ ধরে রাখা ও চাষাবাদের মাধ্যমে এর সংখ্যাবৃদ্ধি প্রয়োজন।
মন্তব্য: বাংলার নিম্নাঞ্চলে কিছু কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এই মাছকে অমঙ্গলের প্রতীক মনে করে। মায়ানমারের কারেন সম্প্রদায়ের লোকেরা কুসংস্কারে বিশ্বাস থেকেই এই মাছ খায়। তাদের একটা লৌকিক কাহিনী থাকে যে, এই মাছ মানুষ ছিল এবং পাপের কারনে তারা মাছে রূপান্তরিত হয়েছে। আবার টেভয়ের কারেনরা বলে যে, ‘যদি কোন মানুষ এই মাছ খায় তবে সে সিংহ হয়ে যাবে’ (Day, 1878)।
তথ্যসূত্র:
১.মোহসিন, এবিএম (অক্টোবর ২০০৯)। “স্বাদুপানির মাছ”। in আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; আবু তৈয়ব, আবু আহমদ; হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ; আহমাদ, মোনাওয়ার। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ২৩ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৩৭–৩৮।আইএসবিএন 984-30000-0286-0
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।