পৃথিবীর মহাবিপন্ন প্রাণি বাংলার রাজকীয় বাঘ। এই প্রাণিটির সাথে বাঙলার নাম জড়িত। এই প্রাণিটিকে বাঁচাতেই হবে। কিন্তু বাস্তবতা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। এই বাঘ প্রায়ই গ্রামবাসির হাতে বেঘোরে প্রাণ হারায়। প্রায় খবরে দেখা যায় বাঘ এক জেলেকে ধরে নিয়ে যেতে থাকলে সে চিৎকার করে এবং গ্রামবাসী সাহায্য করতে এসে বাঘটিকে লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। বন বিভাগ বা কর্তৃপক্ষ গ্রামবাসীকে বাঘটিকে হত্যা না করার জন্য লোক পাঠানোর আগেই গ্রামবাসীদের আক্রমণে বাঘটি মারা যায়। এছাড়া বাঘের চামড়া পাচার, বাঘের দেহ থেকে ভুয়া ঔষধ তৈরির প্রলোভনে বাঘ মারা পড়ছে। এছাড়া বাঘের বাচ্চার চাহিদা রয়েছে চিড়িয়াখানায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চিড়িয়াখানাগুলো অবৈধভাবে বাঘ ক্রয়ের চেষ্টাও করে।
এক খবরে দেখা যায় সুন্দরবনে ১৬ বছরে ৪১ বাঘ হত্যা, হাড়-চামড়া পাচার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কৌশলে বাঘ শিকার করে এর হাড্ডি, চামড়া ও দাঁত পাচার করে চলেছে সংঘবদ্ধ চক্র। বন বিভাগের রেকর্ড অনুযায়ি ১৯৮১-২০১২ সাল পর্যন্ত ১০৩ টি বাঘ হত্যার শিকার হয়েছে। ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৭ ও ১৯৯৫ সালে সুন্দরবনে কোন বাঘ মৃত্যুর ঘটনা নেই। এছাড়া ১৯৮৩ সালে ৫টি, ১৯৮৬ সালে ৪টি, ১৯৮৮ সালে ৪টি, ১৯৯০ সালে ৬টি, ১৯৯১ সালে ৬টি, ১৯৯২ সালে ৪টি, ১৯৯৩ সালে ৬টি, ১৯৯৪ সালে ৪টি, ১৯৯৬ সালে ৫টি, ১৯৯৭ সালে ৮টি, ১৯৯৮ সালে ৬টি, ১৯৯৯ সালে ৬টি, ২০০০সালে ৫টি, ২০০১ সালে ৪টি, ২০০২সালে ৬টি, ২০০৩ সালে ৬টি এবং ২০০৪ সালে ৬টি, ২০০৫ সালে ১০টি এবং ২০০৭ সালে ৪টি এবং ২০০৯ সালে ৫টি বাঘ প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৯৭ সালে সবচেয়ে বেশি বাঘের প্রাণহাণি হয়েছে ৮টি। তবে এ সংখ্যা আরো বেশী হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা। বাঘ হত্যার তালিকার শীর্ষে রয়েছে চাঁদপাই রেঞ্জ।
আর ভারতে গত ২০১৩ সালে মোট বাঘ হত্যা হয়েছে ৩৯ টি। তবে নাগপুর অঞ্চলে ২০টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয় এবং সেটি সেগুলো ধরলে মোট সংখ্যা হয় ৫৯ টি। Wildlife Protection society of India’র তথ্য অনুসারে ২০১৩-তে মোট বাঘ হত্যা ৭৬টি হতে পারে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে, গত ২০১২ সালের ৬ নভেম্বর মংলার ঢাংমারিতে একটি বাঘকে হত্যা করা হয়। এরপর বাঘের চারটি বড় দাঁত (ক্যানাইন) চার লাখ টাকায় বিক্রির চেষ্টা করে পাচারকারীরা। এ অবস্থায় RAB ৩টি দাঁতসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করে।
গত ১৫ ডিসেম্বর, ২০১২ পশ্চিম সুন্দরবনের জয়খালিতে উদ্ধার হওয়া মৃত বাঘটির মাথা ও চার পা আগেই কেটে নেয়া হয়। সূত্র অনুযায়ী, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে পাচারের সময় ৪টি বাঘের মাথা, ৩টি চামড়া ও ৩২ কেজি হাড় উদ্ধার হয়। ২০০৯ সালের ২৬ আগস্ট খুলনা মহানগরীর ময়লাপোতা থেকে RAB বাঘের চামড়াসহ ৪ জনকে আটক করে। এছাড়া গত ৯ ও ৩১ ডিসেম্বর মংলার ঢাংমারী থেকে বাঘের তিনটি দাঁতসহ দু’জন আটক হয়।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় স্ট্রেনদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন প্রকল্প এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকোটুরিজম উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পাচার রোধে ২০০১ সাল থেকে এ অঞ্চলে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত দু’বছরে এই বিভাগ ১১৪৫টি কচ্ছপ, ১১টি হনুমান, ৩টি মেছোবাঘ, ৪টি অজগর সাপ, ১টি গন্ধ গকুল ও বাঘের দাঁত উদ্ধার করেছে।
কমছে বাঘ: সুন্দরবনে ২৭ বছরে বাঘ বাড়েনি, বরং কমেছে। আর ২০১৫ সালে সরকারের বন বিভাগ প্রকাশিত জরিপে দেখা গেছে, বাঘের সংখ্যা ১০৬। ইউএনডিপির ২০০৬ সালের পরিসংখ্যানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪২টি, ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩রা মার্চ পর্যন্ত সরকারি বাঘগণনা প্রতিবেদনে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। এর আগে ১৯৯৩-৯৪ সালে এ-সংখ্যা ছিল ৩৬২।
২০১৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক আবদুল আজিজের নেতৃত্বে ৫৬ জন গবেষক সুন্দরবনের ১ হাজার ৯৯৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপের কাজ শুরু করেন। তাঁরা বাঘের মল ও লোমের ৪৪০টি নমুনা সংগ্রহ করেন। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নমুনাগুলো বাংলা বাঘের কি না, তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবার জন্য নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামের ইউরোফিনস জিনোমিকস সেন্টারে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ২৩৩টি নমুনা বাংলা বাঘের বলে নিশ্চিত করা হয়। এরপর এসব নমুনা কয়টি বাঘের, তা নিশ্চিত করতে সব ডিএনএ তথ্য পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের (এনসিবিআই) কাছে। তারা ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণ করে জানায় যে এসব বাঘ হচ্ছে সুন্দরবনের বাঘের।
এরপর ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবিএস জিনোমিকস বিভাগের পরীক্ষাগারে বাঘের মল ও লোমের ওই নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষক দল নিশ্চিত হয় সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২১।[১]
গবেষকরা বলছেন বাস্তবে বাঘের সংখ্যা অনেক অনেক কম। প্রাণীবিদ মনিরুল এইচ খানের মতে, ক্যামেরা ট্যাপিং পদ্ধতিতে নতুন বাঘ শুমারীতে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা পাওয়া গেছে ২শ’টি এবং ভারতীয় অংশে ১শ’ থেকে ১৫০টি। তার মতে, পায়ের ছাপ গণনা পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে যে শুমারী করা হয় তাতে একই বাঘের একাধিক পায়ের ছাপ গণনায় আসার আশঙ্কা থাকে। বন বিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনের শরণখোলা, চাঁদপাই, খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে তুলনামূলক বেশি বাঘ হত্যা করা হয়। ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্যারাবন যা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবংগজুড়ে বিস্তৃত।
তথ্যসূত্র:
১ ইফতেখার মাহমুদ, ৩০ অক্টোবর, ২০১৭, সুন্দরবনে বাঘ কমছে, লিংক http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1354776/
রচনাকালঃ ১৫ জানুয়ারি ২০১৩।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।