দেশি পাঙ্গাশ বাংলাদেশের মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছ

মাছ

দেশি পাঙ্গাশ

বৈজ্ঞানিক নাম: Pangasius pangasius (Hamilton, 1822) সমনাম: Pimelodus pangasius Hamilton, 1822, Fishes of the Ganges, p. 163; Pangasius buchanani Valenciennes, 1840, Hist. Nat. Poiss.15: 45; Pangasius pangasius Hora, 1938, J. Bombay Nat. Hist. Soc. 40(3): 362. Pangasius pangasius godavarii David, 1962, Proc. Indian Acad. Sci. 56(3): 151; Pangasius pangasius upiensis Srivastava, 1968, Fishes of Eastern Uttar Pradesh, p. 97. ইংরেজি নাম: Pungas, Yellowtail Catfish, Pungas Catfish. স্থানীয় নাম: দেশি পাঙ্গাশ, পাঙ্গাওয়াশ 
জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাস 
জগৎ: Animalia পর্ব: Chordata শ্রেণী: Actinopterygii বর্গ: Siluriformes পরিবার: Pangasiidae গণ: Pangasius প্রজাতি: P. pangasius

বর্ণনা: মাথাটি মুখের কোণের পিছনে তার দৈর্ঘ্যের সমান বিস্তৃত। তুন্ড প্রায় গোলাকার। চোখ সরু চর্বি গঠিত পাতাযুক্ত এবং আংশিকভাবে মুখের কোণের নিচের স্তরে অবস্থিত। অক্রিপিটাল প্রসেস শক্তিশালী, প্রশস্ত, গোড়ার দিকে বিস্তৃতির তিন গুন লম্বা যা পৃষ্ঠপাখনার গোড়ার অস্থি পর্যন্ত বিস্তৃত। মাথার উপরে বিদ্যমান মধ্যম খাঁজটি অগভীর যা অক্রিপিটাল প্রসেস পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।

তালু ও ভোমারে অবস্থিত দাঁত ভিলি আকৃতির এবং সারিবদ্ধ অবস্থায় থাকে। তালু এবং ভোমারের দাঁত দুইটি অর্ধ-বৃত্তাকার সংলগ্ন প্যাচে বিন্যস্ত। ফুলকাপর্দা গভীরভাবে খাঁজযুক্ত, পরস্পর থেকে মুক্ত এবং যোজক থেকে পৃথক। ২ জোড়া স্পর্শী বিদ্যমান, ম্যাক্রিলায় অবস্থিত স্পর্শী জোড়া দৈর্ঘ্যে বক্ষপাখনার মাঝ বরাবর পশ্চাৎ গোড়া পর্যন্ত প্রসারিত হয়, ম্যান্ডিবলের জোড়া অপেক্ষাকৃত খাটো যা ফুলকারন্ধ্রের সামান্য পিছন পর্যন্ত প্রসারিত।

পৃষ্ঠকাটা মাঝারি, শক্তিশালী। বক্ষকাটা পৃষ্ঠকাটার তুলনায় অধিক শক্তিশালী যা সম্মুখে ধারালো কিন্তু পশ্চাতে ছোট ছোট দাঁতযুক্ত। পুচ্ছপাখনা দ্বিবিভক্ত। চর্বিযুক্ত পাখনা ছোট। পার্শ্বরেখা সম্পূর্ণ (Bhuiyan, 1964) দেহের পৃষ্ঠভাগ ঈষৎ হলুদাভ-সবুজ, পার্শ্বদিক থেকে রুপালি রক্তবর্ণের প্রতিফলন আসে, মাথার পার্শ্বভাগ সোনালি আভাযুক্ত, পাখনাগুলো হালকা লালচে-হলুদ বর্ণের হয়। এই মাছ ১.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয় (Talwar and Jhingran, 1991 )।

আরো পড়ুন:  সরপুঁটি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জনপ্রিয় সুস্বাদু মাছ

স্বভাব ও আবাসস্থল: দেশি পাঙ্গাশ রাক্ষুসে প্রকৃতির মাছ। স্বাদুপানি থেকে স্বাদুপানিতে অভিপ্রায়ন ঘটে। বর্ষার সময় মোহনা অঞ্চলে এদের প্রজনন ঘটে। মৃত ও গন্ধযুক্ত প্রাণী এবং উদ্ভিজ উপাদান সহ অ্যাপিড,আইসোপড়, কাদার ক্রাস্টেশিয়ান, পোকামাকড় এবং ছোট ছোট মাচ খেয়ে বেঁচে থাকে। এদেরকে বড় বড় নদীর নিচু অংশ এবং মোহনায় পাওয়া যায়। তরুণ মাছ স্বাদুপানিতে যেখানে জোয়ার-ভাটার প্রভাব থাকে সেখানে বাস করে, মাঝারি বয়সের মাছ ঈষৎ লোনা পানিতে থাকে, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক মাছগুলো পরবর্তীতে নদীমুখ ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে চলে যায় (Rainboth, 1996)।

বিস্তৃতি: সমগ্র বাংলাদেশেই বড় বড় নদী এবং মোহনায় পাওয়া যায়। ভারতের বড় বড় নদী এবং জলাশয়ে এই মাছ দেখা যায়। আবার পাকিস্তান এবং মায়ানমারেও এই প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব: P pangasius বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আহোরিত মৎস্য সম্পদে ক্যাটফিশের অন্যান্য মাছ যেমন-রিটা, বোয়াল, শিং, আইড় এবং বাচাসহ এই প্রজাতির অবদান প্রায় শতকরা ১.৭৬ ভাগ বা ৩৭০৩৭ মেট্রিক টন (FRSS, 2004-05)। শীতকালে এই প্রজাতির মাছ ব্যাপক হারে ধরা পড়ে এবং বড়শি দিয়ে ধরা মৎস্য শিকারীদের নিকট খুবই জনপ্রিয়। পরিণত মাছে প্রচুর তেল থাকে এবং কোনো অন্তঃপেশীয় কাঁটা থাকে না থাকায় লোকজন এটি খেতে খুবই পছন্দ করে। বাজারে টাটকা মাছ বিক্রি হয়।

দেশীয় P. pangasius প্রজাতি বাণিজ্যিকভাবে পুকুরে চাষ করা হয়, তবে বাংলাদেশের মৎস্য চাষীরা বর্হিদেশীয় থাই পাঙ্গাস (P. zypophthalauds) নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করে থাকে। P pangasius প্রজাতির ধানী এবং অঙ্গুলী পোনা পাওয়া যাওয়ায় সনাতন পদ্ধতিতে এই মাছের চাষ হয় না। চাঁদপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট এই মাছের কৃত্রিম প্রজননের চেষ্টা করেছিল যা সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়।

বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা: এই মাছ মৃত ও পঁচা গন্ধযুক্ত প্রাণী এবং উদ্ভিজ উপাদান খেয়ে জলজ বাস্তুতন্ত্রের তলদেশ পরিষ্কার রাখে।

আরো পড়ুন:  সরপুঁটি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জনপ্রিয় সুস্বাদু মাছ

বর্তমান অবস্থা এবং সংরক্ষণ: এটি IUCN Bangladesh (2000) এর লাল তালিকায় মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। খাদ্যগ্রহন স্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র কমে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান মৎস্য আহোরণ এই প্রজাতির জন্য হুমকীস্বরুপ। তাই এই মাছের নির্দিষ্ট প্রজনন ও লালন ক্ষেত্রের সুবিধাজনক স্থানে অভয়ারন্য প্রতিষ্ঠা এবং মৎস্য আইনের সঠিক প্রয়োগই এই প্রজাতি সংরক্ষণের সম্ভাব্য উপায় হতে পারে।।

মন্তব্য: স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ‘শিলবিড ক্যাটফিশ’ যেমন Silonia silondia এর সঙ্গে এই প্রজাতির সাদৃশ্য থাকে। কিন্তু এদের চোয়ালে ছেদন দন্তের অনুপস্থিতি এবং ২ জোড়া সুগঠিত স্পর্শী থাকায় সহজেই অন্যটি থেকে পৃথক করা যায়। ভারতে এই প্রজাতির ডিপ্লয়েড ক্রোমোজোম সংখ্যা ৫৮ থেকে ৬২ পাওয়া গিয়েছে। এটি মাঝে মাঝে। Contracaecum, Gymnorhynchus এবং Cuculanus পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত হয়।

তথ্যসূত্র:

১. এ কে আতাউর রহমান, ফারহানা রুমা (অক্টোবর ২০০৯)। “স্বাদুপানির মাছ“। আহমেদ, জিয়া উদ্দিন; আবু তৈয়ব, আবু আহমদ; হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মোহাম্মদ; আহমাদ, মোনাওয়ার। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। ২৩ (১ সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ১৬৭–১৬৮। আইএসবিএন 984-30000-0286-0

বি. দ্র: ব্যবহৃত ছবি উইকিপিডিয়া কমন্স থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোকচিত্রীর নাম: Staticd

Leave a Comment

error: Content is protected !!