বর্ণনা: রুই মাছের দেহ মধ্যম লম্বা। পৃষ্ঠদেশ অংকীয় দেশের তুলনায় অধিক উত্তল । তুন্ড ভোতা ,মুখের সামনে বর্ধিত এবং পার্শ্ব লোববিহীন । চোখ দুইটি ছোট যা মাথার নিচ থেকে দেখা যায়। তুন্ড ছিদ্রযুক্ত নয় । মুখ ছোট, অবনত; ঠোট পুরু এবং ঝুলন্ত কিন্তু প্রত্যেক ঠোটে কোনো সুস্পষ্ট অন্তঃস্থ ভাজ থাকে। পশ্চাৎ ওষ্ঠীয় খাজ নিরবিচ্ছন্ন। ম্যাক্রিলায় একজোড়া ছোট ষ্পৃর্ষী বিদ্যমান। অন্তঃঅক্ষি কোটরীয় স্থান উত্তল । প্রশস্ত ফুলকা রন্দ্র থাকে; ফুলকা দন্তিকা সূক্ষ ও অসংখ্য যা পরস্পরের খুব সন্নিকটে অবস্থিত। পৃষ্ঠ পাখনা পায়ু পাখনার গোড়া পর্যন্ত বর্ধিত এবং তুন্ড শীর্ষেও মাঝামাঝি অবস্থানে শুরু হয় ; পৃষ্ঠ পাখনার উপরের কিনারা অবতল। বক্ষ পাখনা মাথার তুলনায় খাটো । শ্রোণী পাখনা পুচ্ছ পাখনার গোড়া ও তুন্ড শীর্ষের মধ্যবর্তী স্থানে উৎপন্ন হয়। তবে পায়ু পাখনা পর্যন্ত বিস্তৃত নয়। পায়ু পাখনা পুচ্ছ পাখনার গোড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। পুচ্ছ ডাটা ছোট এবং পুচ্ছ পাখনা গভীরভাবে দ্বিবিভক্ত। পার্শ্বরেখা সম্পূর্ন এবং ৪১ থেকে ৪২ টি আঁইশ নিয়ে গঠিত; শ্রোণী পাখনার গোড়া এবং পার্শ্বরেখার মধ্যবর্তী স্থানে ৬ থেকে ৬.৫ সারি আঁইশ; পৃষ্ঠ পাখনার সম্মুখ গোড়া থেকে পার্শ্বরেখা পর্যন্ত ৭ থেকে ৭.৫ সারি কিন্তু পৃষ্ঠপাখনার পূর্বে ১৪ সারি আঁইশ বিদ্যমান। এদের পৃষ্ঠ বরাবর বাদামী থেকে নীলাভ কিন্তু দেহের নিচে ও পার্শ্বদিকে দেখতে রুপালি বর্ণের। প্রজনন ঋতুতে প্রত্যেক আঁইশের কিনারা কালো এবং কেন্দ্র লাল বর্ণ ধারন করে। পাখনা ধূসর বাকানো, বক্ষ পাখনা ফ্যাকাশে বর্ণের। এই মাছের দেহের রং তাদের আবাস স্থল অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। যেগুলো জলজ আগাছাযুক্ত জলাশয়ে বাস করে। তাদের গায়ের রং সবুজাভ-কালো হয় (Talwar and Jhingrill, 1991)। এরা একমিটার পর্যন্ত লম্বা হয় ।
স্বভাব ও আবাসস্থল: জলাশয়ের মধ্যম স্তর থেকে খাবার সংগ্রহ করে। সাধারণত উদ্ভিজ উপাদান এবং গলিত ও পচা আবর্জনা খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে (Talwar and Jhingram , 1991)। রুই মাছ শৈবাল, উচু উদ্ভিদ, এককোষী প্রাণী, পোকামাকড়ের লার্ভা,ক্রাস্টেশিয়ান , কাদা ও বালি খায় (Mukerjee et al., 1946)। মৎস্য চাষে এই প্রজাতির মাছের জন্য অতিরিক্ত খাবার হিসেবে ধানের কুঁড়া, গমের কুঁড়া, খৈল প্রভৃতি দেওয়া হয় । এই মাছ স্বভাবিকভাবে দিনের বেলায় একাকী চলাচল করে তবে মাঝে মাঝে এদের গর্ত তৈরি করতেও দেখা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম মেীসুমী বায়ু প্রবাহের সাথে সাথে বিশেষ করে মে থেকে জুলাই মাসে এদের প্রজনন শুরু হয়।
এরা নদী বা স্রোতযুক্ত জলাশয়ের অগভীর অংশে ডিম ছাড়ে। এই মাছ অধিক উৎপাদনশীল এবং গড়ে প্রায় ২,৬০,৯৭২ থেকে ২৯,৮৪,০২৪ টি ডিম দেয় (Rahman , 2005)। এটি মূলত নদীর মাছ এবং ভারতীয় মেজর কার্পের অন্যতম প্রধান সদস্য। আবার এই প্রজাতির মাছ বিল, গভীর ডোবা, পরিস্কার ও মৃদু স্রোতযুক্ত জলাধার, পুকুর, চৌবাচ্চা, প্লাবিত ধানক্ষেত এবং প্লাবন সমভূমিতেও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। আমাদের দেশে পুকুর এবং অন্যান্য বদ্ধ জলাশয়ে সনাতন পদ্ধতিতে এই মাছের চাষ করা হয়।
বিস্তৃতি: উত্তর ও কেন্দ্রীয় ভারতের মিঠাপানির জলাশয়, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ও মায়ানমারের ‘তেরাই’ অঞ্চল পরবর্তীতে ভূটান, চীনের মূল ভূখন্ড, জাপান, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মেরিতানিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং জিম্বাবুয়েসহ অনেক দেশেই এই মাছের চাষ শুরু হয়।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব: Labeo গনের প্রজাতি সমূহের মধ্যে রুই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এটি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং খাদ্য হিসেবেও বাংলাদেশসহ অন্যান্য। দেশে এর বেশ চাহিদা থাকে। বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত মৎস্যসম্পদে L rohitaসহ অন্যান্য মেজরকার্প যেমন CatlaCatla এবং cirr/tinuscirrhoss প্রভৃতি মাছের অবদান শতকরা ২২.৬ ভাগ বা ৪,৭৫০০০ মেট্রিকটন ।। তবে এর বেশির ভাগ অংশই আসে মৎস্য খামার থেকে। পুকুর, চৌবাচ্চা, জলাধার এবং এ্যাকুয়াকালচারের জন্য। পাড়যুক্ত সমতল ভূমি প্রভৃতিতে অন্যান্য মেজরকার্প ও বহিদেশীয় মাছের সঙ্গে একত্রে চাষ করা হয়।
প্রতিবছর এদের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা এবং হালদা নদী থেকে প্রচুর পরিমানে রেণু পোনা সংগ্রহ করে। মৎস্য চাষের জন্য লালন পুকুরে ধানী পোনা তৈরি করা হয়। আবার মাছ চাষের জন্য বীজের চাহিদা পূরণ করতে । মৎস্য খামারে সনাতন পদ্ধতিতে কৃত্রিমভাবে এই মাছের পোনা উৎপাদন করা হয়। এই মাছ খেতে তুলনামূলকভাবে সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি হয়। সারা বছরই বাজারে এই মাছ পাওয়া যায় । তবে বাজারে বেশির। ভাগ অংশ আসে মৎস্য চাষ থেকে । পুকুরে এদের সর্বাধিক। বৃদ্ধি ঘটে প্রথম বছরে (Bhuiyan , 1964); তবে পুকুরের । তুলনায় ধানক্ষেতেই এই মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় (Hora , 1951)। এরা দুই বছরে যৌন পরিপূর্ণ তা লাভ করে। সৌখিন মৎস্য শিকারের জন্য Rohita খুবই জনপ্রিয় মাছ। বরশী দিয়ে যখন এই মাছ ধরা হয় তখন এরা ছাড়া পাওয়ার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। নদী এবং বিলে টানা জাল দিয়েও এই মাছ ধরা হয়।
বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা: রুই মাছ পানির তলদেশ এবং মধ্যম স্তর থেকে খাবার সংগ্রহ করে। প্রধানত উদ্ভিজ উপাদান এবং গলিত ও পচা খাবার খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে। তবে এরা খাদ্য বা আবাসস্থল নিয়ে অন্যান্য কার্প প্রজাতির সাথে প্রতিয়োগিতায় অবতীর্ন হয় না।
বর্তমান অবস্থা এবং সংরক্ষণ: বাংলাদেশে এই প্রজাতির মাছ সচরাচর পাওয়া যায় এবং ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। IUCN Bangladesh (20OO) এর লাল তালিকা অনুযায়ী এটি এখনও হুমকির সম্মুখীন নয়। তাছাড়া চাষকৃত মাছের মজুদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই প্রজাতির মাছ তার নিজস্ব প্রাকৃতিক আবাসস্থলের বাইরেও বিস্তার লাভ করেছে। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের নদী , বিল ও হাওড় থেকে মোট আহরিত মৎস্যসম্পদে L rohita সহ অন্যান্য মেজরকার্পের অবদান ছিল শতকরা ৬০ ভাগ। কিন্তু পরবর্তিতে বন্যা নিয়ন্ত্রয়নের জন্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতির ফলে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ও খাদ্যগ্রহন স্থল উভয়ই ধ্বংস হয়েছে। ফলশ্রুতিতে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে প্রাকৃতিকভাবে পোনা আহোরন ও পরিণত মাছ ধরা ব্যাপক হারে কমে গিয়েছে। তবে আহোরিত কার্পের বড় অংশই আসে চাষ থেকে। তাই রুই মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি বা সংরক্ষণের জন্য ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা ও হালদা নদীর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ক্ষেত্রে অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরী।
মন্তব্য: বাংলায় একটি প্রবাদ আছে যে, ‘মাছের রাজা রুই আর শাকের রাজা পুঁই’। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠানে সুস্বাদু খাবার হিসেবে এই মাছ পরিবেশন করা হয়। এরা মোটামুটি দীর্ঘজীবি এবং প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। এটি সৌখিন মৎস্য শিকারের জন্যও উপযুক্ত মাছ। পুকুরে বর্তমান পদ্ধতির মাছ চাষ এই মাছের। উৎপাদন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই মাছ বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। Argulus এই মাছের অতি পরিচিত বহিঃপরজীবি যা কপেপড নামে পরিচিত এবং এরা প্রায়ই পুকুর বা হ্রদে মাছের মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দেয় (Rahman, 2005)। তবে Lermaea গণের আরও চারটি বহিঃপরজীবি আছে যাদের দ্বারাও মাঝে মাঝে মাছ আক্রান্ত হতে পারে। এই প্রজাতির ডিপ্লয়েড ক্রোমোজম সংখ্যা ৫০ পাওয়া গিয়েছে ।
তথ্যসূত্র:
১. পারভীন, সেলিনা (অক্টোবর ২০০৯)। “স্বাদুপানির মাছ”। আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; আবু তৈয়ব, আবু আহমদ; হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ; আহমাদ, মোনাওয়ার। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ২৩ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৮৬–৮৯। আইএসবিএন 984-30000-0286-0
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।