ভুমিকা: লোনা পানির কুমির ক্রোকডাইলুস গণে মাংসাশী শিকারি প্রজাতি। এদের লেজ পেশীবহুল। এটি বাংলাদেশে মহাবিপন্ন এবং বিশ্বে সংকটাপন্ন বা হুমকির সম্মুখীন।
বর্ণনা: লবনাক্ত পানির কুমির Crocodylus porosus পৃথিবীর জীবন্ত সরীসৃপদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ কুমিরের দৈর্ঘ্য ৫-৭ মিটার, এর ওজন ৪০০-১০০০ কেজি। স্ত্রী কুমির অনেক ছোট, দৈর্ঘ্য সাধারণত ৩ মিটার। দেহ অস্থিযুক্ত প্লেট দ্বারা আবৃত থাকে; প্রাপ্তবয়স্ক কুমিরের শীর্ষ কালো, কিছু অংশ ধূসর রঙের এবং flanks কালো দাগ থাকে এবং উদর ক্রীম হলুদ থেকে সাদা রঙের লেজ পার্শ্বীয় ভাবে চাপা, শীর্ষে করাতের ন্যায় দাঁত থাকে এবং ধূরর রঙের।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক কুমিরের ঈষৎ তামাটে এবং কালো দাগ এবং দাগ থাকে। দেহে মজবুত বর্ম থাকে; পৃষ্ঠীয় স্কুট ১৬ বা ১৭টি অনুদৈর্ঘ্য সিরিজে সাজানো থাকে; তুন্ড মজবুত, চোখ থেকে তুন্ডের কেন্দ্র বিন্দু পর্যন্ত এক জোড়া খাঁজ থাকে । চোয়াল মজবুত, প্রিভটের ন্যায় দুদার্ত্ত দাঁত থাকে (প্রতি পার্শ্বে ১৭-১৯টি) মুখবদ্ধ অবস্থায় এরা দেখতে পায়। নিচের চোয়ালের উভয় পার্শ্বের ৪র্থ দাঁত বড় এবং উপরের চোয়ালের খাজের সাথে যুক্ত থাকে। সামনের পায়ে ৫টি আঙ্গুল এবং পিছনের পায়ে ৫টি আঙ্গুল থাকে । সামনের পায়ের আঙ্গুলের ভিত্তিতে লিপ্তপদ থাকে এবং পিছনের পায়ের বাহিরের আঙ্গুলে প্রশস্ত লিপ্তপদ থাকে। চোখে নেত্রপল্লব থাকে। তুন্ডের উপরিভাগে ভালবযুক্ত নাসারুদ্ধ থাকে এবং ভঁজযুক্ত কানের ছিদ্র পানিতে অর্ধনিমজ্জিত থাকতে সাহায্যে করে (Tikader, 1983; Sharma, 1998; Carpenter and Niem, 2001)
স্বভাব ও আবাসস্থল: লোনা পানিতে বসবাসকারী এই কুমির উপকূলীয় এলাকায় অল্প লবনাক্ত পানি ও নদীতে বসবাস করে। উপকূলীয় এলাকায় ম্যানক্রোভ জলাশয়ে বাস করে। এরা ধীর গতি সম্পন্ন এবং অন্যান্য কুমির-এর মতো জলাশয় এবং ডাঙ্গায়ও জলে বাস করে। এরা রোদ্র পোহায় এবং শীত থেকে দেহ রক্ষা করার জন্য পানিতে ডুবে থাকে।
এরা সুযোগ সন্ধানী খাদ্য গ্রহণকারী দিনের বেলা ও রাত্রি বেলায় খাদ্য গ্রহণ করে। এরা খাদ্য হিসেবে বন্য প্রাণী হরিণ, বানর, গৃহপালিত জীবজন্তু এমনকি মানুষ গ্রহণ করে। শিকার ধরার ক্ষেত্রে এরা শক্তিশালী চোয়ালের দাঁতের সাহায্যে শিকার আঁকড়ে ধরে এবং কখন ও এরা স্থলভাগে মজবুত সাহায্যে শিকার ধরে। বড় কুমির/বড় প্রাণী নিয়মিত খাদ্য হিসেবে সদ্য পরিস্ফুটিত কুমিরের বাচ্চা বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কুমির গ্রহণ করে।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক কুমির খাদ্য হিসেবে কীটপতঙ্গ, উভচর প্রাণী, ক্রাসটেসিয়া, ছোট সরীসৃপ প্রাণী পাখি এবং মাছ গ্রহণ করে। এরা আবাস স্থলের সীমানা পাহাড়া দেয় এবং অনুপ্রবেশকারী প্রাণীকে গর্জন, grunt এবং cough এবং-এর মাধ্যমে ভয় প্রদর্শন করে। এরা স্বাদুপানিতে প্রজনন কার্য সম্পন্ন করে এবং প্রজনন মৌসুমে বা আবাসস্থলের সীমানা পাহাড়া দেয়ার সময় হিংস্র হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
এরা সাধারণত নভেম্বরে-মার্চ মাসে উদ্ভিদ-স্তুপ এবং কাঁদায় ২৫-৩০টি ডিম পাড়ে ডিমের পরিস্ফুটনকাল ৯০ দিন। যৌন কার্য বাসার তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। পুরুষ কুমিরের বাচ্চা ৩১.৬° সে তাপমাত্রায় পরিস্ফুটিত হয়। স্ত্রী কুমিরের বাচ্চা উচ্চ ও নি তাপমাত্রায় সম্পন্ন হয়। মাতৃ কুমির হিংস্রাত্মকভাবে তাদের বাসা/আবাসস্থল পাহাড়াদেয় জলাশয়ে মুখের কোনো কুমিরের বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং নিদিষ্ঠ সময় পর্যন্ত এদের পাহাড়া দেয়। পুরুষ কুমিরের যৌন পরিপক্কতা লাভের জন্য প্রায় ১৬ বৎসর সময় লাগে এবং স্ত্রী কুমিরের যৌন পরিপক্কতা লাভের জন্য ১০-১২ বৎসর সময় লাগে। (Daniel, 1983; Tikader, 1983; Sharma, 1998; Carpenter and Niem, 2001)
বিস্তার: বাংলাদেশ সুন্দরবন এলাকায় লোনাপানির কুমিরের সর্বশেষ আবাসস্থল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও ভারত, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, Palau, পাপুয়া নিউগিনি, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব: এই লোনা পানির কুমিরের আবাসস্থল পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কুমিরের চামড়ার উচ্চ বাজার মূল্য থাকার কারণে কুমিরের চাষাবাদ অর্থনৈকিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বাস্তুতান্ত্রিক ভূমিকা: উচ্চ শ্রেণীর প্রিডেটর হিসেবে কুমির বাস্তুতন্ত্রে ও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। মৃত মাছ ও প্রাণীর দেহ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে এরা পরিবেশের জন্য scavenger হিসেবে কাজ করে। এরা সাঁতার কাটতে সময় বিভিন্ন গভীরতায় পানির উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখে।
অবস্থান: লোনাপানির এই কুমির বাংলাদেশে মহাবিপন্ন বলে ধরা হয় এবং বিশ্বের সর্বত্র প্রজাতির কুমির হুমকির সম্মুখীন। কুমির চামড়া বিক্রির উদ্দেশ্যে বেআইনীভাবে কুমির শিকার বা আবাসস্থল ধ্বংসের জন্য এই প্রজাতির সংখ্যা কমে যাওয়ার দুইটি মূল কারণ। কুমিরের ডিম সংগ্রহ করা এ প্রজাতির জন্য অতিরিক্ত হুমকিস্বরূপ। এই প্রজাতির কুমিরকে CITES-এর পরিশিষ্ট-১-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (ব্যতিক্রম অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং পাপুয়া নিউ গিনিয়া পরিশিষ্ঠ-২ এ অন্তর্ভুক্ত) এবং বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ আইন ১৯৭৪ এ অন্তর্ভুক্ত।
মন্তব্য: অনেক সময় মানুষের ভন্ডামী আচরণের জন্য ‘crocodile tears’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ।
তথ্যসূত্র:
১. সুপ্রিয় চাকমা (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: উভচর প্রাণী ও সরীসৃপ, খণ্ড: ২৫ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ১৯৭-১৯৮।
জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯। বাংলাদেশের ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজ থেকে বিএ সম্মান ও এমএ পাশ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। বিভিন্ন সাময়িকীতে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে রোদ্দুরে ডট কমের সম্পাদক।