ভূমিকা: দেশি দাঁড়াশ সাপ বা দেশি দারাজ সাপ বা ডাঁড়াশ সাপ বা ধারাজ সাপ (দ্বিপদ নাম: Ptyas mucosa) হচ্ছে কলুব্রিডি পরিবারের টিয়াস গণের একটি সাপের প্রজাতি। এরা এশিয়ার আবাসিক এবং বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক সাপ। বাংলাদেশের সাপের তালিকায় টিয়াস (ইংরেজি: Ptyas) গণে বাংলাদেশে রয়েছে ৩টি প্রজাতি এবং পৃথিবীতেও রয়েছে এই ১৩টি প্রজাতি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত এবং আমাদের আলোচ্য প্রজাতিটি হচ্ছে দেশি দাঁড়াশ সাপ।
দ্বিপদ নাম/Scientific Name: Ptyas mucosa, সমনাম: Coluber mucosus Linnaeus, 1758; Natrix mucosa — Laurenti, 1768; Coluber blumenbachii Merrem, 1820; Coluber dhumna Cantor, 1839; Ptyas blumenbachii — Fitzinger, 1843; Coryphodon blumenbachii — A.M.C. Duméril & Bibron, 1854; Leptophis trifrenatus Hallowell, 1861; Ptyas mucosus — Cope, 1861; Zamenis mucosus — Boulenger, 1890; Zaocys mucosus — Wall, 1921; Ptyas mucosa — David and Das, 2004; বাংলা নাম: দেশি দাঁড়াশ সাপ, দেশি দারাজ সাপ, ডাঁড়াশ সাপ, ধারাজ সাপ, ইংরেজি নাম/Common Name: oriental ratsnake, Indian rat snake, ‘darash’ or dhaman. জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস জগৎ/রাজ্যKingdom: Animalia বিভাগ/Phylum: Chordata উপপর্ব: Vertebrata শ্রেণী/Class: Reptilia বর্গ: Squamata উপবর্গ: Serpentes পরিবার/Family: Colubridae গণ/Genus: Ptyas, Fitzinger, 1843, প্রজাতি/Species: Ptyas mucosa, (Linnaeus, 1758);
বর্ণনা: দেশি দাঁড়াশ সাপের দৈর্ঘ্য দৈর্ঘ প্রায় ৩.৫ মিটার; লেজ সুচালাে, দেহের মােট দৈর্ঘের ২৫-২৯%। দেহ লম্বা এবং নলাকার। দেহ হলুদ, হলদে বাদামী, জলপাই বা ধূসর থেকে কালাে রঙের, দেহের পিছনের অংশে হালকা বা সুস্পষ্ট ব্যান্ড থাকে। দেহের অঙ্কীয়ভাগ হলুদ বা ধূসর সাদা, অঙ্কীয়ভাগ বা নিম্ন-পুচ্ছের প্রান্ত কখনাে কালাে রঙের হয়। ঠোট ও গলা সাদাটে এবং ঠোটের আঁইশ লম্বা রেখার মাধ্যমে পৃথক।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক সাপ ঈষৎ জলপাই রঙের এবং দেহের সম্মুখভাগে কালাে আড়াআড়ি ব্যান্ড থাকে। ম্যাক্সিলারী দাঁতের সংখ্যা ২৫টি পর্যন্ত হতে পারে। আঁইশ মসৃণ বা উপরের সারির আঁইশ মােটামুটি সুস্পষ্ট শিরযুক্ত। আঁইশের বিন্যাস: গ্রীবায় ১৭-১৯ সারি, দেহের মধ্যভাগে ১৬-১৭ সারি এবং পায়ুর সামনে ১৪ সারি; অঙ্কীয় আঁইশের সংখ্যা ১৯০-২১৩টি; পায়ুর আঁইশ বিভক্ত; নিম্ন-পুচ্ছের আঁইশের সংখ্যা ১০০-১৪৬টি, জোড়ায় থাকে; টেম্পােরাল ২+২, কখনাে ১+২ ২+৩; লােরিয়াল ২ বা ৩টি (Smith, 1943; Whitaker and Captain, 2004) ।
স্বভাব ও আবাসস্থল: দেশি দাঁড়াশ সাপ কৃষিজ আবাদী জমি, চারণভূমি বনজঙ্গল, মরুভূমি, ম্যানগ্রোভ ও পাহাড়ী এলাকায় বাস করে। এরা শিকার ধরার জন্য ইঁদুরের গর্ত এবং উঁইপোকার টিবিতে অবস্থান করে। এরা উভচর তবে রাতের বেলায়ও এদের সক্রিয় দেখা যায়। এরা সুযােগ সন্ধানী প্রিডেটর এবং খাদ্য হিসেবে কোলাব্যাঙ, কুনােব্যাঙ মাছ, টিকটিকি, পাখি, পাখির বাচ্চা, ইঁদুর, বানর, ছােট সাপ এবং ছােট কচ্ছপ ভক্ষণ করে (Whitaker and Captain, 2004)।
এরা সক্রিয় আহােরণ করতে পারে এবং সক্রিয়ভাবে সঁতার কাটে। এই সাপ মানুষের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলে তবে উত্তেজিত হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ছােবল মারে। ছােবল মারার পূর্বে এরা মাথা খাড়া করে এবং দেহ S আকৃতির ধারণ করে দেহের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং গলা প্রসারিত করে পরে বিড়ালের মতাে শব্দ সৃষ্টি করে। স্থানভেদে এদের প্রজননের পার্থক্য হয়, সাধারণত মে-জুন মাসে এদের প্রজননকাল সম্পন্ন হয়। স্ত্রী সাপ মার্চ এবং সেপ্টেম্বর মাসে গুচ্ছে ৫-২২টি চকচকে সাদা ডিম পাড়ে, ডিমের পরিমাপ ৪৫-৫০ x ৩০-৪০ মিমি (Smith, 1943)। ডিম আঠালাে এবং একটির সাথে অপরটি যুক্ত থাকে এবং স্ত্রী সাপ ডিমের উপর কুন্ডলী পাকিয়ে অবস্থান করে। পরিস্ফুটনকাল প্রায় ২ মাস এবং সদ্য পরিস্ফুটিত সাপের দৈর্ঘ্য ৩৬-৪৭ সেমি (Das, 2002)। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সাপ ১ বছরে দ্বিগুণ লম্বা হয় এবং যৌন পরিপক্কতা লাভের জন্য প্রায় ৩ বছর সময় লাগে (Daniel, 2002)।
দাঁড়াশ এর ব্যাবহার খুবই আক্রমানাক্ত ও মারমুখি ধরনের, এরা খুব দ্রুত গতিতে চলাফেরা করতে পারে। ধারাজ সাপের এই ব্যাবহারের জন্য মানুষ একে ভয়ংকর ও বিষাক্ত বলে মনে করে। গাছ বেয়ে উঠা, সাঁতার কাটা ও ডুব দিয়ে থাকতে পারে অনেক সময় পর্যন্ত। ধরা পড়ার পর কিছুটা মারমুখি দেখালেও পরে খুব সহজেই নেতিয়ে যায়।
বিস্তৃতি: বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে দেশি ধারাজ সাপকে বাংলাদেশের আবাসিক সাপ হিসেবে ধরা হয়েছে। এ প্রজাতির সাপ বাংলাদেশের সব এলাকায় বিস্তৃত। এরা আফগানিস্তান, ইরান, ভারত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, লাওস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, এবং তুর্কমেনিস্তানে অংশে পাওয়া যায়।
অবস্থা: আইইউসিএন এটিকে এখনও শ্রেণিকরণ করেনি। এটি বাংলাদেশে এবং বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত। এই প্রজাতির সাপ CITES-এর পরিশিষ্ট-২-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তবে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (অধ্যাদেশ), আইন, ১৯৭৪-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রজাতির সাপ বাংলাদেশে সংকটাপন্ন (IUCN Bangladesh, 2000)
মন্তব্য: প্রতিবছর বীজতলা থেকে শুরু করে খাদ্যগুদাম পর্যন্ত ইঁদুরে বিনষ্ট করে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ৩০ শতাংশ। তাছারা ইঁদুর নিধনে যেই বিষ প্রয়োগ করা হয় সেই বিষের প্রভাবে অন্যান্য প্রাণীও আক্রান্ত হয়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বিষ খাদ্য বস্তুর মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানাবিধ মারাত্মক রোগের কারণ ঘটায়, যা আর্থিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে আমদের সকলকে।
উল্লেখ্য কৃষি কর্মকর্তাদের মতে একটি দারাজ সাপ প্রায় ৩ একর ফসলী জমির ইদুর নিধন করতে সক্ষম। তাই আমরা কীটনাশক ও বিষ প্রয়গ থেকে সরে এসে যদি পরিবেশবান্ধব সাপ সংরক্ষণ করি তাহলে আমরা অনেক উপকৃত হবো। এতে প্রতিবছর ইঁদুর দমন অভিযানের মাধ্যমে অর্থ ব্যয় এর পরিমাণও কমে যাবে। ইঁদুরের কবল থেকে এদেশকে মুক্ত করতে চাইলে দারাজ সাপ উৎপাদন, সংরক্ষন ও প্রকৃতি থেকে সাপের বংশ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে এবং আমাদের দেশের সকল মানুষকে দারাজ সাপসহ সকল সাপ সম্পর্কে সঠিক ধারনা প্রদান এবং সাপ সংরক্ষণ করতে হবে যা কৃষি ও কৃষকের জন্য উপকারী। এদের খাদ্যাভ্যাস উপকৃত করছে আমাদের কৃষিকে এবং ভারসাম্য রক্ষা করছে আমাদের প্রকৃতির।
এই সাপ অবিষাক্ত তবে-এর কামড় যন্ত্রণাদায়ক। বাংলাদেশের কিছু উপজাতী সল্পদ্রায়ের লােক, ভারত এবং চীনে এই প্রজাতির সাপ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই সাপ ইদুর মারে বলে এদের নাম Rat Snake হয়েছে।
ছবির ইতিহাস: দেশি দাঁড়াশ সাপের মাথার ছবিটি ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে Dr. Raju Kasambe-এর তোলা।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাবিদ। তাঁর প্রথম কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তাঁর মোট প্রকাশিত গ্রন্থ ১২টি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তাঁর সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদ গ্রন্থ দুটি পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৬ জুন, ১৯৭৭ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন।