বর্ণনা: আফ্রিকান মাগুর মাছের দেহ লম্বা, চোঙাকৃতির এবং দীর্ঘ পৃষ্ঠ ও পায়ুপাখনা যুক্ত। বক্ষপাখনায় শক্তিশালী কাঁটা থাকে যার বহিঃস্থ পার্শ্ব করাতের ন্যায় ধারালো (Teugels, 1986)। দেহ ত্বক আইশবিহীন ও পিচ্ছিল, পৃষ্ঠ এবং পার্শ্বদেশ কালো বর্ণের। মাথা চ্যাপ্টা, অধিক অস্থি গঠিত, করোটির অস্থি ক্যাপসুলের আকার ধারণ করে। চোখ দুইটি কিছুটা ছোট আকৃতির এবং শুধুমাত্র নাসায় ও ম্যাক্রিলায় স্পর্শী থাকে।
দেহের পৃষ্ঠভাগ গাঢ় ধূসর বা কালো বর্ণের কিন্তু অংকীয়দেশ ক্রীমের ন্যায়। পূর্ণবয়স্ক মাছের মাথায় এক পার্শ্বে লম্বালম্বি কালো রেখা থাকে; যদিও তরুণ মাছে তা অনুপস্থিত। পরিণত মাছের মাথায় ঘন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানা দেখা গেলেও তরুণ মাছে তা মসৃণ থাকে। মাথাটি বৃহৎ, অবনমিত এবং ভারী অস্থিযুক্ত। মুখ কিছুটা বৃহৎ আকৃতির যা প্রায় প্রান্তীয়ভাবে অবস্থান করে। একটি পরিণত মাছ ১.৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয় এবং ওজনে ৫৯ কেজি হয়ে থাকে (Skelton, 1993)।
স্বভাব ও আবাসস্থল: আফ্রিকান মাগুর সর্বভুক প্রজাতির মাছ, স্বাদুপানির অভ্যন্তরেই এদের অভিপ্রায়ন ঘটে, তলদেশবাসী এবং অধিকাংশ খাবার এখান থেকেই গ্রহন করে। তবে মাঝে মাঝে পানির উপরিতল থেকে খাবার খায়। ব্যাপক প্রতিকূল পরিবেশ সহ্য করতে পারে। এদের দেহে অতিরিক্ত শ্বসন অঙ্গ থাকে যেটি দ্বারা এরা খুব সক্রিয় অবস্থায় বা খুব শুষ্ক আবহাওয়ায় বায়ু থেকে শ্বাস নিতে সক্ষম। আবার এদের দেহ থেকে এক প্রকার মিউকাস নিঃসৃত হয় যা দেহকে পিচ্ছল রাখতে এমনকি শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে গর্ত করতে সহায়তা করে।
এরা শিকারী মাছ, সাধারণত ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙ এবং সাপ শিকার করে বা সহজেই পাওয়া যায় এমন কিছু খায়। উত্তর আফ্রিকার এই ক্যাটফিশ বিভিন্ন রকম স্বাদুপানির পরিবেশে বাস করে, যেমন- হ্রদ, পুকুর এবং খাড়ি প্রভৃতি। আবার স্রোতযুক্ত নদী ও আবদ্ধ জলাধারেও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। খোলা পানিতে বাস করতে অভ্যস্থ এবং ৮ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।
পুকুরের কর্দমাক্ত উপাদানের মধ্যে থাকে এবং মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে বাতাস নেয়। রাতের বেলা খাবারের খোঁজে শক্তিশালী বক্ষপাখনার সাহায্যে স্থলভাগে উঠে আসতে পারে, আবার প্রজননের জন্য খুব অল্প পানিযুক্ত স্থান দিয়ে বেরিয়ে যেতে সক্ষম। প্রধানত স্থির পানির জলাধার, হ্রদ এবং খাড়িতে থাকে, তবে তীব্র স্রোতযুক্ত জলাশয়েও পাওয়া যায় ।
বিস্তৃতি: সমগ্র পৃথিবীতেই ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এই প্রজাতির মাছ বাংলাদেশসহ এশিয়ার কিছু কিছু দেশ মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে প্রবেশ করেছে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব: আফ্রিকান মাগুর মাছের পোনা ১৯৯০ সালে অ্যাকুয়াকালচারের জন্য থাই পাঙ্গাসের সঙ্গে থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে আসে। মানুষের খাবারের জন্য এটি একটি ভাল উৎস। এদের দৈহিক ও বৃদ্ধি খাবারের প্রাচুর্যতার উপর নির্ভর করে এবং প্রতি বছরে ২-৩ কেজি বৃদ্ধি পায় এমন প্রচুর উপাত্ত পাওয়া যায়। সমগ্র এশিয়াতেই সনাতন পদ্ধতিতে এই মাছের চাষ হয় (Ali and Jauncey,20)4)। ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে এই প্রজাতির ব্যাপক চাষ শুরু হয়েছিল।
দানবীয় আকৃতির ৩৪ কেজি মাগুর ঢাকার বাজারে প্রায়ই বিক্রি হত। এই মাছ অধিক বর্ধনশীল এবং দেখতে বিশ্রি হওয়ায় লোকজন পছন্দ করে না। এই বিষয়টি বিবেচনা করেই মৎস্য চাষীরা এই মাছটি যখন দেশীয় মাগুর মাছের সমান হয় তখন বাজারজাত করতে শুরু করে। কিন্তু সম্প্রতি এই মাছের চাষ ব্যাপকহারে কমে গিয়েছে।
বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা: যদিও উত্তর আফ্রিকার এই মাছটি সমগ্র পৃথিবীতেই ব্যাপকহারে চাষ করা হয়, তারপরও প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসরত দেশী মাছের জন্য এর ক্ষতিকর প্রভাব থাকে। উত্তর আফ্রিকার ক্যাটফিশ দেশী ক্যাটফিশের সঙ্গে প্রজনন করে, তবে তাদের মধ্যে যখন ব্যাক ক্রস’ ঘটে তখন তাদের বংশধররা কিছুটা বন্ধ্যা হয় (Na-nakorn et al., 2004)।
এদের আরেকটি ক্ষতিকর প্রভাব হলো এ জাতীয় মৎস্য খামারে ব্যবহৃত বর্জ্য চারিদিকের বাস্তুতন্ত্রে প্রভাব ফেলে। মৎস্য খামারের নিকটে প্রচুর পরিমাণে খাবার ও প্রাণীর বর্জ্য উপাদান থাকে যেগুলি মাছের সাহায্যে ছড়িয়ে যায় এবং পরবর্তীতে দূরবর্তী স্থানে জমা হয়। বর্জ্য পদার্থের এই বিস্তৃতি জলজ পরিবেশে বিরুপ প্রভাব ফেলে যা প্রকারান্তরে বিভিন্ন প্রকার মাছ, ক্রাস্টেশিয়ান, মোলাস্কসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্যগ্রহনের হার বা সক্রিয়তা কমিয়ে দেয়। | (Sara et al, 2004)। আবার এই প্রজাতিটি ধানক্ষেতে পুষ্টি উপাদানের পুনঃরুপান্তর (recycling) করে। মাছের বর্জ্যের মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান পুকুর থেকে ধানক্ষেতে যায় যা ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করে (d oultremont and Gutierrez, 2002)।
বর্তমান অবস্থা এবং সংরক্ষণ: IUCN Bangladesh | (2000) এর লাল তালিকায় এই প্রজাতির উপাত্তের অভাবের কথা উল্লেখ থাকে।
মন্তব্য: থাইল্যান্ড থেকে C. gariepinus মাছের পোনা বাংলাদেশে আমদানির পর প্রথমে গুলশান, টঙ্গী এবং নাটরের মৎস্য খামারে এবং ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে ছাড়া হয়েছিল তখন এটি DoF এবং BAU হ্যাচারি ও খামারে দ্রুত প্রজনন করে এবং এর পোনা সমগ্র বাংলাদেশেই মৎস্য চাষীদের নিকট বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করে। কিছু জীব বিজ্ঞানী এবং মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে এই মাছের আগমনের উপর তাদের বিভিন্ন রকম মতামত প্রকাশ করে। তখন তারা বলতে থাকে যে, এই প্রজাতি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন থাকে কেননা এটি যেখানে চাষ করা হচ্ছে তার চারপার্শ্বের প্রাকৃতিক জলাশয়ে যদি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তখন তার প্রভাব কি হবে তা ভেবে দেখা দরকার।
তথ্যসূত্র:
১.গাউছিয়া ওয়াহিদুন্নেছা চৌধুরী, এ কে আতাউর রহমান (অক্টোবর ২০০৯)। “স্বাদুপানির মাছ”। আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; আবু তৈয়ব, আবু আহমদ; হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ; আহমাদ, মোনাওয়ার। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ২৩ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ১৯১–১৯২। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Bernard DUPONT
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।